ঢাকায় মার্কিন রাষ্ট্রদূতের গাড়ি বহরে হামলায় অভিযুক্ত ছাত্রলীগ নেতাসহ নয়জন
2021.03.05
ঢাকা

যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক রাষ্ট্রদূত মার্শা বার্নিকাটের গাড়ি বহরে এবং ঢাকার মোহাম্মদপুরের একটি বাড়িতে হামলার ঘটনার প্রায় আড়াই বছর পর আদালতে অভিযোগপত্র জমা দিয়েছে পুলিশ, যদিও তা প্রত্যাখ্যান করেছেন বাড়িটির অন্যতম মালিক ও মামলার বাদী বদিউল আলম মজুমদার।
গত ১৮ জানুয়ারি তদন্ত কর্মকর্তা ও পুলিশ পরিদর্শক মো. আব্দুর রউফ সাক্ষরিত ওই চার্জশিট আদালতে জমা দেয়া হয়, যা শুক্রবার ঢাকার গণমাধ্যম জানতে পারে।
ঢাকার চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট (সিএমএম) আদালতে এই অভিযোগপত্র জমা দেওয়ার বিষয়টি সাংবাদিকদের নিশ্চিত করেছেন মহানগর পুলিশের অপরাধ তথ্য ও তদন্ত বিভাগের উপ-কমিশনার জাফর হোসেন।
অভিযোগপত্রের একটি কপি বেনার প্রতিবেদকের হাতে এসেছে, যেখানে উল্লেখ করা হয়েছে, রাষ্ট্রদূত সরকারবিরোধী ষড়যন্ত্র করছেন সন্দেহে স্থানীয় আওয়ামী লীগের নেতা–কর্মীরা ওই হামলা চালায়। ওই ঘটনায় ছাত্রলীগ নেতা নাইমুল হাসানসহ নয়জনকে আসামি করা হয়েছে।
অন্য আসামিরা হলেন; ফিরোজ মাহমুদ, মীর আমজাদ হোসেন, মো. সাজু ইসলাম, রাজিবুল ইসলাম রাজু, শহিদুল আলম খান কাজল, তান্না ওরফে তানহা ওরফে মুজাহিদ আজমি তান্না ও সিয়াম, অলি আহমেদ ওরফে জনি।
তবে এই অভিযোগপত্র প্রত্যাখ্যান করে মামলার বাদী ও সুজনের (সুশাসনের জন্য নাগরিক) সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার শুক্রবার রাতে বেনারকে বলেন, “এটা চরম প্রহসনমূলক চার্জশিট। কারণ, মূল আসামি ইসতিয়াক মাহমুদ, যিনি ক্ষমতাসীন রাজনীতির সাথে জড়িত, তাঁকে বাদ দিয়েই এই চার্জশিট দেওয়া হয়েছে।”
তিনি বলেন, “আমার বাড়িতে আক্রমণ হয়েছে। অথচ পুলিশ বলছে, সেখানে রাষ্ট্রবিরোধী ষড়যন্ত্র চলছিল। এই চার্জশিট আমি প্রত্যাখ্যান করছি।”
“আমার গৃহের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা রাষ্ট্রের দায়িত্ব। সংবিধানের ৪৩ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী এটা আমার মৌলিক অধিকার। এই হামলার পরিণতি ভয়াবহ হতে পারত। রাষ্ট্রদূত কিংবা আমরা আহত বা নিহত হতে পারতাম,” বলছিলেন বদিউল আলম মজুমদার।
২০১৮ সালের ৪ আগস্ট রাতে সুজন সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদারের মোহাম্মদপুর এলাকার বাসায় নৈশভোজে অংশ নেন মার্শা বার্নিকাট। নৈশভোজ শেষে রাত ১১টার দিকে ফেরার পথে সশস্ত্র একদল মোটরসাইকেল আরোহী রাষ্ট্রদূতের গাড়িতে হামলা চালায়।
হামলাকারীরা গাড়িবহরের দিকে এগোনোর সময় তাদের বাধা দেওয়া হলে রাষ্ট্রদূতের নিরাপত্তা দলের দুই সদস্যকে ঘুষি মারে হামলাকারীরা। রাষ্ট্রদূতের গাড়ি বহরের দুটি গাড়িতে লাঠি দিয়ে আঘাতও করা হয়।
এ ঘটনায় ওই বছর ১০ আগস্ট রাতে সুজন সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার বাদী হয়ে মোহাম্মদপুর থানায় মামলা দায়ের করেন। মামলার তদন্ত ও বিচার নিশ্চিত করতে ঢাকাস্থ মার্কিন দূতাবাস এবং যুক্তরাষ্ট্র সরকার বেশ কয়েকবার সরকারকে তাগিদ দেয়।
অভিযোগপত্রে বলা হয়, নৈশভোজের নামে সরকারবিরোধী ষড়যন্ত্র হচ্ছে সন্দেহে ওই রাতে স্থানীয় ছাত্রলীগের নেতা নাইমুল হাসানের নেতৃত্বে স্থানীয় আওয়ামী লীগ ও এর অঙ্গসংগঠনের নেতা–কর্মীদের একটি দল গাড়িবহরে ইটপাটকেল নিক্ষেপ করে।
অভিযোগপত্রে উল্লেখ করা হয়, আনুমানিক রাত ১১টায় ছাত্রলীগের নাইমুল হাসান ওরফে রাসেলের নেতৃত্বে স্থানীয় আওয়ামী লীগ ও অঙ্গসংগঠনের নেতাকর্মীরা এই হামলা চালায়। তারা মার্শা বার্নিকাটের গাড়ি ধাওয়া করলে রাষ্ট্রদূত দ্রুত ঘটনাস্থল ত্যাগ করেন।
এতে বলা হয়, এ সময় সুজনের সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদারের বাড়িতেও ইটপাটকেল নিক্ষেপ করা হয়। দলটি বাড়ির জানালার গ্লাস ভাঙচুর করে বদিউল আলম, তাঁর স্ত্রী ও ছেলে মাহবুব মজুমদারকে জীবননাশের হুমকি দেয়। মাহবুবকে ধাক্কা দিয়ে আঘাত করে। বাড়ির প্রধান গেট ধাক্কাধাক্কি করে, ভয়ভীতি দেখিয়ে তারা চলে যায়।
অভিযোগপত্রে অজ্ঞাতনামা আরও ১৫-২০ জন আসামি রয়েছে, যাদের নাম-ঠিকানা জানতে না পারায় অভিযোগপত্রে নাম আসেনি। তবে এদের পূর্ণাঙ্গ নাম–ঠিকানা পাওয়া গেলে ভবিষ্যতে সম্পূরক অভিযোগপত্র দাখিল করা হবে বলে জানানো হয়েছে। মামলায় ১৯ জনকে সাক্ষী করা হয়েছে।
এদিকে অভিযুক্তদের মধ্যে ছয়জন গত ২৮ ফেব্রুয়ারি আদালত থেকে জামিন নিয়েছেন এবং তিনজন এখনো পলাতক বলে আদালত সূত্রের বরাতে এক প্রতিবেদনে জানায় ডেইলি স্টার।
উল্লেখ্য, ড. মজুমদারের বাড়িতে ওই নৈশভোজে অংশ নেন জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের শীর্ষ নেতা ও গণফোরাম সভাপতি ড. কামাল হোসেন ও তাঁর স্ত্রী মানবাধিকার কর্মী হামিদা হোসেন, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা হাফিজ উদ্দিন আহমেদসহ আরও কয়েকজন। সে সময় রাজধানীসহ সারা দেশে নিরাপদ সড়ক আন্দোলন চলছিল।
২০১৮ সালে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও সংগঠন সরকারবিরোধী কর্মকাণ্ড চালায় বলে অভিযোগপত্রে উল্লেখ করা হয়। এতে বলা হয়, “ড. বদিউল আলম মজুমদার এবং ড. কামাল হোসেন বিভিন্ন সময় সরকারের নানামুখী কঠোর সমালোচনা করে থাকেন। তাঁরা দেশি-বিদেশি গণমাধ্যম ও সংস্থার কাছে সরকারবিরোধী বিরূপ মন্তব্য করে থাকেন।”
যদিও বদিউল আলম মজুমদার বলেছেন, এটা সরকারবিরোধী কোনো সভা ছিল না। স্রেফ তাঁর অনুরোধ ও আমন্ত্রণে মার্কিন রাষ্ট্রদূত এবং কয়েকজন বিশিষ্ট নাগরিক নৈশভোজে যোগ দিয়েছিলেন।
এই অভিযোগপত্র সম্পর্কে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তরে মন্তব্যের জন্য যোগাযোগ করা হলে তাঁরা বিষয়টি সম্পর্কে গণমাধ্যম থেকে জেনেছেন বলে শুক্রবার বেনারকে জানান পররাষ্ট্রদপ্তরের একজন মুখপাত্র।
“এ বিষয়ে গণমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদগুলো সম্পর্কে আমরা অবগত, বিষয়টিতে আমরা নজর রাখব,” বেনারকে জানান ওই মুখপাত্র।