সাময়িক মুক্তি পেলেন খালেদা জিয়া
2020.03.25
ঢাকা
দুর্নীতির দুটি মামলায় ১৭ বছরের কারাদণ্ড পাওয়া সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া সাময়িক মুক্তি পেয়েছেন। দুই বছরের বেশি সাজাভোগের পর বুধবার ঢাকার গুলশানে নিজ বাসভবনে ফিরেছেন তিনি।
বিশ্বব্যাপী সংক্রমিত করোনাভাইরাস মোকাবিলায় বৃহস্পতিবার সারা দেশ প্রায় ‘লকডাউন’ হওয়ার আগ মুহূর্তে সরকারি নির্দেশে তাঁর সাজা ছয় মাসের জন্য স্থগিত হয়। এর পরই সাবেক এই প্রধানমন্ত্রীকে মুক্তি দেয় ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার কর্তৃপক্ষ। তাঁকে ছোট ভাই শামীম ইস্কান্দরের জিম্মায় দেওয়া হয়।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) ‘প্রিজন সেল’ থেকে বিকেল সোয়া চারটার দিকে বেরিয়ে আসেন খালেদা জিয়া। এ সময় গোলাপি শাড়ি পরা খালেদার চোখে ছিল কালো চশমা।
রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক ড. আতাউর রহমান বেনারকে বলেন, “আজকের এই দুর্যোগকালীন মুহূর্তে এটা খুবই দরকার ছিল। এ ক্ষেত্রে সরকার ও আওয়ামী লীগ প্রধান শেখ হাসিনা দূরদর্শিতার পরিচয় দিয়েছেন বলে আমি মনে করি।”
“এটি অবশ্যই ইতিবাচক একটি ঘটনা, যা দেশের দুটি প্রধান দুই রাজনৈতিক শক্তি আওয়ামী লীগ ও বিএনপির মধ্যেকার অস্বস্তিকর বিভাজন কিছুটা হলেও ঘোচাবে,” যোগ করেন বাংলাদেশ রাষ্ট্রবিজ্ঞান সমিতির এই সাবেক সভাপতি।
বাংলাদেশে এবারই প্রথম
মঙ্গলবার খালেদা জিয়াকে মানবিক কারণে শর্তসাপেক্ষে ছয় মাসের জন্য মুক্তি দেওয়ার কথা জানায় সরকার। সেদিন আইনমন্ত্রী আনিসুল হক সাংবাদিকদের বলেন, খোদ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশে নির্বাহী ক্ষমতাবলে ছয়মাসের জন্য তাঁর সাজা স্থগিত করা হয়েছে।
এরই ধারাবাহিকতায় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, “শর্ত দুটি হলো— তিনি ঢাকায় নিজ বাসায় থাকবেন এবং দেশের বাইরে যেতে পারবেন না।”
বাংলাদেশে এই প্রক্রিয়ায় মুক্তির ঘটনা এটিই প্রথম বলে জানান আইন বিশেষজ্ঞরা।
এ প্রসঙ্গে সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ও নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের শিক্ষক ব্যারিস্টার আরাফাত হোসেন খান বেনারকে বলেন, “বিভিন্ন সময়ে প্যারোলে মুক্তির অনেক উদাহরণ থাকলেও দেশ স্বাধীনের পর ফৌজদারি কার্যবিধির (সিআরপিসি) ৪০১ ধারার এক উপধারার প্রয়োগ এটাই প্রথম।”
“বাংলাদেশে এর আগে এই ধারায় সাজা স্থগিত করার কোনও নজির ছিল না,” মন্তব্য করে খালেদা জিয়ার আইনজীবী খন্দকার মাহবুব হোসেন বেনারকে বলেন, “যারা বিএনপির নীতিনির্ধারক আছেন, তাঁরা যদি এটার ওপর জোর দিতেন, তাহলে এই দীর্ঘ সময় বন্দী থেকে তাঁর স্বাস্থ্যের এতটা অবনতি হতো না।”
এ ব্যাপারে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও সড়ক পরিবহনমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের সাংবাদিকদের বলেন, “বেগম জিয়ার পরিবার ১০ থেকে ১১ দিন আগে আবেদন করেছেন। ইচ্ছে করলে তাঁরা আরও আগেই আবেদন করতে পারতেন।”
ফৌজদারি কার্যবিধির ৪০১ ধারা অনুযায়ী সরকার যে কোনো সময় দণ্ডিত ব্যক্তির সাজা শর্তসাপেক্ষে অথবা বিনাশর্তে স্থগিত রাখতে বা সম্পূর্ণ অথবা আংশিক মওকুফ করতে পারে বলে বেনারকে জানান ব্যারিস্টার আরাফাত।
এই আইন অনুযায়ী মুক্তির মেয়াদ বাড়ানোরও সুযোগ আছে জানিয়ে খন্দকার মাহবুব বলেন, “এ ছাড়া সাজা মওকুফ করার জন্য সরকারের কাছে আবেদন করারও সুযোগ রয়েছে।”
তবে সরকার খালেদা জিয়ার সাজা স্থগিত করার সিদ্ধান্ত নিলেও “তাঁর শাস্তি পুরোপুরি মওকুফ করা হবে না,” বলে সুপ্রিম কোর্টে নিজ কার্যালয়ে সাংবাদিকদের জানান অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম।
এদিকে খালেদা জিয়ার মুক্তির বিষয়টি “রাজনৈতিক সদিচ্ছার ব্যাপার,” মন্তব্য করে ড. আতাউর বলেন, “ছয় মাস পরে পরিস্থিতিটা কেমন হবে, তা এখনই বোঝা মুশকিল।”
গত দুই বছরে বহুবার আবেদন করেও আদালত থেকে জামিন না পাওয়া খালেদা জিয়া মোট ৩৬টি মামলার আসামি। জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতির মামলায় সাজাপ্রাপ্ত হয়ে ২০১৮ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি তিনি কারাবন্দী হন।
ওই মামলায় তাঁকে প্রথমে পাঁচ বছর এবং পরবর্তীতে তা বাড়িয়ে ১০ বছরের কারাদণ্ড দেয় আদালত। এ ছাড়া জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলায় সাত বছরের কারাদণ্ড হয়েছে তাঁর। গত বছরের পহেলা এপ্রিল বিএসএমএমইউতে ভর্তি করানো হয়েছিল তাঁকে।
রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে ‘না’
সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম বলেন, “আমি মনে করি রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে অংশ নিলে তাঁর মুক্তির শর্ত ভঙ্গ হবে।”
এ ব্যাপারে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল বুধবার সাংবাদিকদের জানান, দণ্ডাদেশে সাজাপ্রাপ্ত হওয়ায় খালেদা জিয়া রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে অংশ নিতে পারবেন না।
সরকারের দেওয়া শর্ত ভঙ্গ করলে তাঁর মুক্তি বাতিল করা হবে বলেও উল্লেখ করেন অ্যাটর্নি জেনারেল ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী। তবে খালোদা জিয়ার মুক্তিতে “রাজনীতি বিষয়ক কোনো শর্তে উল্লেখ করা হয়নি,” বলে দাবি করেন খন্দকার মাহবুব।
এদিকে রাজনৈতিক পরিস্থিতি যাই হউক না কেন, খালেদা জিয়াকে ‘বাঁচানোর’ উদ্দেশ্যেই পরিবারের পক্ষ থেকে সরকারের কাছে আবেদন করে তাঁর মুক্তির ব্যবস্থা করা হয়েছে বলে বেনারকে জানান তাঁর বোন সেলিমা ইসলাম।
“আমাদের উদ্দেশ্য ছিল মানুষটাকে বাঁচানো। রাজনৈতিক অবস্থা যাই হউক, তাকে তো বাঁচাতে হবে আগে। সে কারণই আমরা সরকারের কাছে আবেদন করে তাঁর মুক্তির ব্যবস্থা করেছি,” বুধবার বেনারকে বলেন সেলিমা ইসলাম।
খালোদা জিয়ার স্বাস্থ্য ‘খুবই খারাপ’
জেল থেকে ছাড়া পাওয়া খালেদা জিয়ার স্বাস্থ্যগত অবস্থা বেশ খারাপ বলে বেনারকে জানিয়েছেন তাঁর বোন সেলিমা ইসলাম। তিনি জানান শ্বাসকষ্টের কারণে কারো সাথে ভালোভাবে কথাও বলতে পারছেন না খালেদা জিয়া।
“তার শরীরের অবস্থা খুবই খারাপ, আজকে দেখলাম শ্বাসকষ্ট শুরু হয়েছে। এজন্য সে কারো সাথে ঠিকমতো কথাই বলতে পারছিল না,” বুধবার রাতে বেনারকে জানান সেলিমা ইসলাম।
খালেদা জিয়াকে বাসায় পৌঁছে দেওয়ার পর বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর সাংবাদিকদের জানান, ব্যক্তিগত চিকিৎসকের পরামর্শে বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া আপাতত তাঁর নিজ বাসায় ১৪ দিনের কোয়ারেন্টিনে থাকবেন।
খালেদা জিয়ার চিকিৎসার জন্য বিএনপির পক্ষ থেকে মেডিক্যাল বোর্ড গঠন করা হয়েছে। এই বোর্ডের সদস্যরা তাঁর সঙ্গে দেখা করেছেন জানিয়ে মির্জা ফখরুল বলেন, পরিবারের সদস্য ও চিকিৎসকদের সাথে আলাপ করে তাঁর চিকিৎসার ব্যাপারে পরবর্তী সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।
খালেদা জিয়া নেতাকর্মীদের শুভেচ্ছা জানিয়েছেন এবং করোনাভাইরাস মোকাবেলায় সবাইকে সতর্ক থাকতে বলেছেন বলে জানান মির্জা ফখরুল।
প্রতিবেদনে তথ্য দিয়ে সহায়তা করেছেন ঢাকা থেকে কামরান রেজা চৌধুরী।