চার মামলায় দণ্ডিত তারেকের সঙ্গে এবার স্ত্রী জোবায়দারও বিচার শুরু

কামরান রেজা চৌধুরী
2023.04.13
ঢাকা
চার মামলায় দণ্ডিত তারেকের সঙ্গে এবার স্ত্রী জোবায়দারও বিচার শুরু বিএনপির বরিশাল বিভাগীয় সমাবেশে অনেকের হাতে ছিল দলটির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের ছবি। ৫ নভেম্বর ২০২২।
[বেনারনিউজ]

জ্ঞাত আয়বহির্ভূত প্রায় পাঁচ কোটি টাকার বেশি সম্পদ অর্জনের অভিযোগে দুর্নীতি দমন কমিশনের মামলায় লন্ডনে অবস্থানরত বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান ও তাঁকে সহযোগিতা করার অভিযোগে স্ত্রী ডা. জোবায়দা রহমানের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করেছে আদালত। এর মাধ্যমে তাঁদের বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিক বিচার শুরু হলো।

বৃহস্পতিবার ঢাকা মহানগর জ্যেষ্ঠ বিশেষ বিচারক মো. আছাদুজ্জামান তারেক রহমান ও জোবায়দা রহমানের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠনের পর আগামী ১৬ মে সাক্ষ্যগ্রহণ শুরুর তারিখ নির্ধারণ করেছেন।

দুর্নীতি দমন কমিশনের আইনজীবী মোশারফ হোসেন কাজল বেনারকে এই তথ্য জানিয়েছেন।

২০০৭ সালে সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে তাঁদের বিরুদ্ধে মামলাটি দায়ের করা হয়েছিল। আইন অনুযায়ী, দোষী সাব্যস্ত হলে তাঁদের সর্বোচ্চ ১০ বছর কারাদণ্ড হতে পারে।

বিএনপি নেতারা বলছেন, তারেক রহমানের বিরুদ্ধে চারটি মামলায় সাজার রায় হয়েছে। এই প্রথম ডা. জোবায়দা রহমানের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করা হলো।

তাদের অভিযোগ, আগামী নির্বাচন সামনে রেখে জিয়া পরিবারের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক প্রতিহিংসা চরিতার্থ করতে তারেক রহমান ও তাঁর স্ত্রীর বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করা হয়েছে।

আইনমন্ত্রী আনিসুল হক এই অভিযোগ অস্বীকার করে বলেছেন, এই ধরনের অভিযোগ ‘কাল্পনিক’।

মোশারফ হোসেন কাজল বৃহস্পতিবার বেনারকে বলেন, “এই মামলা বহুদিন ধরে চলে আসছে। বছরের পর বছর ডাকা হলেও তারা আদালতে হাজির হননি; পলাতক থেকেছেন। সেই কারণে উচ্চ আদালতের নির্দেশে আজকে আদালতে এই মামলার অভিযোগ গঠিত হয়েছে।”

তিনি আরও বলেন, “তারেক রহমান ও তাঁর স্ত্রীর জন্য আইনজীবী নিয়োগের আবেদন করা হয়েছিল। বিএনপি সমর্থিত কমপক্ষে ২০০ আইনজীবী আজ আদালতে উপস্থিত ছিলেন। তবে আদালত সেই আবেদন নাকচ করে দিয়েছেন। কারণ তাঁরা উচ্চ আদালতের আদেশ অমান্য করেছেন।”

কাজল বলেন, “আদালতের এই সিদ্ধান্তের ফলে মামলার বিচারিক কার্যক্রমে তারেক রহমান ও জোবায়দা রহমান কোনো আইনজীবী পাবেন না।”

আদালতের আদেশের পর তাদের আইনজীবী মাসুদ আহম্মেদ তালুকদারসহ বিএনপি সমর্থিত আইনজীবীরা আদালতে তারেক রহমান ও জোবায়দার পক্ষে স্লোগান দেন এবং ক্ষোভ প্রকাশ করেন।

বিএনপির মতে ‘প্রতিহিংসা

বিএনপির মিডিয়া সেলের প্রধান জহির উদ্দিন স্বপন বৃহস্পতিবার বেনারকে বলেন, “এই সরকার রাষ্ট্রযন্ত্র ব্যবহার করে আমাদের দলের প্রধান ও তাঁর সহধর্মীনির বিরুদ্ধে অসত্য অভিযোগ গঠন করেছে। এটি তাদের রাজনৈতিক প্রতিহিংসা চরিতার্থ করার আরেকটি উদাহরণ।”

তিনি বলেন, “এর আগে তারেক রহমান সাহেবের বিরুদ্ধে অনেক বড়ো অভিযোগ গঠন করে সাজা দিয়েছে। আজকের অভিযোগ গঠনের মাধ্যমে উনার স্ত্রী ডা. জোবায়দা রহমানকেও ভিকটিমাইজ করার প্রক্রিয়া শুরু হলো। অর্থাৎ উনিও বাদ থাকলেন না। জিয়া পরিবারের প্রাপ্তবয়স্ক কেউ আর আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক প্রতিহিংসা থেকে রক্ষা পেলেন না।”

জহির উদ্দিন স্বপন বলেন, “এই সব কিছুর মূল উদ্দেশ্য হলো আগামী নির্বাচনে ফাঁকা মাঠে গোল দিয়ে পুনরায় ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হওয়া।”

বিএনপির অভিযোগের ব্যাপারে প্রশ্ন করা হলে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বৃহস্পতিবার বেনারকে বলেন, “এসব কাল্পনিক অভিযোগ তারা সব সময়ই করে আসছে। রাষ্ট্রযন্ত্রকে ব্যবহার করে দেশের বিচার ব্যবস্থা ধ্বংস করে বিরোধীদের বিরুদ্ধে ব্যবহারের চর্চা ও অভিজ্ঞতা বিএনপি’র রয়েছে। সেই কারণে তাঁরা আমাদের বিরুদ্ধে এমন অভিযোগ করছেন।”

বিএনপি প্রধান বেগম খালেদা জিয়া দুটি মামলায় ১৭ বছর দণ্ডিত। এরপর দলের প্রধান হন লন্ডনে অবস্থানরত তাঁর ছেলে তারেক রহমান, যাঁর বিরুদ্ধে ব্যাপক দুর্নীতির অভিযোগ তুলে আসছে আওয়ামী লীগ।

২০০১ সালের অক্টোবর থেকে ২০০৬ সালের অক্টোবর পর্যন্ত ক্ষমতায় ছিল বিএনপি এবং প্রধানমন্ত্রী ছিলেন বেগম খালেদা জিয়া। পাঁচ বছর দায়িত্ব শেষ করে ২০০৬ সালের অক্টোবরের শেষ দিকে পদত্যাগ করে তৎকালীন রাষ্ট্রপতি ইয়াজউদ্দিন আহমেদের নেতৃত্বে গঠিত নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করে বিএনপি সরকার।

বিএনপি’র প্রতি পক্ষপাতিত্বের অভিযোগে আওয়ামী লীগসহ দেশের প্রায় সব দল ওই তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলন শুরু করলে ২০০৭ সালের ১১ জানুয়ারি নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচন স্থগিত করেন রাষ্ট্রপতি ইয়াজউদ্দিন আহমেদ, জারি করেন জরুরি অবস্থা। গঠিত হয় সেনা সমর্থিত নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার, যার নেতৃত্বে ছিলেন কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. ফখরুদ্দীন আহমেদ।

তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে বিএনপি প্রধান বেগম খালেদা জিয়া, আওয়ামী লীগ প্রধান শেখ হাসিনাসহ শতাধিক রাজনীতিকের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করে দুর্নীতি দমন কমিশন।

আটক হন খালেদা জিয়া, শেখ হাসিনা, তারেক রহমানসহ অনেকে। পরবর্তীতে তাঁদের প্রায় সবাইকে মুক্ত করে দেয় সরকার।

প্রায় দেড় বছর কারাভোগের পর সপরিবারে লন্ডনে চলে যান তারেক রহমান।

২০০৭ সালের ২৬ সেপ্টেম্বর ঢাকার কাফরুল থানায় তারেক রহমান ও জোবায়দা রহমানের ঘোষিত আয়ের বাইরে চার কোটি ৮১ লাখ টাকার বেশি অবৈধ সম্পদ রাখার অভিযোগে মামলা করে দুর্নীতি দমন কমিশন।

ওই মামলায় জোবায়দা রহমানের মা ইকবাল মান্দ বানুকেও আসামি করা হয়েছিল। পরের বছর তিন জনের বিরুদ্ধেই আদালতে অভিযোগপত্র জমা দেয় কমিশন। এরপর মামলা বাতিল চেয়ে উচ্চ আদালতে আবেদন করা হয়।

শুনানি নিয়ে আদালত মামলার কার্যক্রম স্থগিত করে রুল জারি করে। এর বিরুদ্ধে কমিশন আপিল করে। আপিল বিভাগ উচ্চ আদালতের আদেশ বহাল রাখে।

২০১৭ সালের ১২ এপ্রিল মামলা বাতিলের আবেদন খারিজ করে রায় দেয় উচ্চ আদালত। উচ্চ আদালতের আদেশের বিরুদ্ধে ওই বছরই আপিল করেন জোবায়দা।

প্রধান বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকীর নেতৃত্বাধীন চার সদস্যের আপিল বেঞ্চ লিভ-টু-আপিল (আপিলের অনুমতি) খারিজ করে উচ্চ আদালতের দেওয়া রায় বহাল রাখেন।

ওই রায়ের পরই নিম্ন আদালতে মামলার অভিযোগ গঠন করা হলো।

উল্লেখ্য, তারেক রহমানের বিরুদ্ধে ১৯টি মামলা রয়েছে। যার মধ্যে চারটিতে তাঁর সাজা হয়েছে। ২০০৪ সালের একুশে আগস্ট তৎকালীন বিরোধী দলীয় নেত্রী শেখ হাসিনার সমাবেশে গ্রেনেড হামলা মামলায় যাবজ্জীবন কারাদণ্ড পেয়েছেন তারেক রহমান।

এ ছাড়া বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে কটূক্তি করার মামলায় দুই বছর, একটি অর্থ পাচার মামলায় সাত বছর এবং জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলায় ১০ বছর সাজা হয়েছে তাঁর।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।