বিক্ষোভের মুখে শেখ হাসিনার যুক্তরাষ্ট্র সফর

আশীফ এন্তাজ রবি
2023.05.03
ওয়াশিংটন ডিসি
বিক্ষোভের মুখে শেখ হাসিনার যুক্তরাষ্ট্র সফর ‘হাসিনার অব্যবস্থাপনা থেকে বাংলাদেশের অর্থনীতিকে রক্ষা করো’ লেখা ব্যানার নিয়ে ওয়াশিংটন ডিসিতে বিশ্বব্যাংকের সদরদপ্তরের সামনে প্রবাসী বিএনপি সমর্থকদের বিক্ষোভ। ১ মে ২০২৩।
[সৌজন্যে: বিএনপি]

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যখন আন্তর্জাতিক বিনিয়োগকারীদের কাছে বাংলাদেশের সম্ভাবনাময় ও বৈচিত্র্যপূর্ণ গণতন্ত্র সম্পর্কে উচ্চ ধারণা দিতে যুক্তরাষ্ট্র সফর করছেন, তখনই তাঁর সফরকে কেন্দ্র করে ওয়াশিংটন ডিসির রাস্তায় ঘটেছে বিক্ষোভ, এমনকি হাতাহাতির ঘটনা।

মঙ্গলবার প্রধানমন্ত্রীর হোটেল ‘রিজ-কার্টনে’র সামনেও বাংলাদেশের বিরোধীদল বিএনপির সমর্থকরা বিক্ষোভ করেন।

এর আগে সোমবার শেখ হাসিনা ওয়াশিংটন ডিসিতে বিশ্বব্যাংক সফরকালে প্রতিষ্ঠানটির সদরদপ্তরের সামনে বিক্ষোভ করেন ওয়াশিংটন, ভার্জিনিয়া ও মেরিল্যান্ড রাজ্যের বিএনপি সমর্থকরা। এক পর্যায়ে সরকার দলীয় সমর্থকদের সাথে বিএনপি সমর্থকদের হাতাহাতির ঘটনাও ঘটে।

এই বিক্ষোভের কারণে মঙ্গলবার প্রধানমন্ত্রীর হোটেলের আশপাশের রাস্তা ‘জননিরাপত্তার’ খাতিরে বন্ধ করে দেয় ভার্জিনিয়া রাজ্যের স্থানীয় ফেয়ারফ্যাক্স কাউন্টি পুলিশ।

ফেসবুকে প্রচারিত একাধিক ভিডিও ফুটেজে দেখা যায় সোমবার বিক্ষোভের এক পর্যায়ে বিশ্বব্যাংক সদরদপ্তরের সামনে বিএনপি ও আওয়ামী লীগ সমর্থকরা লাঠিসোঁটা ও হাতাহাতির মাধ্যমে সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়েছেন।

বিশ্লেষকদের মতে, শেখ হাসিনার যুক্তরাষ্ট্র সফরের মূল উদ্দেশ্য ছিল নির্বাচনের বছরে বাংলাদেশের সংকটাপন্ন অর্থনীতিতে বিশ্বব্যাংকের সমর্থন আদায়। চলতি বছরের শেষ অথবা আগামী বছরের শুরুর দিকে বাংলাদেশে জাতীয় নির্বাচন হবার কথা রয়েছে।

“হাসিনার অব্যবস্থাপনা থেকে বাংলাদেশের অর্থনীতিকে রক্ষা করো” ইংরেজিতে লেখা এমন ব্যানার নিয়ে সোমবার অনেক বিএনপি সমর্থক বিশ্বব্যাংকের সামনে বিক্ষোভে অংশগ্রহণ করেন।

বাংলাদেশ বর্তমানে “ক্রমবর্ধমান মূল্যস্ফীতির চাপ, জ্বালানি সংকট, ব্যালেন্স অব পেমেন্ট ঘাটতি এবং কর ঘাটতিতে রয়েছে” বলে গত মাসে জানিয়েছিল বিশ্বব্যাংক।

যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় স্টেট ইউনিভার্সিটির রাজনীতি বিজ্ঞানের অধ্যাপক আলী রিয়াজের মতে, বাংলাদেশের অর্থনীতির এই শোচনীয় অবস্থায় পৌঁছানোর জন্য দায়ী শেখ হাসিনা সরকারের অপ্রয়োজনীয় বড়ো বড়ো অবকাঠামো প্রকল্প বাস্তবায়ন, যেগুলোতে দুর্নীতির পাশাপাশি ব্যাপক মাত্রায় অর্থের অপচয় ঘটেছে।

“এই সরকারের গত দশ বছরে অর্থনৈতিক নীতিমালার ফলাফল এই পরিস্থিতি,” সম্প্রতি বেনারকে বলেন আলী রিয়াজ।

আলী রিয়াজসহ অন্যান্য বিশ্লেষকদের মতে, হাসিনা সরকারের আমলে দমন পীড়নের মাধ্যমে সিভিল সোসাইটিসহ সরকার-সমালোচকদের মুখ বন্ধ করে দেয়া হয়েছে, ফলে জবাবদিহিতার অভাবে অব্যবস্থাপনাও পৌঁছেছে চূড়ান্তে।

দমন-পীড়নের হাতিয়ার হিসেবে বিশ্লেষকরা সকলেই বাংলাদেশের ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের কথা উল্লেখ করেছেন। এই আইনটিকে জাতিসংঘ, যুক্তরাষ্ট্রসহ বিভিন্ন দেশ ও মানবাধিকার সংগঠন ‘অগণতান্ত্রিক’ বলে সমালোচনা করেছে।

সোমবারের বিক্ষোভকারীদের কারো কারো হাতে থাকা ব্যানারে লেখা ছিল “স্বৈরাচারী শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ।”

মো. মনিরুল ইসলাম নামে একজনের ফেসবুকে পোস্ট করা ভিডিওতে দেখা যায়, সোমবারের বিক্ষোভকারীদের অনেকেই “শেখ হাসিনা- ভোট চোর” বলে শ্লোগান দিচ্ছিলেন।

ব্যাপক ধরপাকড় ও অবরোধের মধ্যেও গত বছর বিরোধীদল বিএনপি বাংলাদেশে অনেকগুলো সফল ও বিশাল গণজমায়েত করেছে। নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে আন্দোলনরত বিএনপি ঘোষণা দিয়েছে, এই সরকারের অধীনে আসন্ন সংসদ নির্বাচনে অংশগ্রহণ করবে না।

তবে সরকারের মতে, ২০১১ সালে সংবিধান থেকে বাদ পড়া তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থার ফিরে আসার কোনো সুযোগ নেই।

শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ বর্তমানে টানা তৃতীয় মেয়াদে বাংলাদেশের ক্ষমতায় রয়েছে। এর মধ্যে ২০১৪ সালে বিএনপি নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেনি, ২০১৮ সালের নির্বাচন আন্তর্জাতিকভাবে ব্যাপক সমালোচনার মুখে পড়ে।

SR--0575-01.jpeg
সাভারে কর্মরত প্রথম আলোর সাংবাদিক শামসুজ্জামানের মুক্তির দাবিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজু ভাস্কর্যের পাদদেশে মুখে কালো কাপড় বেঁধে বামপন্থী বিভিন্ন ছাত্র সংগঠনের প্রতিবাদ কর্মসূচি। ২৯ মার্চ ২০২৩। [বেনারনিউজ]

গণমাধ্যমের স্বাধীনতা সূচকে পিছিয়েছে বাংলাদেশ

গণমাধ্যমের স্বাধীনতার বৈশ্বিক সূচকে গত বছরের তুলনায় বাংলাদেশের অবস্থানের এক ধাপ অবনতি হয়েছে।

বিশ্ব মুক্ত গণমাধ্যম দিবসে বুধবার রিপোর্টার্স উইদাউট বর্ডারস (আরএসএফ) ২০২৩ সালের ১৮০টি দেশ ও অঞ্চলের এই সূচক প্রকাশ করেছে।

প্রকাশিত সূচকে দেখা যাচ্ছে, ৩৫ দশমিক ৩১ স্কোর নিয়ে বাংলাদেশের অবস্থান ১৬৩তম। ২০২২ সালে ৩৬ দশমিক ৬৩ স্কোর নিয়ে সূচকে বাংলাদেশের অবস্থান ছিল ১৬২তম।

বৈশ্বিক সূচকে বাংলাদেশের গণমাধ্যমের অবস্থান ক্রমান্বয়ে পিছিয়ে যাওয়াটা “খুবই হতাশার ব্যাপার” বলে বুধবার বেনারের কাছে মন্তব্য করেন ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান।

তিনি বলেন, “বাংলাদেশের এই বিব্রতকর অবস্থানের জন্য ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনসহ নানা নিপীড়নমূলক আইন ও এসবের যথেচ্ছ ব্যবহার দায়ী। এসব আইন বাতিল করার কোনো বিকল্প নেই।”

আন্তর্জাতিক ছয় সংগঠনের আহ্বান

বিশ্ব মুক্ত গণমাধ্যম দিবস উপলক্ষে এক বিবৃতিতে সাংবাদিক এবং সরকারি নীতি ও অনুশীলনের স্বাধীন সমালোচকদের ওপর ক্রমবর্ধমান আক্রমণকে উদ্বেগজনক হিসেবে উল্লেখ করে ক্র্যাকডাউন বন্ধের আহ্বান জানিয়েছে ছয়টি আন্তর্জাতিক অধিকার সংগঠন।

সংগঠনগুলোর মধ্যে রয়েছে—অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল, হিউম্যান রাইটস ওয়াচ (এইচআরডব্লিউ), কমিটি টু প্রটেক্ট জার্নালিস্টস (সিপিজে), রিপোর্টার্স উইদাউট বর্ডারস, ইন্টারন্যাশনাল ফেডারেশন ফর হিউম্যান রাইটস, ওয়ার্ল্ড অ্যালায়েন্স ফর সিটিজেন পার্টিসিপেশন।

বাংলাদেশে সাংবাদিকরা ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের কারণে প্রবল ঝুঁকিতে রয়েছে জানিয়ে এই আইনটি বাতিলের দাবি জানিয়েছে সংগঠনগুলো।

এতে বলা হয়, “সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে সব ধরনের সহিংসতার দ্রুত, নিরপেক্ষ, স্বচ্ছ ও কার্যকর তদন্ত করে সন্দেহভাজন ব্যক্তিকে ন্যায়বিচারের মাধ্যমে জবাবদিহির আওতায় আনতে হবে।”

শুধু মত প্রকাশের স্বাধীনতার অধিকার প্রয়োগের কারণে যাদের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে, এমন সব অভিযোগ প্রত্যাহার করে নিতে হবে, দাবি এই সংগঠনগুলোর।

বিবৃতিতে আরো বলা হয়, মতপ্রকাশের স্বাধীনতার অধিকার খর্ব করে, এমন আইনের অপব্যবহার বন্ধ করতে হবে।

পাশাপাশি, গণমাধ্যমের স্বাধীনতা রক্ষার মাধ্যমে গণতন্ত্র এবং মানবাধিকার রক্ষার মূল্যবোধকে সম্মিলিতভাবে সমুন্নত রাখতে হবে বলে মন্তব্য করেছে বাংলাদেশস্থ ১৪ দেশের মিডিয়া ফ্রিডম কোয়ালিশন (এমএফসি)।

৩ মে বিশ্ব মুক্ত গণমাধ্যম দিবস উপলক্ষে এমএফসি’র সদস্য দেশগুলোর বাংলাদেশ দূতাবাস ও হাইকমিশন বুধবার এক যৌথ বিবৃতিতে একথা বলেছে।

“সাংবাদিকদের অবশ্যই হয়রানি, ভীতি বা সহিংসতার ভয় ছাড়াই বিভিন্ন বিষয় নিয়ে কাজ করার পরিবেশ নিশ্চিত করতে করতে হবে । এটি সুশাসনকে সহায়তা করা ও জনসাধারণ কে কোন একটি বিষয় সম্পর্কে পুরোপুরিভাবে অবহিত করা নিশ্চিত করার জন্য প্রয়োজনীয়,” বলা হয় বিবৃতিতে।

সরকার ‘গণমাধ্যমের স্বাধীনতায় বিশ্বাস করে

তথ্য ও সম্প্রচারমন্ত্রী হাছান মাহমুদ বলেছেন, বাংলাদেশে গণমাধ্যমের স্বাধীনতা ও বিস্তৃতি উন্নয়নশীল দেশের ক্ষেত্রে একটি উদাহরণ।

এদিকে “আমরা মুক্ত গণমাধ্যমে বিশ্বাস করি, গণমাধ্যমের স্বাধীনতায় বিশ্বাস করি,” বলে ঢাকায় এক অনুষ্ঠানে জানিয়েছেন তথ্য ও সম্প্রচারমন্ত্রী হাছান মাহমুদ।

অন্যদিকে ঢাকায় আয়োজিত পৃথক একটি অনুষ্ঠানে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বলেছেন, “ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন কোনো অবস্থাতেই বাতিল করা হবে না, তবে প্রয়োজনে কিছু সংশোধন করা যেতে পারে।”

তিনি আরো বলেন, ২০১৮ সালে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন প্রণয়নের পর “প্রথম দিকে কিছু অপব্যবহার যে হয়েছে, তা আমি ও আমার সরকার অস্বীকার করি না।”

“তবে এটাও সত্য যে এই অপব্যবহার এখন অনেকটাই কমে এসেছে,” বলেন আইনমন্ত্রী।

প্রতিবেদনে তথ্য দিয়ে সহায়তা করেছেন ঢাকা থেকে আহম্মদ ফয়েজ।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।