সংসদীয় কমিটির প্রতিবেদন: নির্বাচনী বছরে আদালতে সাজার হার বেড়েছে

অয়ন আমান
2024.05.03
ঢাকা
সংসদীয় কমিটির প্রতিবেদন: নির্বাচনী বছরে আদালতে সাজার  হার বেড়েছে ২০২৩ সালের ২৮ অক্টোবর বিএনপির মহাসমাবেশ কেন্দ্র করে সংঘর্ষ, পুলিশ হত্যা ও অগ্নিসংযোগের ঘটনায় আটক দলটির নেতা-কর্মীদের প্রিজন ভ্যানে করে ঢাকা মহানগর দায়রা জজ আদালতে নেয়া হচ্ছে। ২৯ অক্টোবর ২০২৩।
[সনি রামানী/বেনারনিউজ]

নির্বাচনী বছরে বাংলাদেশে সাজা দেবার হার ছয় শতাংশের বেশি বেড়েছে বলে দাবি করা হয়েছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির এক প্রতিবেদনে।

প্রতিবেদনের একটি কপি বেনারের হাতে রয়েছে, এতে দাবি করা হয় সাজার হার বাড়ায় দেশের আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রয়েছে।

তবে বিশ্লেষকদের মতে, গত দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনের আগে ‘গায়েবি মামলায়’ বিরোধী দলের নেতা-কর্মীদের তড়িঘড়ি করে সাজা দেওয়ায় এই হার বেড়েছে। এটা কোনোভাবেই ন্যায় বিচারের প্রতিফলন নয়।

গত রোববার জাতীয় সংসদ ভবনে অনুষ্ঠিত স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির বৈঠকে দেশের সার্বিক আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি তুলে ধরা হয়।

এতে বলা হয় বিচারাধীন মামলায় পলাতক আসামি গ্রেপ্তার এবং ধার্য তারিখে সাক্ষীদের আদালতে হাজিরা নিশ্চিত করার ফলে মামলায় সাজার হার পূর্বের তুলনায় বৃদ্ধি পেয়েছে, যা আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে ইতিবাচক ভূমিকা পালন করছে।

২০২৩ সালের মার্চ মাসে সাজার হার ছিল ২২ দশমিক ৯৫ শতাংশ, যা চলতি বছরের মার্চ মাসে ২৯ দশমিক ৪৫ শতাংশে উন্নীত হয়েছে।

সুশাসনের জন্য নাগরিক-সুজন সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার মনে করেন, এগুলোর অধিকাংশই গায়েবি মামলায় দেওয়া সাজা।

তিনি বেনারকে বলেন, “নির্বাচনের আগে বিরোধী দলের দেড় হাজার নেতা-কর্মীকে তড়িঘড়ি করে সাজা দেওয়া হয়েছিল। এগুলোর অধিকাংশই হলো গায়েবি মামলা।”

তাঁর মতে, “বিচার বিভাগ, আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও অন্যান্য প্রশাসনের সহযোগিতায় গায়েবি মামলায় দ্রুত রায় দিয়ে বিরোধী দলের নেতা-কর্মীদেরকে সাজা দেওয়া হয়েছে। এটা কোনোভাবেই ন্যায় বিচারের প্রতিফলন নয়।”

দেড় হাজারের বেশি মামলায় সাজা

বিএনপির জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী বেনারকে জানান, “এ পর্যন্ত সারা দেশ থেকে প্রাপ্ত দলীয় তথ্য অনুসারে, দেড় হাজারের বেশি মামলায় দলটির এক হাজার ১০০ নেতা-কর্মীর বেশি সাজাপ্রাপ্ত হয়েছেন।”

বিএনপি নেতা-কর্মীদের গ্রেপ্তার করে, মিথ্যা মামলায় সাজা দিয়ে সরকার আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের সফলতা দেখাতে চাচ্ছে বলে বেনারের সঙ্গে আলাপকালে মন্তব্য করেন দলটির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর।

তিনি বলেন, “সরকার ইচ্ছাকৃতভাবে নিজেদের ক্ষমতাকে কুক্ষিগত করা এবং দেশে একদলীয় শাসন ব্যবস্থা প্রবর্তন করার জন্য বিরোধী মতকে সম্পূর্ণ দমন করতে চায়। এই জন্য বিরোধী দলের ছোটখাটো নেতা থেকে শুরু করে সবাইকে তারা সাজানো-মিথ্যা মামলায় সাজা দিয়ে কারাগারে আটক করে রাখতে চায়। সরকারের মাস্টারপ্ল্যানের অংশ এটা।”

এটা কোনো রাজনৈতিক বিষয় নয় বলে বেনারকে জানিয়েছেন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি বেনজির আহমেদ।

তিনি বলেন, “এর সঙ্গে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কোনো সম্পর্ক নেই। সাক্ষী প্রমাণের মাধ্যমে সাজা হয়, সাজা হয় আদালতে।”

নিখোঁজের ১ বছর পর মামলা, ১০ বছর পর সাজা

২০২৩ সালের ২০ নভেম্বর গাড়িতে আগুন দেওয়ার অভিযোগে দায়ের মামলায় ঢাকার শাহীনবাগের বিএনপি নেতা সাজেদুল ইসলাম সুমনকে আড়াই বছরের কারাদণ্ড দিয়েছে ঢাকার চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট (সিএমএম) আদালত৷

“২০১৩ সালের ৪ ডিসেম্বর রাজধানীর বসুন্ধরা আবাসিক এলাকা থেকে আমার ভাইকে র‌্যাব তুলে নিয়ে যায়। যে মামলায় আমার ভাইকে সাজা দেওয়া হয়েছে, সেই মামলার অভিযোগপত্রে বলা হচ্ছে, ২০১৪ সালের সেপ্টেম্বর মাসের ঘটনা। এই মামলায় সাজা হয়েছে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে। যেখানে আমার ভাই ১০ বছর যাবত নিখোঁজ,” বেনারকে বলেন সুমনের বোন সানজিদা ইসলাম তুলি।

তিনি আরও বলেন, “আমার ভাই নিখোঁজ হওয়ার ঘটনা আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো তদন্ত করে যখন সরকারের কাছে জানতে চাচ্ছে—নিখোঁজ ব্যক্তিগুলো কোথায়? তখন সরকার সাজা দিচ্ছে।”

গত বছরের ২৩ নভেম্বর ঢাকা মহানগর উত্তর যুবদলের সাবেক সাধারণ সম্পাদক এস এম জাহাঙ্গীরকে একটি মামলায় আড়াই বছরের সশ্রম কারাদণ্ড দেন ঢাকার অতিরিক্ত চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট হাসিবুল হক।

ওই মামলার বিবরণীতে বলা হয়, ২০১৩ সালের ২৬ নভেম্বর বিএনপি নেতৃত্বাধীন জোটের ডাকা অবরোধ চলাকালে আসামিরা রাজধানীর উত্তরার আজমপুর রেলগেটের সামনে বোমা বিস্ফোরণ ঘটান, পুলিশকে লক্ষ্য করে ইটপাটকেল নিক্ষেপ করে কর্তব্য পালনে বাধা দেন, যানবাহন ভাঙচুর করে জনমনে আতঙ্ক সৃষ্টি করেন।

ওই দিন জাহাঙ্গীরসহ বিএনপির ৭৩ নেতা-কর্মীকে আসামি করে উত্তরা পূর্ব থানায় মামলা করে পুলিশ।

২০১৪ সালের ২০ এপ্রিল পুলিশ জাহাঙ্গীর হোসেনসহ ৭৭ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দেয়। বেনারের সঙ্গে আলাপকালে জাহাঙ্গীর দাবি করেন, ওই দিন ঘটনাস্থলে তিনি ছিলেন না। তিনি বলেন, “রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে আমার বিরুদ্ধে এই মামলা ও রায় দেওয়া হয়েছে, যাতে আমি ও আমার দলের নেতা-কর্মীরা চাপে থাকি।”

নিজ আইনজীবীর বরাত দিয়ে তিনি বলেন, “এই মামলায় ছয়জন সাক্ষী সাক্ষ্য দিয়েছেন। সাক্ষীদের কেউ আমার নাম বলেননি। আমার বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট কোনো অভিযোগ ছিল না। তারপরও সাজা দেওয়া হয়েছে।” 

‘আইনি প্রক্রিয়া অনুসরণ হয়নি’

বিএনপির আইন বিষয়ক সম্পাদক ব্যারিস্টার কায়সার কামাল বেনারকে বলেন, একতরফা নির্বাচন করার জন্য রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে দুই থেকে তিন মাসের মধ্যে বিএনপির এক হাজার ৬৬৮ জন নেতা-কর্মীকে সাজা দেওয়া হয়েছে।

তিনি বলেন, “এমনও মামলা আছে, যে মামলা ১০ বছর আগে দায়ের করা হয়েছিল। তার পরে ওই মামলার কোনো কার্যক্রম ছিল না। হঠাৎ তড়িঘড়ি করে ওই মামলায় রায় দেওয়া হয়েছে, বিএনপির নেতা-কর্মীদের সাজা দেওয়া হয়েছে।”

এসব মামলায় সাজা দেওয়ার ক্ষেত্রে আইনি প্রক্রিয়া যথাযথভাবে অনুসরণ করা হয়নি বলে দাবি করেন তিনি।

কায়সার বলেন, “দেখা গেছে, মামলায় ৪০ জন সাক্ষীর জায়গায় মাত্র ১০ জন সাক্ষী হাজির হয়েছেন। তাঁদের জবানবন্দি শুনে রায় দেওয়া হয়েছে। পুলিশ বাদী হয়ে যে মামলা করেছে, পুলিশ সেই মামলায় সাক্ষী দিয়েছে, সেই মামলায় রায় হয়েছে। 

“বিএনপি নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে যে মামলা ও রায়, তার কার্যক্রমের ধারাবাহিকতা অনুসরণ করলেই এটা পরিষ্কার বোঝা যায় যে, বিরোধী দল দমনে আইনের তোয়াক্কা না করেই এসব কার্যক্রম পরিচালনা করা হয়েছে,” যোগ করেন তিনি। 

বিরোধী দলের ওপর অন্যায়-অত্যাচার

যখনই যে দল ক্ষমতায় থাকে, বিরোধী দলের ওপর অন্যায়-অত্যাচার চালায় বলে মন্তব্য করেছেন মানবাধিকার সংস্থা আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) চেয়ারপারসন আইনজীবী জেড আই খান পান্না। 

তিনি বেনারকে বলেন, “বিএনপিও করেছে, এখন আওয়ামী লীগ করছে। তার আগে এরশাদ সরকার করেছে। সবার একই রূপ। কোনো সরকারের চরিত্রে পরিবর্তন হয়নি।” 

গত ৩০ এপ্রিল মঙ্গলবার এক প্রতিবেদনে মানবাধিকার সাংস্কৃতিক ফাউন্ডেশন বলেছে, “অনির্দিষ্ট ঘটনায় মামলা, হামলা ও গ্রেপ্তার মানবাধিকার লঙ্ঘনের সুস্পষ্ট উদাহরণ, যা সংবিধান ও মৌলিক অধিকারের লঙ্ঘন।” 

গণতান্ত্রিক রীতিনীতি ও আইনি পরিবেশ উন্নয়নে গণগ্রেপ্তার বন্ধ, পুরাতন মামলাগুলো প্রত্যাহার করার পাশাপাশি সব ধরনের সহিংসতা, বিশৃঙ্খলা ও ভীতিকর পরিবেশ বন্ধে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের ত্বরিত ও কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণের জন্য দাবি জানায় সংস্থাটি।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।