তিন সেনা কর্মকর্তা হত্যা: হুকুম দেওয়ার অভিযোগে প্রয়াত জিয়া ও তাহেরের বিরুদ্ধে মামলা

কামরান রেজা চৌধুরী
2023.05.11
ঢাকা
তিন সেনা কর্মকর্তা হত্যা: হুকুম দেওয়ার অভিযোগে প্রয়াত জিয়া ও তাহেরের বিরুদ্ধে মামলা ১৯৭৭ সালে বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা জেনারেল জিয়াউর রহমানের আমলে নিহত সশস্ত্র বাহিনীর সদস্যদের হত্যাকাণ্ডের বিচার চেয়ে ঢাকার গুলশানে ভুক্তভোগী পরিবারগুলোর মানববন্ধন। ১০ ডিসেম্বর ২০২১।
[সৌজন্যে: মায়ের কান্না]

চার যুগ আগে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর উচ্চপদস্থ তিন সামরিক কর্মকর্তা হত্যার বিচার চেয়ে মামলা দায়ের করা হয়েছে। মামলার বাদী নিহত সেনা কর্মকর্তা কর্নেল খন্দকার নাজমুল হুদা বীর বিক্রমের কন্যা ও সরকার দলীয় সংরক্ষিত আসনের সংসদ সদস্য নাহিদ ইজাহার খান।

মামলার এজাহারে ওই হত্যাকাণ্ডের হুকুমদাতা হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে বাংলাদেশের সাবেক রাষ্ট্রপতি ও প্রধান রাজনৈতিক দল বিএনপি’র প্রতিষ্ঠাতা প্রয়াত মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান এবং ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের বর্তমান রাজনৈতিক মিত্র জাসদের নেতা কর্নেল তাহেরের নাম।

বাংলাদেশ সময় বুধবার রাত সাড়ে দশটায় হত্যাকারী তৎকালীন মেজর মো. আব্দুল জলিলসহ সর্বোচ্চ ২৫ জন অজ্ঞাত আসামির বিরুদ্ধে মামলাটি দায়ের করা হয়।

শেরেবাংলা-নগর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা উৎপল বড়ুয়া দণ্ডবিধির ৩০২, ১০৯ এবং ৩৪ ধারায় মামলাটি রেকর্ড করেন।

ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সংরক্ষিত আসনের সংসদ সদস্য নাহিদ ইজাহার খান এর আগে জাতীয় সংসদে দেয়া বক্তৃতায় তাঁর বাবার হত্যাকারী হিসাবে জিয়াউর রহমানের মরণোত্তর বিচার দাবি করেছিলেন।

তবে বিএনপি এই হত্যাকাণ্ডে জিয়াউর রহমানে সংশ্লিষ্টতা নাকচ করে বলেছে জাতীয় নির্বাচন সামনে রেখে বিএনপির বিরুদ্ধে অপপ্রচার চালাতে এই মামলা দায়ের করা হয়েছে।

কী বলা হয়েছে এজাহারে?

মামলার এজাহারের কপি বেনারের হাতে এসেছে।

নাহিদ ইজাহার খান এজাহারে বলেন, তাঁর বাবা বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ৭২ ব্রিগেড কমান্ডার (রংপুর) কর্নেল খন্দকার নাজমুল হুদা বীর বিক্রম ১৯৭৫ সালের ৭ নভেম্বর ঢাকায় জাতীয় সংসদ ভবন প্রাঙ্গণে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর বিশৃঙ্খল সদস্যদের হাতে শহীদ হন। তাঁর সাথে মুক্তিযুদ্ধের দুই সেক্টর কমান্ডার মেজর জেনারেল খালেদ মোশারফ এবং লে. কর্নেল এ টি এম হায়দারও শহীদ হন।

এজাহারে নাহিদ বলেন, তৎকালীন সেনাবাহিনী প্রধান জিয়াউর রহমান এবং জাসদ নেতা লে. কর্নেল আবু তাহের (অব.) এর নির্দেশে দশম ইস্ট বেঙ্গল কর্মকর্তা মৃত মেজর মো. আসাদউজ্জামান এবং মেজর মো. আব্দুল জলিলসহ আরও ২০ থেকে ২৫ জন সামরিক কর্মকর্তা এবং সেনাসদস্যরা তাঁর বাবার সাথে খালেদ মোশারফ ও এ.টি.এম. হায়দারকে গুলি করে হত্যা করে। গুলি করার পর তাঁদের শরীরে বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে মৃত্যু নিশ্চিত করা হয়।

তিনি বলেন, কর্নেল খন্দকার নাজমুল হুদা বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে অংশ নিয়ে বিখ্যাত গরিবপুরের ট্যাঙ্ক যুদ্ধের নেতৃত্বে দেন।

মিথ্যা অভিযোগ: বিএনপি

বর্তমানে দেশে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী সরকার ক্ষমতায় আছে বলে ওই হত্যাকাণ্ডের বিচার চেয়ে মামলা করেছেন বলে জানান নাহিদ।

“আমার বাবা একজন মুক্তিযোদ্ধা, একজন সামরিক কর্মকর্তা। তিনি দেশের জন্য সম্পদ ছিলেন। তাঁকে বিনা অপরাধে হত্যা করা হয়েছে। কিন্তু আমরা বিচার পাইনি,” বৃহস্পতিবার বেনারকে বলেন সাংসদ নাহিদ।

“আমি মামলা করেছি। এখন মামলাটি তদন্ত হবে। তদন্তে জিয়াউর রহমানের নাম আসলে আসবে,” বলেন নাহিদ।

জিয়াউর রহমানসহ এই হত্যাকাণ্ডে অভিযুক্ত অনেক ব্যক্তি প্রয়াত হয়েছেন, এই অবস্থায় মামলা করে বিচার পাওয়া সম্ভব কি না-এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, “আমরা চাই দেশের মানুষ অন্তত জানুক কারা বিনা অপরাধে আমার বাবাকে হত্যা করেছে।”

তবে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরীর মতে আসন্ন সংসদ নির্বাচনের আগে জিয়াউর রহমানকে এই হত্যাকাণ্ডের জন্য দায়ী করে মামলা করা একটি ‘রাজনৈতিক খেলা’।

“এগুলো মিথ্যা অভিযোগ। মিথ্যা মামলা,” বেনারকে বলেন আমীর খসরু মাহমুদ।

এদিকে সাংসদ নাহিদের মামলায় যে মেজর জলিলের কথা বলা হয়েছে তিনি জাসদের প্রয়াত নেতা মেজর জলিল নন বলে বেনারকে জানান ১৯৭৫ সাল পরবর্তী সামরিক সরকারের আমলে সামরিক কর্মকর্তাদের ফাঁসি নিয়ে গবেষণা করা সাংবাদিক এবং “রক্ত পিচ্ছিল অন্ধকার” বইয়ের লেখক জায়েদুল আহসান পিন্টু।

তিনি বলেন, এই মেজর জলিল ঘটনার সময় ক্যাপ্টেন ছিলেন এবং তিনি বেঁচে আছেন। তিনি কর্নেল খন্দকার নাজমুল হুদাকে গুলি করেছিলেন বলে অভিযোগ আছে। মেজর জলিল এখন ব্যবসা-বাণিজ্য করেন এবং তিনি শারীরিকভাবে ভালো আছেন।

“তৎকালীন দেশের অবস্থা এবং বিভিন্ন সারকামট্যানশিয়াল এভিডেন্স বিশ্লেষণ করে আমার কাছে মনে হয়েছে, জিয়াউর রহমানের অনুমোদন ছাড়া এই হত্যাকাণ্ড হতে পারে না,” বলেন পিন্টু।

তাঁর মতে, এই মামলা তদন্ত করতে তদন্তকারীকে বেশ চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে হবে। কারণ হলো, হত্যাকাণ্ডের অন্য অভিযুক্ত  মেজর আসাদ মারা গেছেন। যাঁরা চাক্ষুষ সাক্ষী ছিলেন তাঁদেরও বেশিরভাগ মারা গেছেন।

সেনাবাহিনীর কিছু সদস্যের হাতে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সপরিবারে নিহত হওয়ার পর সামরিক বাহিনীর সহায়তায় ক্ষমতায় আসেন আওয়ামী লীগের আরেক নেতা খন্দকার মোশতাক আহমেদ। খন্দকার মোশতাক সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করেন খালেদ মোশারফ।

একই বছর ৭ নভেম্বর এক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতায় আসেন মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান। বিএনপি এটিকে বিপ্লব ও সংহতি দিবস বলে পালন করে এবং দলটির মনে করে সিপাহী-জনতার বিপ্লবের মাধ্যমে জিয়াউর রহমানকে ক্ষমতায় বসানো হয়।

অপরপক্ষে আওয়ামী এই দিনকে সেনা কর্মকর্তা হত্যা দিবস হিসেবে পালন করে থাকে।

জিয়াউর রহমান ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হওয়ার পর অনেক সামরিক কর্মকর্তাকে বিনা বিচারে হত্যা করা হয়।

ওই সকল নিহত সামরিক কর্মকর্তার পরিবারের সদস্যরা প্রায়ই মানববন্ধন করে জিয়াউর রহমানসহ জড়িতদের বিচারের দাবি করে আসছেন।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।