সরকার পতনে বিএনপির এক দফা, শেখ হাসিনার অধীনেই ভোট চায় আ.লীগ
2023.07.12
ঢাকা

নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে আগামী সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য জাতীয় সংসদ বিলুপ্ত করার এক দফা দাবিতে ঢাকায় বিশাল জনসভা করেছে প্রধান বিরোধী দল বিএনপি।
বুধবার নয়াপল্টনে দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনের এই এক দফার আন্দোলন কর্মসূচি ঘোষণা করেন বিএনপি’র মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, যিনি দলীয় চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়া ও ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের অনুপস্থিতিতে দীর্ঘদিন থেকে দলটির নেতৃত্ব দিয়ে আসছেন।
ঢাকার নয়াপল্টন ও পার্শ্ববর্তী সড়কগুলোতে বিএনপি যখন সরকারের পদত্যাগের দাবিতে একদফা আন্দোলন করছিল, তখন প্রায় দেড় কিলোমিটার দূরে জাতীয় মসজিদ বায়তুল মোকাররমের দক্ষিণ গেট এলাকায় হাজার হাজার লোকের সমাগম ঘটিয়ে ‘শান্তি সমাবেশ’ করেছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ।
আওয়ামী লীগের ঢাকা মহানগর দক্ষিণ সভাপতি আবু আহমদ মান্নাফি দাবি করেছেন, তাঁদের সমাবেশে উপস্থিত ছিল লক্ষাধিক মানুষ।
অপরদিকে বিএনপির পক্ষ থেকে সমাবেশের সভাপতি ঢাকা মহানগর উত্তর বিএনপির আহ্বায়ক আমান উল্লাহ আমান দাবি করেছেন, সমাবেশে কয়েক লাখ মানুষ অংশ নিয়েছে।
ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) মুখপাত্র ফারুক হোসেন বেনারকে বলেছেন, বিপুল সংখ্যক মানুষের অংশগ্রহণে পাল্টাপাল্টি সমাবেশ হলেও কোনো অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটেনি। বৃষ্টির কারণে কোনো সমাবেশেই প্রত্যাশিত সংখ্যক মানুষের জমায়েত ঘটেনি।
নিজেদের এক দফা দাবি সম্পর্কে ফখরুল বলেন, “বাংলাদেশের জনগণের ভোটাধিকার হরণ করা বর্তমান কর্তৃত্ববাদী সরকারের পদত্যাগ ও বিদ্যমান অবৈধ সংসদের বিলুপ্তি, নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষ সরকার গঠন, নির্বাচনকালীন নির্বাচন কমিশন পুনর্গঠন করে তাদের অধীনে নিরপেক্ষ ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের ব্যবস্থা করতে হবে।”
“এ ছাড়া বিএনপির চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়াসহ সব রাজবন্দির মুক্তি, মিথ্যা-গায়েবি মামলা প্রত্যাহার, তারেক রহমানের মামলাসহ ফরমায়েশি সাজা বাতিল করতে হবে,” যোগ করেন তিনি।
ফখরুল বলেন, “এই সমাবেশ থেকে সংবিধান ও রাষ্ট্রব্যবস্থার গণতান্ত্রিক সংস্কারের মাধ্যমে জনগণের অর্থনৈতিক মুক্তি, ভোটাধিকার ও গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠার এক দফা দাবিতে রাজপথে সক্রিয় বিরোধী রাজনৈতিক দল ও জোটগুলো যুগপৎ ধারায় ঐক্যবদ্ধ বৃহত্তর গণ-আন্দোলন গড়ে তোলা ও তা সফল করার ঘোষণা প্রদান করছি।”
এক দফা ঘোষণা করে ফখরুল দুই দিনের নতুন কর্মসূচির ঘোষণা দেন। দলটি যুগপৎ আন্দোলনের অন্যান্য শরিকদের নিয়ে আগামী ১৮ ও ১৯ জুলাই ঢাকা মহানগরসহ দেশের সব মহানগর ও জেলায় পদযাত্রা করবে।
যুগপৎ ধারায় বৃহত্তর গণ-আন্দোলনের এক দফার ঘোষণা “৩৬টি রাজনৈতিক দল ও জোটের” সিদ্ধান্ত জানিয়ে ফখরুল বলেন, “যারা এই সরকারের অন্যায়ের বিরুদ্ধে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের কথা বলছেন, সংগ্রাম-লড়াই করছেন—তাদেরও আহ্বান জানাচ্ছি, আসুন একসঙ্গে সমবেত হয়ে উত্তাল আন্দোলন গড়ে তুলি।”
এক দফার ঘোষণাকে ঐতিহাসিক আখ্যা দিয়ে ফখরুল বলেন, এই ঘোষণা জাতিকে মুক্ত করার ঐতিহাসিক আহ্বান।

আওয়ামী লীগের একদফা, শেখ হাসিনার নেতৃত্বে নির্বাচন: কাদের
বিএনপির সরকার পতনের এক দফার বিপরীতে নিজ দলেরও এক দফা রয়েছে জানিয়ে দলীয় ‘শান্তি সমাবেশ’ থেকে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেছেন, “আমাদেরও দফা একটা—শেখ হাসিনা ছাড়া নির্বাচন নয়, তাঁর নেতৃত্বেই নির্বাচন। সেখানে জনগণ যাকে ইচ্ছে ভোট দেবে।”
বিএনপি নির্বাচন হেরে যাবে জেনেই আন্দোলনের নামে জাতিকে বিভ্রান্ত করছে বরে দাবি করেন কাদের।
আওয়ামী লীগ কারো কর্মসূচিতে বাধা দেবে না জানিয়ে তিনি আরো বলেন, “অবাধ সুষ্ঠু নির্বাচনে বাধা দিতে আসলে প্রতিহত করব। কোনো অপশক্তির সঙ্গে আপস করব না। যাদের হাতে রক্তের দাগ, তাদের সঙ্গে আপস বা সংলাপ নয়।”
সমাবেশে যোগ দিতে বাধা দেয়ার অভিযোগ
বিএনপি নেতারা অভিযোগ করেছেন, পুলিশ তাদের কর্মীদের সমাবেশে যোগ দিতে আসার সময় বিভিন্ন স্থানে বাধা দিয়েছে এবং তাদের ফোন চেক করেছে।
ফখরুল বলেন, সাভার, আমিনবাজার ও যাত্রাবাড়ীসহ বিভিন্ন এলাকায় নেতাকর্মীদের বাধা দেয়া হয়েছে।
পুলিশ বিএনপির এই দাবি অস্বীকার করেছে।
ডিএমপি কর্মকর্তা ফারুক বলেন, কোথাও বাধা দেওয়া হয়নি। কোথাও কোথাও নিরাপত্তার স্বার্থে নিয়মিত তল্লাশি করা হয়েছে। তবে কাউকে আটক করা হয়নি।
সমাবেশ চলাকালে ঢাকার সংশ্লিষ্ট এলাকাগুলোতে মোবাইল নেটওয়ার্ক দুর্বল এবং ইন্টারনেটের গতি কম থাকার অভিযোগ ওঠে। এর জবাবে গণমাধ্যমকে বিটিআরসি বলেছে, কারিগরি ত্রুটির কারণে এমনটি হতে পারে।
সরকার ও বিরোধীদের সমাবেশ উপলক্ষে যানজটে ঢাকার জনজীবন অনেকটাই স্থবির হয়ে পড়ে।
অন্যদের যুগপৎ কর্মসূচি
ঢাকায় আলাদা সংবাদ সম্মেলন ও অন্যান্য কর্মসূচির মাধ্যমে সরকার পতনে এক দফা কর্মসূচি ঘোষণা করেছে বিএনপির সঙ্গে আন্দোলনে থাকা অন্যান্য রাজনৈতিক দল ও জোটগুলো।
বিএনপির নয়াপল্টনে সমাবেশ থেকে ঘোষণা করার আগে পরে কর্মসূচি ঘোষণা করেছে গণতন্ত্র মঞ্চ, ১২ দলীয় জোট, জাতীয়তাবাদী সমমনা জোট, লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টি (এলডিপি), গণফোরাম, গণ অধিকার পরিষদ, গণতান্ত্রিক বাম ঐক্য, বাংলাদেশ লেবার পার্টি, সমমনা গণতান্ত্রিক পেশাজীবী জোট এবং বাংলাদেশ সাধারণ ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদ।
ঢাকায় বিদেশি কূটনীতিকেরা
আওয়ামী লীগ ও বিএনপিসহ রাজনৈতিক দলগুলো এমন সময়ে রাজপথে শোডাউন করল যখন ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দুটি প্রতিনিধিদল অবাধ ও সুষ্ঠু সাধারণ নির্বাচন, গণতন্ত্র এবং মানবাধিকারসহ বিভিন্ন বিষয়ে অংশীজনদের সঙ্গে আলোচনা করতে ঢাকায় অবস্থান করছে।
ছয় সদস্যের ইইউ প্রতিনিধি দল দুই সপ্তাহের সফরে ঢাকায় এসেছে রোববার এবং যুক্তরাষ্ট্রের বেসামরিক নিরাপত্তা, গণতন্ত্র ও মানবাধিকার বিষয়ক আন্ডার সেক্রেটারি উজরা জেয়া, দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়া বিষয়ক সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডোনাল্ড লুসহ প্রতিনিধিদল চার দিনের সফরে ঢাকায় এসেছে মঙ্গলবার।
গত ২৪ মে বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক নির্বাচন প্রক্রিয়াকে ক্ষুণ্ণ করার জন্য দায়ী বা জড়িত বলে মনে করা যে কোনও বাংলাদেশি ব্যক্তির জন্য ভিসা প্রদান না করার ঘোষণা দেয় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করছেন, বহির্বিশ্বের চাপ বাংলাদেশের রাজনৈতিক অচলাবস্থা কাটানোর ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে।
সুশাসনের জন্য নাগরিক সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার বেনারকে বলেন, গত বছরের ১০ ডিসেম্বর ঢাকায় একইস্থানে সমাবেশ করার অনুমতি না পাওয়া বিএনপি এবার যতটা সহজভাবে সমাবেশের সুযোগ পেলো, তাতে পরিষ্কার যে বিদেশি চাপ ইতিবাচক ভূমিকা রাখছে।
রাজনীতিতে চলমান সংকট নিরসনের জন্য রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে সংলাপ প্রয়োজন বলেও মনে করেন তিনি।
“রাজনীতি একটি প্রক্রিয়া। আলোচনা, মত বিনিময় ও সংলাপকে সমস্যা সমাধানের পথ হিসেবে দেখতে হবে রাজনৈতিক দলগুলোকে,” বলেন তিনি।
চলতি বছরের ডিসেম্বর বা আগামী বছরের জানুয়ারিতে পরবর্তী সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবার কথা রয়েছে। বয়কট ও ভোট জালিয়াতির অভিযোগে গত দুটি জাতীয় নির্বাচন নিয়ে দেশে-বিদেশে ব্যাপক সমালোচনা রয়েছে। এই দুই নির্বাচনে আওয়ামী লীগ নিরঙ্কুশ জয় পেয়েছিল। আগামী সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ হবে বলে সরকারপ্রধান বারবার আশ্বাস দিলেও তাতে আস্থা দেখাচ্ছে না বিএনপিসহ বিরোধী দলগুলো।