একদফা আন্দোলনের প্রথম দিনই বিএনপির এক কর্মী নিহত, আহত দুই শতাধিক
2023.07.18
ঢাকা
ঢাকাসহ বিভিন্ন জেলায় সংঘাত ও সহিংসতার মধ্য দিয়ে পার হয়েছে বাংলাদেশে সরকার পতনে বিরোধীদের একদফা দাবিতে ঘোষিত দুই দিনব্যাপী পদযাত্রা কর্মসূচির প্রথম দিন।
মঙ্গলবার লক্ষ্মীপুরে বিরোধী দলীয় একজন কর্মী নিহত ও বিভিন্ন জেলায় অন্তত দুই শতাধিক নেতা-কর্মী আহত হয়েছেন বলে পু্লিশ ও দলীয় সূত্র নিশ্চিত করেছে।
বিরোধী দলগুলোর অভিযোগ, সরকারের পদত্যাগ ও নির্বাচনকালীন দল নিরপেক্ষ সরকারের দাবিতে বিএনপি ও সমমনা দলগুলোর কর্মসূচির প্রথমে দিনে পাল্টা কর্মসূচি দেয় ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। এতে বিভিন্ন জেলায় সংঘাতের সৃষ্টি হয়। এছাড়া পুলিশি হামলার মুখেও পড়েন বিরোধী নেতা-কর্মীরা।
এদিন লক্ষ্মীপুরে বিএনপির পদযাত্রায় আওয়ামী লীগ ও পুলিশের হামলায় চন্দ্রগঞ্জ থানা কৃষক দলের সদস্য সজীব হোসেন (২৫) নিহত হন। গুরুতর আহত হয়েছেন আরও কয়েকজন।
তথ্যের সত্যতা নিশ্চিত করে লক্ষ্মীপুর মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মোসলেহ উদ্দিন বেনারকে বলেন, “দুই পক্ষের কর্মসূচি ছিল। আওয়ামী লীগ ও বিএনপির কর্মীরা হঠাৎ করে সংঘর্ষে জড়ায়।”
শহরের সামাদ একাডেমির মোড়ে সংঘর্ষ হয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, “ঘটনাস্থল থেকে পুলিশ একজনের মৃতদেহ উদ্ধার করে হাসপাতালে পাঠিয়েছে। তবে নিহতের রাজনৈতিক পরিচয় তাৎক্ষণিকভাবে জানা যায়নি।”
বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতা ও লক্ষ্মীপুর সদর এলাকার সাবেক সংসদ সদস্য শহিদ উদ্দিন চৌধুরী এ্যানি বেনারকে বলেন, “ছাত্রলীগ ও পুলিশের হামলায় কৃষক দলের কর্মী সজীবসহ শতাধিক নেতা-কর্মী আহত হয়েছেন। পরবর্তীতে সজিবের মৃত্যু হয়। গুরুতর আহত আরও কয়েকজন হাসপাতালে চিকিৎসাধীন।”
অভিযোগ অস্বীকার করে লক্ষ্মীপুর পৌর আওয়ামী লীগের সভাপতি সৈয়দ আহমেদ পাটওয়ারী বেনারকে বলেন, “এই অভিযোগ মোটেও সত্য নয়। আমাদের নেতা-কর্মীরা কাউকে আঘাত করেনি। বিএনপি কর্মী কীভাবে মারা গেছে সেটা আমাদের জানা নেই।”
তত্ত্বাবধায়ক হবে না: ওবায়দুল কাদের
লক্ষ্মীপুরের এই সংঘর্ষ ছাড়াও ঢাকা, কিশোরগঞ্জ, খাগড়াছড়ি, বগুড়া, পিরোজপুর, ফেনী ও জয়পুরহাটে নেতা-কর্মীরা পুলিশ ও ক্ষমতাসীনদের হামলার শিকার হয়েছেন বলে অভিযোগ করেছে বিএনপি।
পুলিশ ও বিএনপি নেতা-কর্মীদের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, এই জেলাগুলোতে দুই শতাধিক বিরোধী নেতা-কর্মী, ৩০ এর বেশি পুলিশ সদস্য ও ক্ষমতাসীন দলের বেশ কয়েকজন কর্মী আহত হয়েছেন।
বিএনপি দাবি, পুলিশ ও আওয়ামী লীগের হামলায় তাদের সহস্রাধিক নেতা-কর্মী আহত হয়েছেন।
এদিকে আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক বাহাউদ্দিন নাছিম বেনারকে বলেন, “সারা দেশে বিএনপির হামলায় আওয়ামী লীগের ‘বেশ কিছু’ নেতা-কর্মী আহত হয়েছে। এই সংখ্যা কত হবে তা জানার চেষ্টা করা হচ্ছে।”
তিনি আরও বলেন, “বিএনপির পদযাত্রা এবং আওয়ামী লীগের শান্তি ও উন্নয়ন শোভাযাত্রার পথ ছিল আলাদা। এমন সহিংসতার কথা আমরা কল্পনাও করিনি। এটা খুবই অপ্রত্যাশিত। যারা নির্বাচন বানচাল করতে চায় তারাই দেশকে সংঘাতময় পরিস্থিতির দিকে ঠেলে দিচ্ছে।”
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী বেনারকে বলেন, “সারা দেশে কয়েক লাখ লোক রাস্তায় নেমে এসেছিল। এই বিপুল সংখ্যক মানুষের পদযাত্রায় ভীত হয়ে ক্ষমতাসীনরা পুলিশকে সঙ্গে নিয়ে দেশজুড়ে বিএনপির ওপর হামলা চালিয়েছে।”
বিএনপির পদযাত্রার দিন আওয়ামী লীগ যে শান্তি ও উন্নয়ন শোভাযাত্রা করেছে—তাতেও লাখো লোকের সমাগম ঘটেছে বলে দাবি করেন এই আওয়ামী লীগ নেতা নাছিম।
দলটির ঢাকার শোভাযাত্রার শুরুতে প্রধান অতিথির বক্তব্যে দলটির সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেছেন, “বিএনপি যতই বিষোদগার আর মিথ্যাচার করুক না কেন, কোনো লাভ হবে না। আমরা ইউরোপীয় ইউনিয়নকে বলেছি, আমরা নির্বাচনের আগে ও পরে শান্তি চাই। তত্ত্বাবধায়ক হবে না।”
বিরোধীদের মামলা দ্রুত করার উদ্যোগ
বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো যখন সরকারের পদত্যাগের দাবিতে রাজপথে সক্রিয় তখন বিএনপি-জামায়াতসহ সমমনা দলগুলোর নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে থাকা পুরোনো মামলার তদন্ত তরান্বিত করার উদ্যোগ নিয়েছে পুলিশ; অভিযোগ বিরোধীদের।
সূত্র জানিয়েছে, গত ৬ জুলাই পুলিশের একজন উপমহাপরিদর্শক ঢাকায় অন্যান্য ঊর্ধ্বতন পুলিশ কর্মকর্তাদের সঙ্গে একটি বৈঠক করেন। সেখানে বিএনপি ও জামায়াত নেতা-কর্মীদের মামলার তথ্য সংগ্রহের সিদ্ধান্ত হয়।
উল্লেখ্য, ২০১৩ সাল থেকে সরকারবিরোধী আন্দোলনের ফলে এই দলগুলোর সদস্যরা অগ্নি সংযোগ, পুলিশের ওপর সহিংস হামলাসহ বিভিন্ন নাশকতামূলক কার্যকলাপ এবং অন্যান্য গুরুতর অপরাধের অভিযোগে বিপুল সংখ্যক মামলা মোকাবিলা করছে।
পুলিশ সদর দপ্তরে অনুষ্ঠিত ওই বৈঠকের কার্যবিবরণীর একটি অনুলিপি বেনারের কাছে রয়েছে।
ওই বৈঠকে পুরোনো এসব মামলা দ্রুততম সময়ে শেষ করার নির্দেশনা রয়েছে।
এই প্রসঙ্গে বিএনপি নেতা আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী বলেন, “সরকার বিএনপি নেতাদের আগামী নির্বাচনে অযোগ্য করার জন্য নানা প্রচেষ্টা চালাচ্ছে। পুরোনো মামলায় সাজা দিয়ে আমাদেরকে নির্বাচনে অযোগ্য করে নিজেদের জন্য মাঠ ফাঁকা করতে চায়।”
হিরো আলমের ওপর হামলার ঘটনায় উদ্বেগ
ঢাকা-১৭ আসনের উপনির্বাচনে স্বতন্ত্র প্রার্থী মো. আশরাফুল হোসেন আলম ওরফে হিরো আলমের ওপর হামলার ঘটনায় মঙ্গলবার রাজধানীর বনানী থানায় তাঁর ব্যক্তিগত সহকারী মো. সুজন রহমান শুভ বাদী হয়ে অজ্ঞাতনামা ১৫-২০ জনকে আসামি করে একটি হত্যাচেষ্টা মামলা দায়ের করেছেন।
হিরো আলমের ওপর হামলার ঘটনায় সাত জনকে আটক করেছে ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) গোয়েন্দা শাখা (ডিবি)। তাদের দু’জনকে রিমান্ডে এনে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য আদালতের অনুমতি পাওয়া গেছে বলে গণমাধ্যমকে জানিয়েছেন ডিএমপির অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার (ডিবি) মোহাম্মদ হারুন অর রশীদ।
ইসির উপসচিব আতিয়ার রহমান জানিয়েছেন, এই ঘটনায় পুলিশ কমিশনারকে আইনি পদক্ষেপ নিতে নির্বাচন কমিশন (ইসি) থেকে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।
হিরো আলমের ওপর হামলার ঘটনায় উদ্বেগ জানিয়েছে জাতিসংঘের আবাসিক প্রতিনিধি ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র।
মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের প্রেস ব্রিফিংয়ে সোমবার হিরো আলমের ওপর হামলার বিষয়টি নিয়ে প্রশ্ন করেন একজন সাংবাদিক। প্রশ্নের জবাবে মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের মুখপাত্র ম্যাথু মিলার বলেন, “গণতান্ত্রিক নির্বাচনে এ ধরনের রাজনৈতিক সহিংসতার কোনো স্থান নেই। আমরা বাংলাদেশ সরকারকে সহিংসতার যে কোনো ঘটনা যথাযথভাবে, স্বচ্ছতার সঙ্গে নিরপেক্ষভাবে তদন্ত করতে উৎসাহিত করি। যারা এই হামলার সঙ্গে জড়িত, তাঁদের বিচারের আওতায় আনতে বলি।”
মঙ্গলবার এক টুইট বার্তায় হিরো আলমের ওপর হামলার ঘটনায় উদ্বেগ জানিয়েছেন বাংলাদেশে জাতিসংঘের আবাসিক সমন্বয়ক গোয়েন লুইস।
তিনি বলেন, বাংলাদেশে অবস্থিত জাতিসংঘের দপ্তর ঢাকা-১৭ নির্বাচনে হিরো আলমের ওপর হামলার ঘটনায় উদ্বিগ্ন। কোনো ধরনের সহিংসতা ছাড়াই নির্বাচনে অংশ নেওয়া প্রত্যেক নাগরিকের মৌলিক অধিকার, যার সুরক্ষা ও নিশ্চয়তা দেওয়া উচিত।