মহাসমাবেশকে ঘিরে বিরোধী নেতা-কর্মীদের গণহারে গ্রেপ্তার

আহম্মদ ফয়েজ
2023.07.27
ঢাকা
মহাসমাবেশকে ঘিরে বিরোধী নেতা-কর্মীদের গণহারে গ্রেপ্তার ঢাকা মহানগর ও জেলার বিভিন্ন থানায় আটক বিএনপির কয়েক শত নেতাকর্মীকে বৃহস্পতিবার কারাগারে পাঠিয়েছে ঢাকার চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট ও চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালত। আদালত প্রাঙ্গণ থেকে প্রিজন ভ্যানে করে তাঁদের কয়েকজনকে নিয়ে যাবার সময় ভ্যানের বাইরে স্বজনদের ভিড়। ২৭ জুলাই ২০২৩।
[বেনারনিউজ]

সরকার পতনের একদফা দাবিতে ঢাকায় শুক্রবারের মহাসমাবেশের আগে নেতা-কর্মীদের গণহারে গ্রেপ্তারের অভিযোগ তুলেছে বাংলাদেশে সংসদের বাইরে প্রধান বিরোধী দল বিএনপি।

বৃহস্পতিবার ঢাকায় দলের প্রধান কার্যালয়ে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে বিএনপির জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী অভিযোগ করেন, মহাসমাবেশ সামনে রেখে গত এক দিনে ঢাকায় বিভিন্ন হোটেল ও বাসা-বাড়িতে তল্লাশি চালিয়ে পুলিশ পাঁচ শতাধিক নেতা-কর্মীকে গ্রেপ্তার করেছে।

“গত ২৪ ঘণ্টায় আমাদের পাঁচ শতাধিক নেতা-কর্মীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। আমি গ্রেপ্তারকৃত সব নেতৃবৃন্দের নিঃশর্ত মুক্তি দাবি করছি,” সংবাদ সম্মেলনে বলেন রিজভী।

বিএনপির ঢাকা মহাসমাবেশ হওয়ার কথা ছিল বৃহস্পতিবার। মহানগর পুলিশের কাছে নয়াপল্টন অথবা সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে সমাবেশ করার অনুমতি চেয়েছিল দলটি। অন্যদিকে আওয়ামী লীগের তিনটি সংগঠন—যুবলীগ, স্বেচ্ছাসেবক লীগ ও ছাত্রলীগ বৃহস্পতিবার বায়তুল মোকাররমের দক্ষিণ গেটে শান্তি সমাবেশ করার ঘোষণা দিয়েছিল।

বৃহস্পতিবার কর্মদিবস হওয়ায় ঢাকা মহানগর পুলিশ কোনো দলকেই তাদের প্রস্তাবিত স্থানে কর্মসূচি পালনের অনুমতি না দিয়ে বিএনপিকে রাজধানীর গোলাপবাগ মাঠ ও আওয়ামী লীগকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের খেলার মাঠ অথবা পুরোনো বাণিজ্য মেলার মাঠে সমাবেশের পরামর্শ দেয়।

পুলিশের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে বিএনপি তাদের কর্মসূচি এক দিন পিছিয়ে শুক্রবার নয়াপল্টনেই করার ঘোষণা দেয়।

বিএনপি নতুন তারিখ ঘোষণার কিছুক্ষণ পরই ‘পুরোনো বাণিজ্য মেলার মাঠ সমাবেশের উপযোগী নয়’ দাবি করে আওয়ামী লীগও জানায় তারা এক দিন পিছিয়ে শুক্রবার সমাবেশ করবে।

সংবাদ সম্মেলনে রিজভী বলেন, “পুলিশ শান্তিপূর্ণ পরিবেশকে পায়ে পাড়া দিয়ে নষ্ট করার চেষ্টা করছে। গতকাল থেকে আমাদের অনেক নেতা-কর্মীকে গ্রেপ্তার করছে, হয়রানি করছে। হোটেলে হোটেলে তল্লাশি করছে। আমার প্রশ্ন এরা কি বেআইনি লোক? এরা কি অপরাধী? এরা বিভিন্ন এলাকার গণ্যমান্য ব্যক্তি, জেলার অঙ্গসংগঠনের নেতৃবৃন্দ।”

তিনি জানান, বৃহস্পতিবার রাতে লালমাটিয়ার বাসা থেকে বিএনপি সহসাংগঠনিক সম্পাদক কুদ্দুসুর রহমান আকন, ধানমন্ডির একটি বাসা থেকে ত্রাণ ও পুনর্বাসন বিষয়ক সম্পাদক শফিকুল ইসলাম মিলন, রাজশাহী যুবদলের আহ্বায়ক আনোয়ার হোসেন উজ্জ্বল, তানোর পৌরসভার সাবেক মেয়র মিজানুর রহমানসহ নয় জন, ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের ২৬ নম্বর ওয়ার্ডের সাবেক কমিশনার মীর আশরাফ আলী আজম ও তার ছেলে ব্যারিস্টার মুরতার আলীকে বাসা থেকে ‘পিটিয়ে বাড়ি-ঘর ভাঙচুর করে’ গ্রেপ্তার করা হয়েছে।

তিনি জানান, মীর আশরাফ আশঙ্কাজনক অবস্থায় পুলিশি পাহারায় হাসপাতালে চিকিৎসা নিচ্ছেন। গ্রেপ্তারের সময় আশরাফ আলী গুরুতর আহত হন, তাঁর একটি পা ভেঙে গেছে।

পুলিশের মতে, নিয়মিত অভিযান

বিএনপি নেতা-কর্মীদের গ্রেপ্তার প্রসঙ্গে ঢাকা মহানগর পুলিশ (ডিএমপি) কমিশনার খন্দকার গোলাম ফারুক সংবাদ সম্মেলনে বলেন, আসন্ন আশুরা ও বড়ো দুটি দলের সমাবেশে সার্বিক নিরাপত্তার বিষয়টি মাথায় রেখে সন্দেহজনক ব্যক্তি ও ওয়ারেন্টভুক্ত আসামিদের আটক করা হচ্ছে, যা পুলিশের নিয়মিত অভিযানেরই অংশ।

পুলিশ অভিযান চালিয়ে ৩৫০ জনকে গ্রেপ্তার করেছে জানিয়ে তিনি বলেন, “দিন-রাত ২৪ ঘণ্টাই আমাদের চেকপোস্ট আছে। ২০১৫ সালে মহরমের সময় তাজিয়া মিছিলে বোমা হামলা হয়েছে। এখন মিছিলের প্রস্তুতি চলছে, আমরা সেই জঙ্গি হামলার কথা ভুলে যাইনি।”

“কাল (শুক্রবার) বড়ো দুটি রাজনৈতিক দলের সমাবেশ। এখানে যে কেউ বা কোনো কুচক্রী মহল বাইরে থেকে এসে দুর্ঘটনা ঘটাতে পারে। তাই সার্বিক নিরাপত্তার বিষয়টি মাথায় রেখে আমাদের চেকপোস্ট স্থাপন এবং সন্দেহজনক ব্যক্তি ও মামলার ওয়ারেন্টভুক্ত আসামিদের আটক করা হচ্ছে। এটা নিয়মিত অভিযানের অংশ, এটা বর্তমানে করা হচ্ছে, ভবিষ্যতেও আমরা করব,” বলেন তিনি।

২৩ শর্তে সমাবেশের অনুমতি

নিজেদের পছন্দের জায়গায় সমাবেশ করবে; বিএনপি ও আওয়ামী লীগের তিন সহযোগী সংগঠনের এমন ঘোষণার পর বৃহস্পতিবার বিকেলে সংবাদ সম্মেলনে দুই রাজনৈতিক দলকেই নিজেদের পছন্দের স্থানে সমাবেশ করার অনুমতি দিয়েছে পুলিশ।

এসব কর্মসূচিগুলো থেকে যাতে কোনো সংঘাতময় পরিস্থিতি তৈরি না হয় সে জন্য পুলিশ উভয় পক্ষকেই ২৩টি শর্ত দিয়েছে।

খন্দকার গোলাম ফারুক বলেন, “আশুরার নিরাপত্তায় পুলিশের ব্যস্ততা রয়েছে, প্রতিদিন তাজিয়া মিছিল হচ্ছে। তারপরও বিএনপি ও যুবলীগকে তাদের পছন্দের জায়গায় ২৩টি শর্তে সমাবেশ করার অনুমতি দেওয়া হয়েছে।”

দুই দলকেই তাদের চৌহদ্দি নির্ধারণ করে দেওয়ার কথা জানিয়ে পুলিশ কমিশনার বলেন, বিএনপির ক্ষেত্রে বলা হয়েছে নাইটিঙ্গেল মোড় থেকে পুলিশ হাসপাতালের মোড় (ফকিরাপুল) পর্যন্ত এলাকার মধ্যে তাদের মিছিল-সমাবেশ এবং মাইক ব্যবহার সীমাবদ্ধ রাখতে হবে।

অন্যদিকে আওয়ামী লীগের সহযোগী সংগঠনগুলোকে মহানগর নাট্যমঞ্চ থেকে মুক্তাঙ্গনের মধ্যে তাদের সমাবেশ এবং মাইক ব্যবহার সীমাবদ্ধ রাখতে বলা হয়েছে।

একটি পৃথক সংবাদ সম্মেলনে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান বলেছেন, “সবাইকে সব সময় বলি, রাজনৈতিক দলগুলোর কর্মসূচি পালন করতে সরকারিভাবে কোনো বাধা নেই। কিন্তু তারা যেন নিয়ম-শৃঙ্খলা ও দেশের আইন মেনে চলেন এবং জনদুর্ভোগ সৃষ্টি না করেন আমি সেই আহ্বান রাখব। আমি আহ্বান রাখব, তারা যেন কোনো রকম ধ্বংসাত্মক কাজে লিপ্ত না হন। তারা যেন জনগণের দুর্ভোগ সৃষ্টি না করেন।”

“জনদুর্ভোগ সৃষ্টি করলে বা জানমালের ক্ষতি, ভাঙচুর বা জনগণের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে শান্তি-শৃঙ্খলা বিনষ্ট করলে নিরাপত্তা বাহিনী তাদের ওপর অর্পিত দায়িত্ব পালন করবে,” বলেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী।

সমাবেশ করবে বিএনপির শরিকরাও

সরকারের পদত্যাগের দাবিতে বিএনপির পাশাপাশি শুক্রবার যুগপৎ আন্দোলনের শরিক দলগুলোও ঢাকায় সমাবেশ করবে।

এই দল ও জোটগুলোর মধ্যে রয়েছে—গণতন্ত্র মঞ্চ, গণঅধিকার পরিষদ, ১২ দলীয় জোট, জাতীয়তাবাদী সমমনা জোট, গণফোরাম, পিপলস পার্টি, গণঅধিকার পরিষদ (রেজা কিবরিয়া), লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টি (এলডিপি), গণতান্ত্রিক বাম ঐক্য, লেবার পার্টি, ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক মুভমেন্ট (এনডিএম), বাংলাদেশ সাধারণ ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদ এবং জাতীয়তা সমমনা পেশাজীবী জোট।

পাল্টাপাল্টি সমাবেশে সংঘাতের আশঙ্কা

ক্ষমতাসীন দল ও বিরোধী দলগুলোর পাল্টাপাল্টি সমাবেশের ফলে সংঘাতের আশঙ্কা করেছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা।

তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা এম হাফিজ উদ্দিন খান বেনারকে বলেন, “রাজনৈতিক দলগুলো পাল্টাপাল্টি সমাবেশের ফলে সংঘাতের আশঙ্কা স্পষ্ট। এই অবস্থা থেকে সহজ পরিত্রাণের কোনো উপায় দেখাও যাচ্ছে না।”

তিনি বলেন, “রাজনৈতিক দলগুলোর উচিত নিজেদের মধ্যে আলাপ-আলোচনার ভিত্তিতে সমস্যা নিরসন করা। কিন্তু দলগুলোর পারস্পরিক অশ্রদ্ধা এতটাই বাড়িয়েছে যে, তাও আশা করা মুশকিল হয়ে পড়েছে।”

এ প্রসঙ্গে বেনারনিউজের প্রশ্নের উত্তরে ঢাকায় মার্কিন দূতাবাসের মুখপাত্র ব্রায়ান শিলার বলেন, “আমরা বাক স্বাধীনতা ও শান্তিপূর্ণ সমাবেশ সমর্থন করি। গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় এটি অপরিহার্য। যুক্তরাষ্ট্র অবাধ, সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচন অনুষ্ঠানে বাংলাদেশের দৃষ্টিভঙ্গিতে একাত্মতা পোষণ করে। সেটা যেন হয় প্রত্যেকেরই যার যার জায়গা থেকে সেই চেষ্টা করা উচিত।”

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।