সরকার বদলের পর হত্যা মামলায় আসামি ক্রিকেটার, নায়ক ও সাংবাদিক
2024.08.23
ঢাকা
ছাত্র-জনতার গণ অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে শেখ হাসিনা সরকার পতনের পর একের পর এক হত্যা মামলার ধারাবাহিকতায় এবার এক গার্মেন্টস কর্মীকে হত্যার অভিযোগে মামলা হয়েছে ক্রিকেট জগতের সুপারস্টার সাকিব আল হাসান ও চিত্রনায়ক ফেরদৌস আহমেদের বিরুদ্ধে।
রাজনীতিতে যোগ দিয়ে আওয়ামী লীগের টিকিটে নির্বাচিত হওয়া এই দুই সাবেক সংসদ সদস্যের (এমপি) বিরুদ্ধে বৃহস্পতিবার রাতে ঢাকার আদাবর থানায় মামলা করেছেন নিহত গার্মেন্টস কর্মী রুবেলের বাবা রফিকুল ইসলাম।
জাতীয় দলের সাবেক অধিনায়ক ও দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে মাগুরা-১ আসন থেকে নির্বাচিত সাকিব ও ঢাকার একটি আসন থেকে নির্বাচিত চিত্রনায়ক ফেরদৌস ছাড়াও এই মামলায় সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, সাবেক সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরসহ ১৫৬ জনের নামে এবং অজ্ঞাত আরও ৪০০-৫০০ জনকে আসামি করা হয়েছে বলে বেনারকে নিশ্চিত করেছেন আদাবর থানার পরিদর্শক (তদন্ত) মো. নজরুল ইসলাম।
তিনি জানান, মামলাটি গ্রহণের পর একজন তদন্ত কর্মকর্তা নিয়োগ দেয়া হয়েছে।
আসামিদের বর্তমান অবস্থান সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বলেন, “তদন্তকারী কর্মকর্তা মাত্রই কাজ শুরু করছেন। তিনি তদন্তের স্বার্থে যা যা খোঁজ নেয়া দরকার নেবেন এবং যেমন পদক্ষেপ গ্রহণ করা প্রয়োজন তেমনটিই করবেন।”
তিনি জানান, কোটা সংস্কার আন্দোলন ও পরে সরকার পতনের দাবিতে সংঘর্ষ চলাকালে ৫ আগস্ট পোশাক কারখানার কর্মী রুবেল গুলিবিদ্ধ হন। পরে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান।
“এই হত্যার নির্দেশ ও পরিকল্পনার অভিযোগে সাকিব ও ফেরদৌসসহ অন্যান্যদের এই মামলায় আসামি করা হয়েছে,” বলেন নজরুল।
মামলার এজাহারে বাদীর অভিযোগ, শেখ হাসিনা সরকার পতনের দিন রুবেল ঢাকার আদাবরের রিং রোডে মিছিলে অংশ নেন। এ সময় আসামিদের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ নির্দেশ, প্ররোচনা, সাহায্য, সহযোগিতা ও মদদে মিছিলে গুলি ছোড়া হয়। বুকে ও পেটে গুলিবিদ্ধ অবস্থায় রুবেলকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছিল। হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তিনি ৭ আগস্ট মারা যান।
এদিকে বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বেনারকে নিশ্চিত করেছেন, ছাত্র-জনতার আন্দোলন চলাকালে বা সরকার পতনের দিন সাকিব আল হাসান ছিলেন কানাডায়। সেখানে তিনি গ্লোবাল টি-টোয়েন্টিতে খেলেছেন।
তিনি জানান, সাকিব এর পর দেশে ফেরেননি এবং বর্তমানে পাকিস্তানে দ্বিদেশীয় সিরিজ খেলার জন্য অবস্থান করছেন।
ফেরদৌসের নম্বরে ফোন করে সেটি বন্ধ পাওয়া যায়। সরকার পতনের পর থেকে তাঁকে কোথাও দেখা যায়নি।
বেনারের পক্ষ থেকে মামলার বাদী রফিকুল ইসলামের মোবাইলে কয়েকবার ফোন করা হলেও তিনি তা রিসিভ করেননি।
হত্যা মামলায় গ্রেপ্তার সাংবাদিক দম্পতি রিমান্ডে
একাত্তর টেলিভিশনের সাবেক হেড অব নিউজ শাকিল আহমেদ ও এর সাবেক প্রিন্সিপাল করেসপনডেন্ট ও প্রেজেন্টার ফারজানা রুপাকে হত্যা মামলায় জিজ্ঞাসাবাদের জন্য চারদিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেছে ঢাকার একটি আদালত।
একটি হত্যা মামলায় উত্তরা পূর্ব থানার উপ-পরিদর্শক মোহাইমিনুর রহমান ১০ দিনের রিমান্ডের আবেদন করলে ঢাকা মহানগর হাকিম আহমেদ হুমায়ুন কবির বৃহস্পতিবার এই সাংবাদিক দম্পতির চারদিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন বলে জানিয়েছেন আদালতের জেনারেল রেকর্ড অফিসার মোঃ আবু নওশের।
এই সাংবাদিক দম্পতির বিরুদ্ধে আওয়ামী লীগ সরকারের বিভিন্ন কাজে সহায়কের ভূমিকায় সম্পৃক্ত থাকার অভিযোগ থাকলেও তাঁদেরকে হত্যা মামলায় আসামি করার ঘটনায় উদ্বেগ জানিয়েছে বিভিন্ন সাংবাদিক সংগঠন।
বৃহস্পতিবার যখন এই সাংবাদিক দম্পতিকে আদালতে তোলা হয় তখন কয়েকজন আইনজীবী শাকিল ও রুপাকে গালাগাল করেন। এর আগে গত সপ্তাহে সাবেক শিক্ষামন্ত্রী দীপু মনিকে আদালতে লাঞ্ছিত করার ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হয়।
সাম্প্রতিক সময়ে সাবেক উপদেষ্টা সালমান এফ রহমানকে লক্ষ্য করে আদালতে ডিম ছুড়ে মারার ঘটনা ঘটে।
এসব ঘটনার ধারাবাহিকতায় গত বুধবার ঢাকা বিমানবন্দরে দুই সাংবাদিককে আটক করা হয় এবং পরে উত্তরা পূর্ব থানায় দায়েরকৃত হত্যা মামলায় তাদের গ্রেপ্তার দেখানো হয়।
৫ আগস্ট উত্তরায় সরকারবিরোধী বিক্ষোভে ভাই ফজলুল করিমের মৃত্যুর ঘটনায় ডেকোরেটর ব্যবসায়ী আনোয়ার হোসেন আয়নাল বাদী হয়ে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ অজ্ঞাত ৩৯ জনকে আসামি করে মামলাটি করেন।
গত ৮ আগস্ট একাত্তর টেলিভিশন শাকিল ও রুপাকে বরখাস্ত করে।
সাংবাদিক শাকিল ও রুপার বিরুদ্ধে হত্যা মামলা দায়েরের ঘটনায় গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছে সম্পাদক পরিষদ।
বৃহস্পতিবার (২২ আগস্ট) সম্পাদক পরিষদের বিবৃতিতে বলা হয়, গত ২১ আগস্ট শাকিল আহমেদ ও ফারজানা রুপাকে বিমানবন্দর থেকে আটক করা হয়। পরে হত্যা মামলায় তাঁদের গ্রেপ্তার দেখানো হয়। সম্পাদক পরিষদ মনে করে, সাংবাদিকতার বাইরে শাকিল আহমেদ ও ফারজানা রুপা কোনো অপরাধ করে থাকলে যথাযথ ধারা অনুসরণ করে তাঁদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া যেতে পারে। তবে হত্যা মামলা দায়ের গভীর উদ্বেগের বলে মনে করে সম্পাদক পরিষদ।
সম্পাদক পরিষদ পেশাদার সাংবাদিকতা বাদ দিয়ে নীতিবিবর্জিত ও লেজুড়বৃত্তির সাংবাদিকতা বর্জনের ওপরও জোর দেয়।
সুশাসনের ইঙ্গিত বহন করে না: অধিকারকর্মী
শেখ হাসিনার পতনের পর থেকে শুক্রবার পর্যন্ত তার, তাঁর পরিবারের সদস্য, তাঁর দল ও সরকারের বিভিন্ন পর্যায়ের ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে প্রায় অর্ধশত হত্যা মামলা দায়ের হয়েছে দেশের বিভিন্ন স্থানে।
এসব মামলার কোনোটিতে শত শত মানুষকে নামে-বেনামে আসামি করা হয়েছে। ইতোমধ্যে বেশ কয়েকজন সাবেক মন্ত্রী, জোটের নেতা, সাবেক সরকারি কর্মকর্তা গ্রেপ্তার হয়েছে বিভিন্ন মামলায়।
কিন্তু এভাবে গণহারে মামলা দায়ের ও গ্রেপ্তারের ধরন নিয়ে ইতোমধ্যে প্রশ্ন উঠেছে।
“এই সরকারকে মাথায় রাখতে হবে আওয়ামী লীগের দুঃশাসনের ফলে প্রতিবাদ থেকে এই সরকারের জন্ম। এই সরকারের কাছে মানুষ আইনের শাসনের পূর্ণ গণতান্ত্রিক প্রয়োগ প্রত্যাশা করে,” বলেন আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) নির্বাহী পরিচালক ফারুক ফয়সাল।
তিনি বেনারকে বলেন, “আমরা বেশ কিছু ক্ষেত্রে পুরোনো অপশাসনেরই নতুন প্রয়োগ দেখতে পারছি। এটা মোটেও প্রত্যাশিত নয়। আমরা চাইব আইনের শাসন ও মানবাধিকার যথাযথ মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত হোক।”