জাতীয় নির্বাচনের প্রস্তুতি: এক লাখ অনলাইন অ্যাক্টিভিস্ট তৈরি করছে আওয়ামী লীগ
2021.09.14
ঢাকা
হাতে দু বছরের বেশি সময় থাকলেও নির্বাচনী প্রস্তুতি শুরু করে দিয়েছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। দলীয় প্রধান ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশে দল ও সরকারকে নিয়ে সমালোচনা রুখতে এক লাখ ‘অনলাইন অ্যাক্টিভিস্টের’ একটি প্লাটফর্ম তৈরির উদ্যোগ নিয়েছে দলটির বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিষয়ক কেন্দ্রীয় উপ কমিটি।
“জনকল্যাণমুখী ও উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে যাতে কোনো প্রকার গুজব ও নেতিবাচক প্রচারণা না হয় তা নিশ্চিত করতে,” এই উদ্যোগ নেয়া হয়েছে বলে বেনারকে জানান এই উপকমিটির সদস্য সচিব ও দলের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিষয়ক সম্পাদক ইঞ্জিনিয়ার মো. আবদুস সবুর।
গত জানুয়ারি থেকে শুরু হওয়া এই উদ্যোগে প্রশিক্ষকরা ইতোমধ্যে লক্ষ্যমাত্রার ৩০ ভাগ অনলাইন অ্যাক্টিভিস্ট তৈরি করতে সক্ষম হয়েছেন জানিয়ে তিনি বেনারকে বলেন, আগামী দেড় বছরের মধ্যে প্রশিক্ষিত এক লাখ অনলাইন অ্যাক্টিভিস্ট প্রস্তুত হয়ে যাবে।
“এসব কর্মশালায় আওয়ামী লীগ, যুবলীগ, ছাত্রলীগ, স্বেচ্ছাসেবক লীগসহ দলীয় অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠন ও বিভিন্ন ইউনিটের তথ্য প্রযুক্তি সম্পাদকসহ বিভিন্ন পদধারীরা প্রশিক্ষণ পাচ্ছেন। তাঁরা নিজেরা প্রশিক্ষক হিসেবে কাজ করার পাশাপাশি অনলাইন অ্যাক্টিভিস্ট হিসেবেও সক্রিয় থাকবেন,” বলেন সবুর।
“সাধারণত জাতীয় সংসদ নির্বাচন ঘনিয়ে এলে বিরোধী দলীয় কর্মীরা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলো ব্যবহার করে সরকারকে ও ক্ষমতাসীন দলকে বিব্রত করতে এবং সাধারণ মানুষকে বিভ্রান্ত করতে নানা ধরনের ভুল তথ্য ছড়িয়ে দেয়ার চেষ্টা করে,” জানিয়ে তিনি বলেন, “যেহেতু বর্তমানে বিরোধীরা রাজপথে নিষ্ক্রিয় সেহেতু তারা দেশে বিদেশে বসে অনলাইন প্লাটফর্মগুলোকে বেশি ব্যবহারের চেষ্টা করবে।”
“এই অপচেষ্টা রুখে দিতে তৎপর থাকবে আমাদের অনলাইন অ্যাক্টিভিস্টরা,” বলেন সবুর।
তিন প্রক্রিয়ায় প্রতিরোধ
আওয়ামী লীগের অনলাইন অ্যাক্টিভিস্ট তৈরির সাম্প্রতিক একটি কর্মশালায় ‘মাস্টার ট্রেইনার’ হিসেবে প্রশিক্ষণ নিয়েছেন ঢাকা মহানগর দক্ষিণ আওয়ামী লীগের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিষয়ক সম্পাদক শরিফুল ইসলাম শরিফ।
তাঁরা এখন দলের তৃণমূল কমিটিগুলোর প্রতিনিধিদের প্রশিক্ষণ দিচ্ছেন জানিয়ে তিনি বেনারকে বলেন, “যখনই আমরা ফেসবুক বা টুইটারে দল, সরকার বা প্রশাসন নিয়ে কোনো মিথ্যাচার বা গুজব দেখব, তখনি আমরা তিনটি প্রক্রিয়ায় এর বিরুদ্ধে সোচ্চার হবো।”
এই তিন প্রক্রিয়া হচ্ছে; সঠিক তথ্য দিয়ে ভুল তথ্যের বিরুদ্ধে নিজেদের প্রোফাইল থেকে পোস্ট দেয়া, ফেসবুক, টুইটারের রিপোর্ট অপশন ব্যবহার করে পোস্টদাতার আইডিতে রিপোর্ট করা এবং প্রচলিত আইনে ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য পোস্টদাতার আইডির তথ্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কাছে পাঠানো।
তবে সরকারি দলের অনলাইন অ্যাক্টিভিস্ট তৈরির এই উদ্যোগকে প্রধান বিরোধী দল বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল- বিএনপি মোটেও ভালোভাবে দেখছে না বলে বেনারকে জানান দলটির জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী।
তাঁর মতে, “ক্ষমতাসীনরা গুজব রোধে অনলাইন অ্যাক্টিভিস্ট তৈরির নামে মূলত একদল কর্মী বাহিনীকে প্রশিক্ষিত করছে যারা সরকারের ব্যর্থতা সম্পর্কে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে লেখালেখি হলে সেগুলোকে আড়াল করতে কাজ করবে।”
তিনি বলেন, “সরকার যেহেতু জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন এবং পরপর এমন দুটি নির্বাচনের মধ্য দিয়ে ক্ষমতায় এসেছে, যা দেশীয় ও আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে ব্যাপকভাবে সমালোচিত হয়েছে সেহেতু তারা এটা ভালো করেই জানে যে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে মানুষ সুযোগ পেলেই সত্যগুলো তুলে ধরবে।”
“অতএব এই সত্য আড়াল করাটা এখন আওয়ামী লীগের জন্য বড়ো চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে, আর সেজন্য এমন উদ্যোগ,” বলেন রিজভী।
বিশৃঙ্খলার আশঙ্কা
আওয়ামী লীগের এই উদ্যোগকে “বেশ রহস্যজনক” বলে আখ্যায়িত করেন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা এম হাফিজ উদ্দিন খান।
“যে বিষয়টি আওয়ামী লীগের কাছে প্রোপাগান্ডা বা মিথ্যাচার সেটি বিএনপির কাছে হয়তো সত্য। এখন এর সুরাহা করবে কে? আমার ধারণা এসবের ফলে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বিশৃঙ্খলা তৈরি হতে পারে,” বেনারকে বলেন হাফিজ।
সম্প্রতি নায়িকা পরীমনির মুক্তির দাবিতে ফেসবুকে একটি লাইভ করার পর হঠাৎ করেই নিজের ফেসবুক আইডিটি হারিয়ে ফেলেন প্রকাশক ও সংগঠক রবীন আহসান। সপ্তাহ দুয়েক পর তিনি এটি ফিরে পান।
“আমি জানি না কে বা কারা আমার আইডিটি গায়েব করতে ভূমিকা রেখেছিল। বিভিন্ন ইস্যুতে আমি ফেসবুকের মাধ্যমে বহু প্রতিবাদ সমাবেশের আয়োজন করেছি। কিন্তু এবারই প্রথম এমন বাজে অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হলাম,” বেনারকে বলেন রবীন।
আওয়ামী লীগ ভোটে, বিএনপি প্রতিরোধে!
গত বৃহস্পতিবার প্রধানমন্ত্রীর সরকারি বাসভবনে অনুষ্ঠিত দলের কার্যনির্বাহী সংসদের সভায় সংশ্লিষ্টদের আগামী দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের জন্য প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি নিতে নির্দেশনা দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা।
সভা শেষে দলের সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের সাংবাদিকদের বলেন, আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনের প্রস্তুতি শুরু করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে আওয়ামী লীগ। এ লক্ষ্যে নির্বাচনী ইশতেহার তৈরি করতে উপ কমিটিগুলোকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
“বৈঠকে দলীয় প্রধান নেতাকর্মীদের জানিয়েছেন যে সরকারের বিরুদ্ধে অপপ্রচার এবং চক্রান্ত চলছে। যতই নির্বাচন ঘনিয়ে আসছে ততই অপপ্রচারের মাত্রা বাড়ছে। এসব অপপ্রচারের জবাব দিতে হবে, চক্রান্তমূলক তৎপরতার বিরুদ্ধে সবাইকে ঐক্যবদ্ধভাবে প্রতিরোধ করতে হবে,” যোগ করেন কাদের।
প্রধানমন্ত্রীর নির্বাচন সংক্রান্ত নির্দেশনার দিন কয়েক পর এক প্রতিক্রিয়ায় বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, নির্দলীয় সরকার এবং নিরপেক্ষ নির্বাচন কমিশন গঠন ছাড়া দেশে আগামীতে কোনো জাতীয় নির্বাচন করতে হবে না।
এ প্রসঙ্গে রিজভী বেনারকে বলেন, “ক্ষমতাসীনরা বিরোধী দলহীন নির্বাচন এবং আগের রাতে ভোট করে ফেলায় অভ্যস্ত। তারা এবারও নানা ধরনের চক্রান্ত করছে যাতে করে নিজেরা ক্ষমতায় টিকে থাকতে কোনো প্রকার অসুবিধা না হয়।”
তিনি আরও বলেন, দলীয় প্রধান খালেদা জিয়াসহ হাজার হাজার বিরোধী দলীয় নেতাকর্মী ‘রাজনৈতিক চক্রান্তমূলক মামলায়’ কারাগারে এবং শত শত মামলা রয়েছে তাঁদের বিরুদ্ধে। এই পরিস্থিতিতে এসব নিয়ে সকল প্রতিবাদকে উপেক্ষা করে নির্বাচনের আওয়াজ তোলা ক্ষমতাকে কুক্ষিগত করে রাখার ষড়যন্ত্র ছাড়া কিছু নয়।
তবে “নির্বাচন করতে দেয়া হবে না” এই ধরনের বক্তব্য “গণতন্ত্র এবং জনগণের আস্থায় বিশ্বাসী” কোনো রাজনৈতিক দলের কাছ থেকে আসতে পারে না বলে বেনারের কাছে মন্তব্য করেন আওয়ামী লীগের যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম।
“নির্বাচন করে নির্বাচন কমিশন, এখানে সরকারের কোন ভূমিকা নেই,” জানিয়ে তিনি বলেন, “অহেতুক বিতর্ক না করে সবার উচিত নির্বাচনের জন্য প্রস্তুতি নেয়া।”
২০০৮ সালে সেনা নিয়ন্ত্রিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে অনুষ্ঠিত নবম সংসদ নির্বাচনে জয় পেয়ে ২০০৯ সালের জানুয়ারিতে সরকার গঠন করে আওয়ামী লীগ। এরপর ২০১৪ সালে দশম সংসদ নির্বাচনে টানা দ্বিতীয়বার জয় লাভ করে দলটি। প্রায় সবকটি বিরোধী রাজনৈতিক দল এই নির্বাচন বর্জন করায় ১৫৩টি আসলে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হন আওয়ামী লীগের প্রার্থীরা।
এরপর ১০১৮ সালের ডিসেম্বরের নির্বাচনে বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো অংশ নিলেও এই নির্বাচন দেশ ও বিদেশে ব্যাপকভাবে সমালোচিত হয়। ওই নির্বাচনের মাধ্যমে বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে বর্তমানে টানা তৃতীয় মেয়াদে ক্ষমতায় রয়েছে আওয়ামী লীগ। বর্তমান সংসদের মেয়াদ শেষ হবে ২০২৪ সালের জানুয়ারিতে।