বিশ্লেষকদের মতে, ‘তৃণমূল বিএনপি’ বিভ্রান্তি ও সন্দেহ বাড়াবে
2023.09.19
ঢাকা
বাংলাদেশের প্রধান বিরোধী দল বিএনপির সাবেক দুই প্রভাবশালী নেতা ‘তৃণমূল বিএনপি’ নামে প্রায় নতুন এক রাজনৈতিক দলে যোগ দিয়ে শীর্ষ পদ পাওয়ার ঘটনাকে আগামী জাতীয় নির্বাচন সামনে রেখে বিএনপিকে বিপদে ফেলার চেষ্টা হিসেবে দেখছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকেরা।
তাঁদের মতে, আগামী নির্বাচনকে কেন্দ্র করে এই দলটি বিভ্রান্তি ও সন্দেহ বাড়াবে।
সরকারের পদত্যাগের দাবিতে রাজপথে আন্দোলনে তৎপর বিএনপি যখন বলছে, বর্তমান ব্যবস্থায় বা দলীয় সরকারের অধীনে কোনো নির্বাচনে অংশ নেবে না, তখন প্রথম কাউন্সিল অধিবেশনেই মঙ্গলবার তৃণমূল বিএনপি ঘোষণা দিয়েছে, আগামী নির্বাচনে দেশের প্রতিটি সংসদীয় আসনে তাদের প্রার্থী থাকবে।
রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও বিরোধী রাজনৈতিক নেতাদের মত, এই ধরনের রাজনৈতিক প্রচেষ্টার পেছনে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের হাত থাকতে পারে।
প্রসঙ্গত, বিএনপি'র মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর গত কয়েক মাস ধরে বারবার বলে আসছেন যে, সরকার ও বিভিন্ন সংস্থার পক্ষ থেকে তাঁর দল ভাঙার নানামুখী চেষ্টা চলছে।
তবে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য আবদুর রহমান বেনারকে বলেন, “রাজনৈতিক দল নির্দিষ্ট নিয়মে গঠিত হয়। এখানে আওয়ামী লীগের কোনো ভূমিকা নেই।”
‘বিভ্রান্তি ও সন্দেহ বাড়বে’
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সরকার ও রাজনীতি বিভাগের সাবেক অধ্যাপক ড. দিলারা চৌধুরীর মতে, তৃণমূল বিএনপিতে সাবেক বিএনপি নেতাদের যোগদান পরিষ্কারভাবেই ‘বিএনপিকে বিপদে ফেলার’ চেষ্টা।
“এ রকম চেষ্টা এর আগেও বিভিন্ন সময় আমরা দেখেছি। তবে এসব করে মানুষকে বোকা বানানো কঠিন,” মন্তব্য করে তিনি বেনারকে বলেন, সাবেক বিএনপি নেতাদের “ভাগিয়ে নেয়ার চেষ্টা” সামনের দিনগুলোতেও অব্যাহত থাকবে।
সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার বেনারকে বলেন, এই রাজনৈতিক দলটির নামই আরেকটি দলের নামের সঙ্গে একটি শব্দ যোগ করে তৈরি হয়েছে। সাধারণ মানুষের কাছে এটা যেমন বিভ্রান্তির উদ্রেক করবে, তেমনি এটি নিয়ে সন্দেহও বাড়বে।
এমন উদ্যোগের পেছনে কী কারণ থাকতে পারে জানতে চাইলে তিনি বলেন, “আওয়ামী লীগের জন্য এখন সবচেয়ে বড়ো চ্যালেঞ্জ হচ্ছে একটি অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন নিশ্চিত করা। যদি এসব দল নির্বাচনে যায় তাহলে তারা বলতে পারবে নির্বাচন অংশগ্রহণমূলক হয়েছে। এটা একটা প্রহসনের চেষ্টা বলে আমার কাছে মনে হয়।”
নতুন রাজনৈতিক দলে বিএনপির সাবেক দুই নেতার যুক্ত হবার বিষয়ে জানতে চাইলে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী বেনারকে বলেন, “যে নেতাদের বিএনপি থেকে বহিষ্কার করা হয়েছে বা যারা বিএনপিতে নেই তারা কী করবে এটা নিয়ে বিএনপির মাথা ব্যথা নেই।”
বিএনপিকে দুর্বল করে দেয়ার জন্য বা ভাঙার চেষ্টা গত কয়েক বছরে বহুবার হয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, এসব ব্যর্থ চেষ্টা দিয়ে আগামী নির্বাচনের বৈতরণী পার হওয়া সম্ভব হবে না।
বিএনপির সাবেক দুই নেতা তৃণমূল বিএনপির নেতৃত্বে
মঙ্গলবার ঢাকায় দলের বিএনপির সাবেক নেতা শমসের মুবিন চৌধুরী ও তৈমুর আলম খন্দকারকে যথাক্রমে চেয়ারপারসনের ও মহাসচিব নির্বাচিত করেছে তৃণমূল বিএনপি।
দুই নেতার মধ্যে বিএনপির সাবেক ভাইস-চেয়ারম্যান ও সাবেক পেশাদার কূটনীতিক শমসের মবিন চৌধুরীর ভূমিকা তাঁর আগের দলের কূটনৈতিক যোগাযোগে ছিল উল্লেখযোগ্য।
অপরদিকে দলীয় সিদ্ধান্ত উপেক্ষা করে স্থানীয় সরকার নির্বাচনে অংশ নেওয়ায় সম্প্রতি দল থেকে বরখাস্ত হওয়া বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা পরিষদের সাবেক সদস্য তৈমুর আলম খন্দকার ছিলেন বিএনপির তৃণমূল রাজনীতির একজন গুরুত্বপূর্ণ সংগঠক।
তৃণমূল বিএনপির প্রথম কাউন্সিলের দ্বিতীয় পর্বে আংশিক কমিটি ঘোষণা করেছেন কাউন্সিলের সংগঠক ও দলের সাবেক যুগ্ম মহাসচিব আক্কাস আলী খান।
কাউন্সিলে ২৭ সদস্যের আংশিক জাতীয় নির্বাহী কমিটি ঘোষণা করা হয়। নতুন কমিটিতে নির্বাহী চেয়ারপারসন নির্বাচিত হয়েছেন দলের প্রতিষ্ঠাতা নাজমুল হুদার মেয়ে অন্তরা সেলিমা হুদা।
কাউন্সিল অধিবেশন থেকে ঘোষণা দেয়া হয়, তৃণমূল বিএনপি নেতারা আসন্ন সংসদ নির্বাচনে ৩০০ আসনে একক প্রার্থী দেবেন।
সাবেক কূটনীতিক শমসের সর্বশেষ বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান ছিলেন।
২০১৫ সালে বিএনপি থেকে পদত্যাগ করার পর ২০১৮ সালে তিনি বিকল্পধারা বাংলাদেশে যোগ দেন।
শমসের মুবিন চৌধুরীর কাছে বিএনপি ছেড়ে তৃণমূলে বিএনপিতে যোগ দেওয়ার কারণ জানতে চাইলে তিনি সাংবাদিকদের বলেন, “তৃণমূল শব্দটা আমার কাছে খুব পছন্দ। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ করেছে তৃণমূলের মানুষ। আজকে বাংলাদেশের তৃণমূলের মানুষ বঞ্চিত, তাদের মূল্যায়ন হয় না। আমি চেষ্টা করব তাদের কথা বলতে।”
অপরদিকে তৈমুর বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা ছিলেন। ২০২২ সালে দলের সিদ্ধান্ত অমান্য করে নারায়ণগঞ্জ সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে মেয়র প্রার্থী হওয়ার কারণে তাঁকে দল থেকে বহিষ্কার করা হয়।
যেভাবে সামনে আসে তৃণমূল বিএনপি
চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি মাসে উচ্চ আদালতের নির্দেশনা মতে নির্বাচন কমিশন থেকে নিবন্ধন পায় তৃণমূল বিএনপি।
এই দলটির প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান ও বিএনপির সাবেক মন্ত্রী নাজমুল হুদা দলের নিবন্ধন পাওয়ার তিনদিন পর মারা যান।
তিনি বিএনপির প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকে ২০১২ সাল পর্যন্ত দলের ভাইস চেয়ারম্যান ছিলেন।
নাজমুল হুদা ১৯৭৭ সালে প্রয়াত রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের প্রতিষ্ঠিত জাগো দলের মাধ্যমে তার রাজনৈতিক জীবন শুরু করেন। ২০১২ সালের জুনে বিএনপি ছেড়ে নিজের দল বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী ফ্রন্ট গঠন করেন।
কয়েক মাস পর এই দল থেকে তাকে ক্ষমতাচ্যুত করা হলে তিনি ২০১৪ সালের মে মাসে বাংলাদেশ জাতীয় জোট এবং একই বছরের নভেম্বরে বাংলাদেশ মানবাধিকার পার্টি (বিএমপি) গঠন করেন।
২০১৫ সালের নভেম্বরে নাজমুল হুদা তৃণমূল বিএনপি নামে তাঁর পঞ্চম রাজনৈতিক দল গঠন করেন। তবে তখন এটি নিবন্ধন পায়নি।
২০১৮ সালে একাদশ সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন প্রত্যাশী ছিলেন নাজমুল হুদা। ঢাকা-১৬ আসন থেকে নির্বাচন করার আগ্রহ দেখিয়ে তিনি আওয়ামী লীগের মনোনয়ন ফরম ক্রয় করেন। তবে দলীয় মনোনয়ন পাননি।
আওয়ামী লীগ বিএনপির পাল্টাপাল্টি কর্মসূচি
ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের পদত্যাগে ও নির্বাচনকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে বিএনপির দুই সপ্তাহের কর্মসূচি ঘোষণার একদিন পর মঙ্গলবার দুই সপ্তাহের কর্মসূচি ঘোষণা করেছে আওয়ামী লীগও।
রাজনৈতিক বিশ্লেষক এবং বিএনপির মতে, ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের নতুন রাজনৈতিক পাল্টা কর্মসূচি উসকানিমূলক এবং এর ফলে সংঘাতের আশঙ্কা বাড়ছে।
অপরদিকে আওয়ামী লীগ বলছে পাল্টা কর্মসূচি নয় বরং নিজস্ব স্বতন্ত্র কর্মসূচি ঘোষণা করেছে আওয়ামী লীগ।
“আমরা কোনো পাল্টা কর্মসূচি দিচ্ছি না, এগুলো আমাদের নিজস্ব কর্মসূচি,” সংবাদ সম্মেলনে বলেন আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব উল আলম হানিফ।
অধ্যাপক দিলারা চৌধুরী মনে করেন, এ ধরনের পাল্টা-পাল্টি কর্মসূচির রাজনৈতিক দলগুলোকে মুখোমুখি করে তুলবে যা গণতান্ত্রিক সমাজে অগ্রহণযোগ্য।
“দুর্ভাগ্যবশত, এখন গণতন্ত্র অনুপস্থিত,” বলেন তিনি।