পুলিশের হামলায় বিরোধী দলের সমাবেশ পণ্ড, এক পুলিশসহ দুজন নিহত

আহম্মদ ফয়েজ
2023.10.28
ঢাকা
পুলিশের হামলায় বিরোধী দলের সমাবেশ পণ্ড, এক পুলিশসহ দুজন নিহত বিরোধীদলের মহাসমাবেশকে কেন্দ্র করে সংঘর্ষ চলাকালে ঢাকায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের ওপর বিএনপি কর্মীদের আক্রমণ। ২৮ অক্টোবর ২০২৩।
[এপি]

প্রধান বিরোধী দল বিএনপির মহাসমাবেশ ঘিরে শনিবার কার্যত সংঘর্ষের নগরীতে পরিণত হয় রাজধানী ঢাকা। বিএনপি নেতা-কর্মীদের সঙ্গে সংঘর্ষে এক পুলিশ সদস্য এবং যুবদলের এক নেতা নিহত হয়েছেন। দিনভর সংঘর্ষে পুলিশ, সাংবাদিকসহ আহত হয়েছেন কয়েকশ’।

পুলিশের অভিযানের মুখে মাঝপথেই সমাবেশ বন্ধ করে মঞ্চ ছাড়ার আগে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর পুলিশ ও ক্ষমতাসীনদের হামলার প্রতিবাদে রোববার সারাদেশে সকাল সন্ধ্যা হরতাল ঘোষণা করেন।

পুলিশ জানিয়েছে, নয়া পল্টনে মহাসমাবেশ ঘিরে বিএনপির সঙ্গে ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সংঘর্ষের মধ্যে রাজধানীর দৈনিক বাংলার মোড় এলাকায় হামলার শিকার হয়ে পুলিশ কনস্টেবল আমিনুল পারভেজ নিহত হয়েছেন।

আমিনুল ডিএমপির কাউন্টার টেররিজম এন্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম শাখায় ছিলেন। তাঁর বাড়ি মানিকগঞ্জ জেলার দৌলতপুরে।

ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের (ঢামেক) পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ মো. বাচ্চু মিয়া জানান, শনিবার বিকেল সোয়া ৪টার দিকে মুমূর্ষু অবস্থায় আমিনুলকে ঢামেকে নিয়ে আসলে চিকিৎসকরা তাঁকে মৃত ঘোষণা করেন।

এদিকে বিএনপির পক্ষ থেকে দাবি করা হয়েছে, পুলিশের গুলিতে শামীম মোল্লা নামের একজন যুবদল নেতা নিহত হয়েছেন।

পুলিশের সঙ্গে বিএনপি নেতাকর্মীদের সংঘর্ষের সময় তিনি গুলিবিদ্ধ হন দাবি করে মুগদা থানা যুবদলের সাবেক সাধারণ সম্পাদক কাজী জুয়েল বেনারকে বলেন, পুলিশের গুলিতে নিহত শামীমকে রাজারবাগ সেন্ট্রাল পুলিশ হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়েছে।

নিহত শামীম মোল্লা মুগদা থানা যুবদলের ৭ নম্বর ওয়ার্ডের এক নম্বর ইউনিটের সভাপতি।

যুবদল নেতার মৃত্যুর খবর নিশ্চিত করে রাজারবাগ কেন্দ্রীয় পুলিশ হাসপাতালের পরিচালক পুলিশের উপমহাপরিদর্শক মো. রেজাউল হায়দার গণমাধ্যমকে জানিয়েছেন, “তাঁর শরীরে কোনো আঘাতের চিহ্ন নেই। ধারণা করা হচ্ছে, তিনি হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন।

BNP2.JPG
ঢাকার নয়াপল্টনে বিএনপি কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে দলের মহাসমাবেশের একাংশ। ২৮ অক্টোবর ২০২৩। [বেনারনিউজ]

যেভাবে সংঘর্ষ শুরু

পূর্ব ঘোষিত মহাসমাবেশে যোগ দিতে দেশের বিভিন্ন জেলা ও মহানগর থেকে আসা নেতা-কর্মীরা শুক্রবার রাত থেকেই বিএনপির নয়া পল্টন কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে জড়ো হতে থাকেন।

শনিবার সকাল নাগাদ সমাবেশস্থল থেকে শুরু করে আশপাশের কয়েক কিলোমিটার এলাকা কানায় কানায় পূর্ণ হয়ে যায় বিএনপির নেতা-কর্মীদের উপস্থিতিতে।

কাকরাইল এলাকায় প্রধান বিচারপতির বাসভবনের সামনে উপস্থিত বিএনপি কর্মীদের পুলিশ সরে যেতে বললে সেখানে পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষের সূত্রপাত হয় বলে বেনারকে জানান যুবদল কর্মী ওমর ফারুক কাউসার।

তিনি দাবি করেন, বিএনপির নেতা-কর্মী ও সমর্থকরা শান্তিপূর্ণভাবেই অবস্থান করছিলেন।

কাকরাইল থেকে পরে সংঘর্ষ বিজয়নগর মোড়, ফকিরাপুল ও সেগুনবাগিচা এলাকায় ছড়িয়ে পড়ে।

পুলিশ এসব এলাকায় কাঁদানে গ্যাস নিক্ষেপ করে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করে। সংঘর্ষে পুলিশ সদস্য ছাড়াও বিএনপি নেতাকর্মী ও সাংবাদিক আহত হয়েছেন।

পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগের প্রধান মোহাম্মদ হারুন অর রশীদ এসময় গণমাধ্যমকে বলেন, সমাবেশগুলো নিয়মতান্ত্রিকভাবে করার কথা, ডিএমপি কমিশনারের কাছ থেকে তারা এমন শর্তেই অনুমতি নিয়েছে।

“কিন্তু হঠাৎ করে পুলিশের ওপর বিএনপি নেতাকর্মীরা প্রথমে ইট-পাটকেল নিক্ষেপ করে। এরপর আমরা তাদের সরিয়ে দেই। পরে তারা আইডিইবি ভবনে আগুন দেয়, প্রধান বিচারপতির বাসভবনে হামলা চালায়। আমরা তাদেরকে সরিয়ে দিয়েছি।”

গণমাধ্যমে পাঠানো এক বার্তায় ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) মিডিয়া সেল জানায়, বিএনপির সঙ্গে সংঘর্ষে আহত ২২ পুলিশ সদস্য কেন্দ্রীয় পুলিশ হাসপাতালে এবং বাকি ১৯ জন ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন।

সংঘর্ষকালে বিএনপি-জামায়াতের কর্মীরা রাজারবাগ কেন্দ্রীয় পুলিশ হাসপাতালে আগুন দিয়েছে বলেও দাবি করেছে ডিএমপি।

কয়েকশ বিএনপি কর্মী আহত

পুলিশ ও ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের হামলায় বিএনপির সমাবেশ পণ্ড হয়ে যাওয়ার পাশাপাশি দলটির কয়েকশ নেতা-কর্মী গুলিবিদ্ধ হয়েছেন।

বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী বেনারকে বলেন, “পুলিশ ও ক্ষমতাসীনরা ভয়াবহ সন্ত্রাসী কার্যক্রম চালিয়েছে। আমাদের কয়েকশ নেতা-কর্মী আহত হয়েছেন।”

আহতের সংখ্যা কত তা শনিবার সন্ধ্যা পর্যন্ত নিরূপণ করা যায়নি জানিয়ে তিনি বলেন, বিকেলের পর থেকে নয়াপল্টন এলাকার আশপাশের অলিগলিতে আওয়ামী লীগের কর্মীরা লাঠিসোঁটা নিয়ে হামলা চালিয়েছে।

“এই সন্ত্রাসী হামলার প্রতিবাদে আমরা হরতাল ডেকেছি। জনগণকে সাথে নিয়ে সকল সহিংসতা রুখে দেয়া হবে,” বলেন তিনি।

নগরজুড়ে আতঙ্ক

বিএনপির সমাবেশ ঘিরে সৃষ্ট উত্তেজনা ও সহিংসতার পর বিকেলে ঢাকা শহরের বিভিন্ন স্থানে যানবাহনে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে। নগরীর সড়কগুলো প্রায় জনমানবশূন্য হয়ে পড়েছে।

পুলিশ ও ফায়ার সার্ভিস সূত্রে জানা গেছে, শনিবার বিকেলের পর থেকে শহরের বিভিন্ন পয়েন্টে কমপক্ষে পাঁচটি আগুন লাগার ঘটনা ঘটেছে। তবে কে বা কারা আগুন লাগিয়েছে তা জানা যায়নি।

ফায়ার সার্ভিসের ডিউটি অফিসার রাশেদ বিন খালিদ বেনারকে বলেন, বিকেলে মৌচাক ফ্লাইওভারে বলাকা বাসে ও কমলাপুরে বিআরটিসি বাসে আগুনের ঘটনায় ফায়ার সার্ভিসের ইউনিট ঘটনাস্থলে পৌঁছে আগুন নিয়ন্ত্রণে আনে।

তিনি জানান, নিয়ন্ত্রণের আগেই আগুনে বাস দুটি পুরোপুরি পুড়ে যায়।

রমনা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আবুল হাসান বেনারকে বলেন, বিকেলে কাকরাইল মোড়ে একটি বাসে আগুনের ঘটনা শুনেছি।

তবে কে বা কারা আগুন দিয়েছে সেই তথ্য জানাতে পারেননি এই পুলিশ কর্মকর্তা।

jamat.jpeg
পুলিশের অনুমতি ছাড়াই ঢাকার মতিঝিল-ফকিরাপুল এলাকায় জামায়াতে ইসলামীর সমাবেশের একাংশ। ২৮ অক্টোবর ২০২৩। [বেনারনিউজ]

অনুমতি ছাড়াই জামায়াতের সমাবেশ

অনুমতি না পেলেও ঢাকায় সহিংসতা ছাড়াই বিপুল উপস্থিতি নিয়ে সমাবেশ করেছে জামায়াতে ইসলামী। রাজধানীর আরামবাগ এলাকায় বিপুল পুলিশি পাহারার মধ্যে মহাসমাবেশ করেছে দলটি।

শুরুর দিকে পুলিশ জামায়াতকে আটকে দেয়ার চেষ্টা করলেও শেষে মৌখিক অনুমতির ভিত্তিতে সমাবেশ করে জামায়াত।

সমাবেশে জামায়াতে ইসলামীর ভারপ্রাপ্ত আমির অধ্যাপক মুজিবুর রহমান বলেন, “এই সরকারের অধীনে কোনো নির্বাচন করতে দেওয়া হবে না, কেয়ারটেকারের সরকারের অধীনেই নির্বাচন করতে হবে।”

আন্দোলনের ভয় দেখিয়ে লাভ নেই

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দৃঢ় প্রত্যয় ব্যক্ত করে বলেছেন, আওয়ামী লীগকে আন্দোলনের ভয় দেখিয়ে বিএনপি লাভবান হবে না। তিনি বলেন, বিএনপি সরকারের পতন ঘটাবে, নানা রকম আন্দোলনের হুমকি দেয়। আওয়ামী লীগকে আন্দোলনের হুমকি ও ভয় দেখিয়ে কোনো লাভ নেই।

বাসস জানায়, প্রধানমন্ত্রী শনিবার চট্টগ্রামের আনোয়ারার কেইপিজেড মাঠে দেশের প্রথম কর্ণফুলী নদীর তলদেশ দিয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান টানেল উদ্বোধন উপলক্ষে আয়োজিত মহাসমাবেশে এ কথা বলেন। সমাবেশের আয়োজন করে চট্টগ্রাম উত্তর ও দক্ষিণ জেলা আওয়ামী লীগ, যা পরে জনসমুদ্রে রূপ নেয়।

AL.jpeg
ঢাকার বায়তুল মোকাররম মসজিদের দক্ষিণ গেটে আওয়ামী লীগের ‘শান্তি ও উন্নয়ন' সমাবেশের একাংশ। ২৮ অক্টোবর ২০২৩। [বেনারনিউজ]

রোববার আওয়ামী লীগের শান্তি সমাবেশ

বায়তুল মোকাররম জাতীয় মসজিদের উত্তর গেট এলাকায় শান্তি উন্নয়ন সমাবেশ করেছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ।

সমাবেশে দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেন, মহানগর, থানা, জেলা, উপজেলা, শহরসহ সারা দেশে রোববার শান্তি সমাবেশ করবে আওয়ামী লীগ।

বিএনপির হরতাল ঘোষণার প্রতিক্রিয়ায় তিনি বলেন, “আমি ঘোষণা দিচ্ছি, এদের এই নৈরাজ্যের হরতাল কেউ মানবে না। এই অস্ত্র ভোঁতা হয়ে গেছে। এই ভোঁতা অস্ত্রে কাজ হবে না। আমরা আগামীকাল (রোববার) মহানগর, থানা, জেলা, উপজেলা- সারা বাংলাদেশে শান্তি সমাবেশ করব।” 

BNP3.jpeg
ঢাকার কাকরাইল এলাকায় বিএনপি কর্মীদের সাথে পুলিশের সংঘর্ষ। ২৮ অক্টোবর ২০২৩। [বেনারনিউজ]

ভিসা নিষেধাজ্ঞার জন্য সহিংসতা পর্যালোচনা করবে যুক্তরাষ্ট্র

এদিকে এক বিবৃতিতে শনিবার ঢাকায় রাজনৈতিক সহিংসতায় এক পুলিশ সদস্য ও একজন রাজনৈতিক কর্মী হত্যা, হাসপাতাল পোড়ানো এবং সাংবাদিকসহ বেসামরিক নাগরিকদের বিরুদ্ধে ‘সহিংসতা’র ঘটনাকে “অগ্রহণযোগ্য” হিসেবে আখ্যায়িত করে নিন্দা জানিয়েছে ঢাকার যুক্তরাষ্ট্র দূতাবাস।

সংশ্লিষ্ট সব পক্ষকে শান্তি ও সংযমের আহ্বান জানিয়ে ওই বিবৃতিতে বলা হয়, “সম্ভাব্য ভিসা নিষেধাজ্ঞার জন্য আমরা সমস্ত সহিংস ঘটনার পর্যালোচনা করব।”

প্রসঙ্গত, বাংলাদেশে শান্তিপূর্ণ ও গণতান্ত্রিক নির্বাচন প্রক্রিয়াকে বাধাদানকারীদের ভিসা দেয়া হবে না বলে গত মে মাসে ঘোষণা দেয় যুক্তরাষ্ট্র, যা গত সেপ্টেম্বর থেকে কার্যকর করা শুরু করেছে দেশটি।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।