বিএনপির অভিযোগ, নেতাদের না পেয়ে তাঁদের স্বজনদের তুলে নিচ্ছে পুলিশ
2023.11.08
ঢাকা
বিএনপি নেতা-কর্মীদের বাসায় না পেয়ে পুলিশ তাঁদের স্বজনদের তুলে নিয়ে যাবার অভিযোগ করেছে বিএনপি। একইসঙ্গে সরকারের বিরুদ্ধে গুমের অভিযোগ তুলেছে বিরোধী জোট। তাদের ভাষ্য, কয়েকজন নেতাকে সাদা পোশাকে পুলিশ পরিচয়ে বাসা থেকে তুলে নিয়ে আদালতে হাজির করা হয়নি। এমনকি তাঁদের খোঁজও পাওয়া যাচ্ছে না।
গত ২৮ অক্টোবর বিএনপির ডাকা ঢাকা মহাসমাবেশকে কেন্দ্র করে সহিংসতার পর বুধবার পর্যন্ত সারা দেশে বিএনপির সাড়ে নয় হাজার নেতা-কর্মীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে বলে দলটি জানিয়েছে।
বিএনপিসহ বিরোধী দলগুলোর আহ্বানে বুধবার সারাদেশ অবরোধ কর্মসূচি পালন করা হয়েছে, শুক্রবার ভোর ছয়টায় শেষ হবে টানা ৪৮ ঘণ্টার অবরোধ। কারা কর্তৃপক্ষের হিসাব অনুসারে, দেশের সবগুলো কারাগারে বর্তমানে ধারণ ক্ষমতার দ্বিগুণ বন্দি রয়েছেন।
ব্যাপকহারে বিরোধী নেতা-কর্মীদের গ্রেপ্তারে উদ্বেগ জানিয়েছে জাতিসংঘ, যুক্তরাষ্ট্র, হিউম্যান রাইটস ওয়াচ ও অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালসহ বিভিন্ন মানবাধিকার সংগঠন।
এদিকে বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াকে দেশের বাইরে জরুরি চিকিৎসার জন্য মুক্তি দিতে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক প্রধান ভলকার তুর্ক।
গুমের অভিযোগ
বিরোধী দলীয় কয়েক জন নেতাকে পুলিশ পরিচয়ে তুলে নিয়ে যাওয়ার পরও আদালতে হাজির না করায় সরকারের বিরুদ্ধে নতুন করে গুম শুরু করার অভিযোগ তুলেছে বিএনপি।
বুধবার ও গত মঙ্গলবার সংবাদ সম্মেলনে দলটির পক্ষ থেকে অন্তত তিন জন ছাত্রনেতাকে গুম করার অভিযোগ তোলা হয়।
যোগাযোগ করা হলে বিএনপির জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী বেনারকে বলেন, “গত কয়েক দিনে আমাদের কয়েকজন নেতাকে তুলে নিয়ে যাওয়া হলেও আদালতে তোলা হয়নি।”
তিনি বলেন, “আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা গত ৬ নভেম্বর রাজধানীর মৌচাক মার্কেট এলাকা থেকে কবি নজরুল সরকারি কলেজ ছাত্রদলের সহসভাপতি আবুল হোসেন জুয়েলকে তুলে নিয়ে গেছে। এখন পর্যন্ত তাঁর খোঁজ পাওয়া যায়নি।
“সরকারি তিতুমীর কলেজ শাখা ছাত্রদলের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহমুদুল হাসান রফিক ও সাইফুল ইসলামকে সোমবার সন্ধ্যায় গোয়েন্দা পুলিশ পরিচয়ে তুলে নিয়ে গেছে। পরবর্তীতে ভোর ৪টার দিকে পুলিশ তাদের মিরপুর-১২ নম্বরের বাসায় নিয়ে যায় এবং ২৮ অক্টোবর মহাসমাবেশের দিন তারা কোন পোশাক এবং কোন জুতা পরেছিল—সেগুলো এবং পাসপোর্ট ও অন্যান্য কাগজপত্র সংগ্রহ করে,” বলেন রিজভী।
তাঁর দাবি, ছাত্রদলের এই দুই নেতার হদিস পাওয়া যাচ্ছে না।
রিজভী আরও জানান, গত ১ নভেম্বর ঢাকা মহানগর দক্ষিণ যুবদলের আওতাধীন মুগদা থানার ৭ নম্বর ওয়ার্ডের সদস্য সচিব মো. মাসুদ রানাকে ধলপুর সুতি কালভার্ট রোড এলাকা থেকে সাদা পোশাকে পুলিশের গোয়েন্দা শাখার (ডিবি) একটি দল সাদা মাইক্রোবাসে উঠিয়ে যায়। তাঁরও খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে না।
বিরোধী নেতাদের তুলে নিয়ে গুম করার অভিযোগের ব্যাপারে জানতে চাইলে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান বেনারকে বলেন, “কাউকে গুম করা হচ্ছে—এই অভিযোগ মোটেও সত্য নয়। রাজনৈতিক সুবিধা হাসিলের জন্য বিএনপি এমন অভিযোগ করে থাকতে পারে।”
বুধবার এক বিবৃতিতে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেছেন, “বিএনপির গণতান্ত্রিক পন্থায় আন্দোলন করার শক্তি ও সামর্থ্য নেই বলেই তারা অগ্নি সন্ত্রাসের পথ বেছে নিয়েছে। গ্রেপ্তার এড়াতে তারা নিজেরাই আত্মগোপনে থেকে গুমের মিথ্যা অভিযোগ করছে।”
নেতাদের না পেয়ে স্বজনকে নিয়ে যাচ্ছে পুলিশ
চলমান পুলিশি অভিযানের অধিকাংশই পরিচালিত হচ্ছে রাতে। গ্রেপ্তার এড়াতে বিএনপি নেতাদের অধিকাংশই নিজেদের বাড়িতে থাকছেন না। এমন পরিস্থিতিতে নেতাদের না পেয়ে স্বজনদের তুলে নিয়ে যাওয়া এবং নানা রকম হয়রানির অভিযোগ উঠেছে।
এ প্রসঙ্গে রিজভী বলেন, “টার্গেটকৃত ব্যক্তিদের বাসায় গিয়ে না পেয়ে তাদের পিতা, ভাই কিংবা অন্য সদস্যদের অন্যায়ভাবে আটক করে নিয়ে যাচ্ছে পুলিশ।”
তিনি জানান, গত ৩১ অক্টোবর রাতে কিশোরগঞ্জে পৌর বিএনপির সভাপতি ও জেলা বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক আমিনুল ইসলাম আশফাককে ধরতে তাঁর বাসায় অভিযান চালায় পুলিশ। তাঁকে না পেয়ে তাঁর কলেজ পড়ুয়া দুই যমজ ছেলেকে ধরে নিয়ে গেছে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে কিশোরগঞ্জ সদর মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মোহাম্মদ দাউদ গণমাধ্যমকে বলেন, হরতাল ও অবরোধের সময় হামলা ও ভাঙচুরের মামলায় সুনির্দিষ্ট অভিযোগের ভিত্তিতে আশফাকের দুই ছেলেকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ।
তবে আশফাকের স্ত্রী নাজমা ইসলাম সাংবাদিকদের বলেন, “আমাদের ছেলেরা রাজনীতির সাথে যুক্ত নয়। তাঁদের বাবাকে গ্রেপ্তার করতে না পেরে পুলিশ ছেলেদের ধরে নিয়ে গেছে।”
রিজভী আরও জানান, গত ৩০ অক্টোবর ছাত্রদলের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সাবেক সদস্য সচিব মো. আমানউল্লাহ আমানকে ধরতে পুলিশ তাঁর ঢাকার মিরপুরের বাসায় অভিযান চালায়। তাঁকে না পেয়ে তাঁর বড়ো ভাই শহীদুল্লাহ মুছুল্লীকে ধরে নিয়ে যায়।
এর আগে বিএনপি নেতা আব্দুল আউয়াল মিন্টুকে না পেয়ে তাঁর ছেলে ইশরাক হোসেনকে গ্রেপ্তারের চেষ্টা করে পুলিশ, পরে ইশরাককে না পেয়ে তাঁর ছোট ভাই ইশফাক হোসেনকে তুলে নিয়ে যায়।
রিজভীর দাবি, নেতাদের বাড়িতে অভিযান চালানোর সময় অত্যাচারও করা হয়েছে।
এ প্রসঙ্গে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, “কোনো নিরপরাধ ব্যক্তিকে আমাদের বাহিনী গ্রেপ্তার করছে না। যাদের বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ ও ওয়ারেন্ট রয়েছে তাঁদের গ্রেপ্তার করা হচ্ছে।”
‘সরকার বেআইনি কাজ করছে’
গ্রেপ্তার অভিযানে নেতাদের না পেয়ে তাদের স্বজনদের গ্রেপ্তার প্রসঙ্গে আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) নির্বাহী পরিচালক ফারুখ ফয়সল বেনারকে বলেন, কোনো মামলার আসামিকে বা সন্দেহভাজন ব্যক্তিকে ধরতে গিয়ে তাঁকে না পেয়ে স্বজনদের ধরে নিয়ে যাওয়ার কোনো আইন বাংলাদেশে নেই।
“এভাবে বিরোধী নেতা-কর্মীদের স্বজনদের গ্রেপ্তার করে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা পরিষ্কার বেআইনি কাজ করছেন। এটার জন্য সরকারের উচিত তাদেরকে জবাবদিহিতার আওতায় নিয়ে আসা,” বলেন এই মানবাধিকারকর্মী।
তিনি বলেন, “সরকারের উচিত আইনের শাসন নিশ্চিত করা, দুর্ভাগ্যবশত বাংলাদেশে সেটা অনুপস্থিত।”
বিরোধী নেতাদের গুমের অভিযোগ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, “গুমের অভিযোগ উদ্বেগজনক। এর জন্য আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী দায়ী। সরকারকে প্রতিটি অভিযোগ অনুসন্ধান করতে হবে।”
এদিকে বাংলাদেশে ব্যাপকহারে গ্রেপ্তারসহ সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ে আবারও উদ্বেগ প্রকাশ করেছে জাতিসংঘ।
মঙ্গলবার জাতিসংঘ সদর দপ্তরে আয়োজিত নিয়মিত ব্রিফিংয়ে সংস্থাটির মহাসচিবের মুখপাত্র স্টিফেন ডুজারিক উদ্বেগ প্রকাশ করেন।
খালেদাকে মুক্তি দিতে প্রধানমন্ত্রীকে জাতিসংঘের মানবাধিকার প্রধানের চিঠি
বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াকে দেশের বাইরে জরুরি চিকিৎসার জন্য মুক্তি দিতে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক প্রধান ভলকার তুর্ক।
খালেদা জিয়ার চিকিৎসকরা দাবি করেছেন, হাসিনা সরকার খালেদাকে ছেড়ে দেওয়ার আবেদন প্রত্যাখ্যান করায় সাবেক এই প্রধানমন্ত্রী চিকিৎসা ছাড়াই মারা যাওয়ার ‘উচ্চ ঝুঁকিতে’ রয়েছেন।
বার্তা সংস্থা এফপি এক প্রতিবেদনে বলেছে, জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক হাইকমিশনার তুর্কি হাসিনাকে লেখা চিঠিতে বলেছেন, খালেদা জিয়ার মুক্তিকে “রাজনৈতিক সংলাপ ও সমঝোতার দিকে একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ” হিসেবে দেখা হবে।
“আমি আপনার সরকারের কাছে তাঁর (খালেদার) মুক্তির বিষয়টি বিবেচনা করার জন্য আবেদন করছি, যাতে তিনি দেশের বাইরে জরুরি এবং বিশেষায়িত চিকিৎসা সেবা পেতে পারেন,” শেখ হাসিনাকে পাঠানো চিঠিতে ১ নভেম্বর তুর্ক এ কথা বলেছেন।
খালেদা জিয়ার লিভার সিরোসিস, ডায়াবেটিস ও হার্টের সমস্যায় হাসপাতালে ভর্তি রয়েছেন।