ঢাকায় বিএনপির সমাবেশের স্থান বিতর্কে মুখোমুখি সরকার ও বিরোধীদল
2022.11.30
ঢাকা
বাংলাদেশের প্রধান বিরোধী দল বিএনপির ১০ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিতব্য সমাবেশস্থল নিয়ে রাজনীতিতে শুরু হয়েছে উত্তাপ। ঢাকার নয়াপল্টনে দলীয় কার্যালয়ের সামনে সমাবেশ করার বিষয়ে বিএনপি অনড় থাকার কথা বললেও পুলিশের পক্ষ থেকে ঠিক করে দেয়া হয়েছে শহীদ সোহরাওয়ার্দী উদ্যান।
বিএনপি বলছে, ১০ ডিসেম্বর ঢাকায় অনুষ্ঠিতব্য মহাসমাবেশে লাখ লাখ মানুষ অংশ নেবে এবং সেখানে থেকেই সরকারকে পদত্যাগের আল্টিমেটাম দেয়া হবে।
দলের এই সিদ্ধান্তের কথা জানিয়ে বুধবার বিএনপির এক বিক্ষোভ সমাবেশে দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, নয়াপল্টনেই সমাবেশের অনুমতি দিতে হবে। সরকারকে সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করতে হবে।
“আমার মনে হয় না সরকার সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করবে। তাদের (বিএনপি) সোহরাওয়ার্দী উদ্যানেই সমাবেশ করতে হবে,” বিএনপির দাবি সম্পর্কে বুধবার বেনারকে বলেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান।
“তারা যদি কোনো প্রকার নৈরাজ্য সৃষ্টি করতে চায়, তাহলে ভুল করবে। নৈরাজ্য সৃষ্টি করলে আমরা বসে থাকব না,” বলেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী।
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর পাশাপাশি এ বিষয়ে বুধবার বিএনপিকে হুশিয়ার করেছেন সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের এবং তথ্য ও সম্প্রচারমন্ত্রী হাছান মাহমুদ। তাঁরা বলছেন, সোহরাওয়ার্দী উদ্যানেই বিএনপিকে সমাবেশ করতে হবে।
সোহরাওয়ার্দীতে ‘কমফোর্টেবল’ নয় বিএনপি
সরকার নির্ধারিত সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে সমাবেশ করতে রাজি নয় বিএনপি। বুধবার নয়াপল্টনে দলীয় কার্যালয়ের সামনে অনুষ্ঠিত এক বিক্ষোভ সমাবেশে দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর সরকারের উদ্দেশ্যে বলেন, “আপনারা যে জায়গা দিতে চান সেই জায়গায় আমরা কমফোর্টেবল নই; খুব পরিষ্কার কথা। চারদিকে দেয়াল দিয়ে ঘেরা, চতুর্দিকে যাওয়ার রাস্তা নেই। একটা মাত্র গেইট, যে গেইট দিয়ে এক-দুই জন মানুষ ঢুকতে পারে, বের হতে পারে না।”
তিনি বলেন, “আমরা পরিষ্কার করে আবার বলছি, আপনাদের এই সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করুন। ...নয়া পল্টনে আমাদের ১০ তারিখ শান্তিপূর্ণ সমাবেশ করার সমস্ত ব্যবস্থা আপনারা গ্রহণ করুন।”
“তা না হলে সব দায়দায়িত্ব আপনাদের,” বলেন মির্জা ফখরুল।
তথ্য ও সম্প্রচারমন্ত্রী হাছান মাহমুদ বুধবার সাংবাদিকদের বলেন, ১০ ডিসেম্বর বিএনপি ঢাকায় ১০ লাখ লোকের সমাবেশ ঘটানোর কথা জানিয়েছে। দলীয় কার্যালয়ের সামনে সভা করলে সেখানে লাখ লাখ মানুষ অংশ নিতে পারবে না।
তিনি বলেন, “তারা যাতে ভালোভাবে রাজনৈতিক কর্মসূচি পালন করতে পারে, সেজন্য তাদের সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে সমাবেশের অনুমতি দেয়া হয়েছে।”
মন্ত্রী আরও বলেন, “দলীয় কার্যালয়ের সামনে সভা করতে চাওয়ার কারণ হলো তারা লাঠিসোটা, অস্ত্র নিয়ে নৈরাজ্য সৃষ্টি করতে চায়।”
তবে সমাবেশের দিন নৈরাজ্য সৃষ্টির অভিযোগ সম্পর্কে সরকারি দলের নেতাদের মন্তব্যকে “মনগড়া অভিযোগ” বলে আখ্যায়িত করেছেন বিএনপির কেন্দ্রীয় কমিটির প্রচার সম্পাদক শহীদ উদ্দিন চৌধুরী এ্যানি।
বুধবার তিনি বেনারকে বলেন, “আমরা ছয়টি বিভাগে মহাসমাবেশ করেছি। তারা (সরকার) বাস, লঞ্চ, ট্রেন সব বন্ধ করে দিয়েছে। তারপরও লাখ লাখ মানুষ আমাদের মহাসমাবেশে যোগ দিয়েছে। কোথাও কোনো সহিংসতা হয়নি।”
শুধুই নয়া পল্টনে সমাবেশ করার জন্য পুলিশের কাছে আবেদন কর হয়েছে জানিয়ে এ্যানি বলেন, “কিন্তু তারা চালাকি করে আমাদের সোহরাওয়ার্দী উদ্যান বরাদ্দ দিয়েছে। সেখানে দেয়ার কারণ হলো তারা আমাদের জন্য কোনো একটা ফাঁদ পেতে রেখেছে, যাতে আমরা সমাবেশ না করতে পারি।”
তিনি বলেন, “১১ তারিখে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে যুবলীগের কর্মসূচি রয়েছে। তারা যদি তাদের কর্মসূচি আগে নিয়ে আসে সেক্ষেত্রে সমস্যা দেখা দেবে। সেজন্যই আমরা নয়াপল্টনে সমাবেশ করতে চাই।”
“নয়াপল্টন দলীয় কার্যালয়ের সামনে লাখ লাখ মানুষের অংশগ্রহণে আমরা কর্মসূচি পালন করেছি। সেখানে কোনো সমস্যা হয়নি,” বলেন এ্যানি।
নয়াপল্টনে জনসভা হলে সারা ঢাকা শহর যানজটে স্থবির হয়ে পড়বে কি না এমন প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, “সেদিন শনিবার। ছুটির দিন। সেদিন যানজট হলে হবে। আওয়ামী লীগ রাস্তায় সমাবেশ করতে পারে তাতে কোনো সমস্যা হয় না। আর আমরা সমাবেশ করলে যানজট হয়, সমস্যা হয়।”
দুই দলের সমঝোতা দরকার
আগামী ১০ ডিসেম্বর নয়া পল্টনে সমাবেশ করার অনুমতি চাইলেও মঙ্গলবার বিএনপিকে ২৬টি শর্তে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে সমাবেশ করার অনুমতি দিয়েছে ঢাকা মহানগর পুলিশ (ডিএমপি)।
নয়া পল্টনে সমাবেশ করলে ‘যানজট ও জনদুর্ভোগ’ সৃষ্টি হবে জানিয়ে ওই দিন সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে দুপুর ১২টা থেকে বিকেল সাড়ে ৪টার মধ্যে সমাবেশ করার নির্দেশ দেয় পুলিশ।
পুলিশের পক্ষ থেকে বিএনপিকে দেয়া অন্য শর্তগুলোর মধ্যে রয়েছে, উদ্যানের সীমানার বাইরে জনসমাবেশ না করা, সমাবেশ শুরুর দুই ঘণ্টা আগে দলীয় নেতাকর্মীদের সমাবেশস্থলে প্রবেশের অনুমতি দেওয়া এবং কাউকে মিছিলসহ সমাবেশে যোগ না দেওয়া।
বিএনপির সমাবেশকে কেন্দ্র করে সরকার ও বিরোধী দলের বিরোধপূর্ণ অবস্থানে “সাধারণ মানুষের মধ্যে ভয়-ভীতির সঞ্চার হচ্ছে,” বলে বুধবার বেনারের কাছে মন্তব্য করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. শান্তনু মজুমদার।
তিনি বলেন, “বিরোধীদল হিসাবে বিএনপির কিছু শঙ্কা আছে থাকবে। কিন্তু সরকারের উচিত তাদের সেই শঙ্কাকে দূর করা। সরকারের উচিত বিরোধী দলের সভা যেন শান্তিপূর্ণভাবে হয় সেই ব্যবস্থা করা।”
ড. শান্তনু মজুমদার বলেন, “পুলিশের পক্ষ থেকে বিএনপির সমাবেশের জন্য যে ২৬ দফা শর্ত দেয়া হয়েছে সেটি আমার কাছে অনেক বেশি মনে হয়েছে। এটি বাস্তবায়ন করতে গেলে বিএনপিকে কয়েক কোটি টাকা খরচ করতে হবে এবং এগুলো বাস্তবসম্মত নয়।”
তবে তাঁর মতে, রাজনৈতিক কর্মসূচি কোন জায়গায় করা যাবে, সেব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেয়ার সময় এসেছে। রাস্তাঘাটে রাজনৈতিক কর্মসূচি পালন করা হলে সারা ঢাকা এমনকি আশপাশের অঞ্চলে এর প্রভাব পড়ে। জনজীবন স্থবির হয়ে পড়ে।
তিনি বলেন, সমাবেশকে নিয়ে সরকার ও বিরোধীদলের মুখোমুখি অবস্থান ‘সহিংস পরিস্থিতি’ তৈরি করতে পারে, যা কোনোভাবেই কাম্য নয়।
“এখনও সময় আছে, দুই দলের নেতারা আলাপ আলোচনার মাধ্যমে একটি সমাধান বের করতে পারেন,” মন্তব্য করে শান্তনু মজুমদার বলেন, “শেষ মুহূর্তে হয়তো দুই দলের মধ্যে একটি সমঝোতা হবে এবং সম্ভাব্য সহিংস পরিস্থিতি এড়ানো যাবে।”
নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানের দাবিতে দেশের সকল বিভাগে মহাসমাবেশ করে আসছে বিএনপি। সর্বশেষ সিলেট বিভাগে মহাসমাবেশ করেছ দলটি।
৩ ডিসেম্বর রাজশাহীতে বিভাগীয় মহাসমাবেশ অনুষ্ঠিত হবে। এরপর ১০ ডিসেম্বর ঢাকায় বিভাগীয় সমাবেশ অনুষ্ঠিত হবে, যেটি সবচেয়ে বড় কর্মসূচি বলে ধারনা করা হচ্ছে।