বিএনপির ঢাকা সমাবেশের আগে পুলিশের বিশেষ অভিযান ঘিরে প্রশ্ন
2022.12.02
ঢাকা

ঢাকায় বাংলাদেশের প্রধান বিরোধী দল বিএনপির আসন্ন গণসমাবেশের জন্য নির্ধারিত ১০ ডিসেম্বর যখন এগিয়ে আসছে তখন পুলিশের একটি বিশেষ অভিযান শুরু করা নিয়ে নানা প্রশ্ন উঠেছে।
গত ১ ডিসেম্বর থেকে শুরু হওয়া এই বিশেষ অভিযানের উদ্দেশ্য হিসেবে পুলিশ বলছে, গত ২০ নভেম্বর ঢাকার একটি আদালত এলাকা থেকে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত দুই জঙ্গি ছিনতাইয়ের ঘটনাকে বিবেচনায় রেখে এবং বিজয় দিবস, বড়দিন এবং থার্টিফার্স্ট নাইট উদযাপন নিরাপদ ও নির্বিঘ্ন করার লক্ষ্যে ১৫ ডিসেম্বর পর্যন্ত চলবে এই অভিযান।
অপরদিকে বিরোধী দল ও রাজনৈতিক বিশ্লেষকেরা বলছেন, বিএনপির সমাবেশকে সামনে রেখে জনমনে ভীতি তৈরি এবং দলটিকে রাজনৈতিকভাবে দুর্বল করার একটি প্রচেষ্টা এই অভিযানের নেপথ্য কারণ।
“এই অভিযানের সঙ্গে বিএনপির সমাবেশের কোনো সম্পর্ক নেই এবং এটি পুলিশের স্বাভাবিক কর্মকাণ্ডের একটি অংশ,” সাংবাদিকদের বলেন পুলিশ সদর দপ্তরের মিডিয়া অ্যান্ড পাবলিক রিলেশনস বিভাগের সহকারী মহাপরিদর্শক (এআইজি) মো. মনজুর রহমান।
তাঁর দাবি, এটি বিশেষ কোনো অভিযান নয়, বুদ্ধিজীবী দিবস ও বিজয় দিবসসহ ডিসেম্বরের গুরুত্বপূর্ণ অনুষ্ঠানগুলোকে সামনে রেখে যে কোনো ধরনের অপ্রীতিকর ঘটনা এড়াতে এটি পুলিশের রুটিন ওয়ার্ক।
পুলিশের এই বক্তব্য পুরোপুরি অসত্য এবং মূল ঘটনাকে আড়ালের চেষ্টা মনে করেন ঢাকা মহানগর দক্ষিণ বিএনপির আহবায়ক আবদুস সালাম।
“গত বছরগুলোতে পুলিশ তাহলে কেন এই ধরনের কোনো অভিযান পরিচালনা করেনি?” প্রশ্ন করে তিনি বলেন, “রাজনৈতিক উদ্দেশ্য হাসিলের সহায়ক ভূমিকা থেকে পুলিশের বেরিয়ে আসা উচিত।”
এই উদ্যোগ ‘আতঙ্ক সৃষ্টি করবে’
১৫ দিনের এই বিশেষ অভিযান পরিচালনার জন্য প্রয়োজনীয় নির্দেশনা দিয়ে পুলিশ সদর দপ্তর দেশের সকল ইউনিটকে যে চিঠি পাঠিয়েছে তার একটি কপি বেনারের হাতে এসেছে।
পুলিশ সদর দপ্তরের অতিরিক্ত ডিআইজি মো. হাসানুজ্জামানের সই করা চিঠিতে বলা হয়েছে, ১৫ ডিসেম্বর পর্যন্ত সারা দেশে “বিশেষ অভিযান” পরিচালনার সময় অন্যান্য স্থানের পাশাপাশি আবাসিক হোটেল, মেস, হোস্টেল, বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান, কমিউনিটি সেন্টারসহ “অপরাধীদের লুকিয়ে থাকার সম্ভাব্য স্থানগুলোতে কার্যকর অভিযান পরিচালনা করতে হবে।”
রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও শাসন বিশেষজ্ঞ তোফায়েল আহমেদের মতে, “পুলিশের এই উদ্যোগ জনমনে আতঙ্ক সৃষ্টি করবে।”
“রাজনৈতিক সমাবেশকে সামনে রেখে পুলিশ যে অভিযান শুরু করেছে এটার মাধ্যমে পুলিশের রাজনৈতিক ব্যবহারেরই প্রতিফলন ঘটল,” বেনারকে বলেন তোফায়েল আহমেদ।
তিনি বলেন, পুলিশের উচিত রাজনৈতিক দল বা ক্ষমতাসীনদের সহায়ক না হয়ে জনগণের মধ্যে যাতে রাজনৈতিক কর্মসূচি নিয়ে কোনো ভীতিকর পরিস্থিতি তৈরি না হয় সে দিকে মনোযোগী হওয়া।
তবে পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক (আইজিপি) একেএম শহীদুল হক মনে করেন এই অভিযানের ফলে আতঙ্কিত হবার কোনো কারণ নেই।
“এই অভিযানের সঙ্গে একটি রাজনৈতিক সমাবেশকে সম্পৃক্ত করার কিছু নেই,” বলেন শহীদুল।
সাবেক এই পুলিশ প্রধান এই অভিযানকে বিএনপির সমাবেশের সঙ্গে সম্পৃক্ত না করার পরামর্শ দিলেও বিএনপি নেতা আবদুস সালাম দাবি করেছেন দলটির ঢাকা বিভাগীয় সমাবেশকে কেন্দ্র করে শুধু গত তিন দিনে (বুধ থেকে বৃহস্পতিবার) রাজধানীতেই পাঁচ শতাধিক বিএনপি নেতাকর্মী পুলিশের অভিযানে গ্রেপ্তার হয়েছেন।
“পুলিশকে অবশ্যই বিএনপি দমনের এই মনোভাব পরিহার করে ন্যায়সঙ্গত রাজনৈতিক সভা সমাবেশের সুযোগকে অবাধ করতে হবে,” বলেন সালাম।
পুলিশকে ‘গায়েবি’ মামলার তালিকা দিলো বিএনপি
রাজনৈতিক নিপীড়নমূলক বেআইনি, মিথ্যা ও ‘গায়েবি’ মামলা বন্ধের আহবান এবং ইতোমধ্যে দায়েরকৃত মামলা প্রত্যাহারের দাবি জানিয়ে পুলিশের মহাপরিদর্শককে (আইজিপি) একটি চিঠি দিয়েছে বিএনপি।
বৃহস্পতিবার দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর স্বাক্ষরিত চিঠি ও সাম্প্রতিক মামলাগুলোর একটি তালিকা বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান বরকত উল্লাহ বুলুর নেতৃত্বে একটি প্রতিনিধি দল পুলিশ সদর দপ্তরে আইজিপির হাতে তুলে দেন বলে বেনারকে নিশ্চিত করেন বিএনপির প্রচার সম্পাদক শহীদ উদ্দীন চৌধুরী এ্যানি।
এ বিষয়ে এআইজি মনজুর গণমাধ্যমকে বলেছেন, পুলিশ প্রধান বিএনপির চিঠি পেয়েছেন এবং যাচাই বাছাই করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেবেন।
পুলিশের কাছে দেয়া তালিকায় বিএনপি বলেছে, “গত আগস্ট থেকে ২৬ নভেম্বর পর্যন্ত ১৬৯টি গায়েবি ও মিথ্যা মামলা হয়েছে দলটির নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে। সেখানে নাম ধরে আসামি করা হয়েছে ছয় হাজার ৭২৩ জনকে এবং বেনামে আসামি করা হয়েছে আরও ১৫ হাজার ৫০ জনকে।”
গণমাধ্যমে প্রকাশিত খবরের বরাত দিয়ে চিঠিতে বলা হয়, “চলতি মাসেই পুলিশ বাহিনী যে গায়েবি মামলা করেছে, সেসব মামলার সব আসামি বিএনপির নেতাকর্মী।”
“ঢাকার প্রতিটি ওয়ার্ডে বিএনপি ও এর অঙ্গসংগঠনের নেতাকর্মীদের বিস্তারিত তথ্যসহ তালিকা প্রস্তুত করেছে ঢাকা মহানগর পুলিশ। সম্প্রতি পুলিশ কর্তৃক রাজনৈতিক নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে গায়েবি মিথ্যা মামলা দায়ের এবং মানবাধিকার লঙ্ঘন চরমতম পর্যায়ে পৌঁছেছে,” বলা হয় বিএনপির চিঠিতে।
প্রসঙ্গত, গত ১২ অক্টোবর থেকে দেশের বড় শহরগুলোতে প্রতি শনিবার বিভাগীয় গণসমাবেশ করে আসছে বিএনপি। আগামী ১০ ডিসেম্বর ঢাকায় দশম গণসমাবেশের মধ্য দিয়ে সরকার বিরোধী এই সমাবেশ শেষ করার ঘোষণা দিয়েছে দলটি। তবে সভার স্থান নিয়ে ইতোমধ্যে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ও বিএনপি মুখোমুখি অবস্থানে পৌঁছেছে।
আওয়ামী লীগ নেতারা ও পুলিশ বিএনপিকে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে সমাবেশ করতে বললেও নয়াপল্টন দলীয় কার্যালয়ের সামনে সমাবেশ করার বিষয়ে অনড় বিএনপি।