বিএনপি-পুলিশ সংঘর্ষে দলীয় কর্মী নিহত, আহত শতাধিক
2022.12.07
ঢাকা

পুলিশের সাথে সংঘর্ষে বাংলাদেশের প্রধান বিরোধী দল বিএনপির এক কর্মী নিহত এবং আহত হয়েছেন শতাধিক।
বিএনপির আসন্ন ঢাকা বিভাগীয় গণসমাবেশের তিন দিন আগে বুধবার রাজধানীর নয়াপল্টন এলাকায় দলটির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে অভিযান চালিয়ে বেশ কয়েকজন কেন্দ্রীয় নেতাসহ পাঁচ শতাধিক কর্মীকে পুলিশ গ্রেপ্তার করেছে বলে সংবাদমাধ্যমকে জানান বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর।
গ্রেপ্তারের বিষয়ে কোনো তথ্য প্রকাশ না করলেও পুলিশের তথ্য অনুযায়ী জাতীয়তাবাদী স্বেচ্ছাসেবক দলের কর্মী মকবুল হোসেন (৪৩) গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা গেছেন।
“মকবুলের পিঠে বেশ কয়েকটি ছররা গুলির আঘাত ছিল। তাঁকে মৃত অবস্থায় হাসপাতালে আনা হয়,” বেনারকে বলেন ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ পরিদর্শক বাচ্চু মিয়া।
বিএনপির কার্যালয়ে প্রায় তিন ঘণ্টা অভিযান শেষে পুলিশের পক্ষ থেকে দাবি করা হয়, দলটির অফিস থেকে বিপুল পরিমাণ বোমা তৈরির সরঞ্জাম উদ্ধার করা হয়েছে।
রাত সাড়ে আটটার দিকে অভিযান শেষে ঢাকা মহানগর পুলিশের যুগ্ম কমিশনার (অপারেশন) বিপ্লব কুমার সরকার গণমাধ্যমকে বলেন, “আজ দুপুর থেকে এখানে অবস্থান করেছে পুলিশ। কাউকে কোনোরকম উসকানি দেয়নি। এর পরও পুলিশকে লক্ষ্য করে ইট পাটকেল ছোড়া হয়েছে।”
বিএনপি অফিসের তিন তলা থেকে হাতবোমা ও ককটেল নিক্ষেপ করা হয়েছে দাবি করে তিনি বলেন, এতে পুলিশের অসংখ্য সদস্য আহত হয়েছেন।
“এরপর পুলিশ শান্তি শৃঙ্খলা ও জননিরাপত্তা নিশ্চিত করতে অভিযান চালিয়েছে। বিএনপির পার্টি অফিস থেকে বিপুল পরিমাণে বিস্ফোরক, বোমা ও ককটেল উদ্ধার করা হয়েছে,” বলেন বিপ্লব।
তবে বিকেলে এই অভিযান চলাকালে মির্জা ফখরুল সাংবাদিকদের কাছে অভিযোগ করেন, “পুলিশ ব্যাগে বোমা নিয়ে দলীয় অফিসে প্রবেশ করেছে। বোমা উদ্ধারের নাটক করে আমাদের কর্মীদের গ্রেপ্তার করা হবে।”
বিএনপি নেতারা জানান, অ্যাসল্ট রাইফেল, জলকামান ও সশস্ত্র শত শত পুলিশ দাঙ্গা সরঞ্জাম নিয়ে দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয় ও সংলগ্ন এলাকায় অভিযান চালিয়ে বিরোধী দলের নেতাকর্মীদের ওপর হামলা চালায়।
অভিযান শুরুর পর কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে উপস্থিত হয়ে বিএনপি মহাসচিব ফখরুল বলেন, পুলিশ কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে তালা দিয়ে তল্লাশি চালাচ্ছে এবং তাঁকে কার্যালয়ে ঢুকতে দেওয়া হচ্ছে না।
১০ ডিসেম্বরের ঢাকা বিভাগীয় সমাবেশ বানচাল করার জন্য বিএনপি নেতাকর্মীদের ওপর পুলিশ হামলা করেছে দাবি করে তিনি বলেন, “এটা মানবাধিকারের চূড়ান্ত লঙ্ঘন।”
এ সময় তিনি দলীয় কার্যালয়ের সামনে ফুটপাতে বসে পড়েন। সেখানেই থাকেন রাত আটটা পর্যন্ত।
বেশিরভাগই ছররা গুলিতে আহত
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, নয়াপল্টন দলীয় কার্যালয়ের সামনে, ভেতরে ও গলিতে জড়ো হওয়া নেতাকর্মীদের ছত্রভঙ্গ করতে পুলিশ কয়েকশ রাউন্ড গুলি ও কাঁদানে গ্যাসের শেল নিক্ষেপ করে।
এছাড়া বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী, ঢাকা দক্ষিণ মহানগর শাখার আহবায়ক আবদুস সালাম ও উত্তর মহানগর শাখার আহবায়ক আমান উল্লাহ আমান, দলের কেন্দ্রীয় নেতা খায়রুল কবির খোকনসহ শতাধিক নেতাকর্মীকে আটক করেছে পুলিশ।
দলীয় কার্যালয় থেকে বেশ কয়েকজন নারী কর্মীসহ পাঁচ শতাধিক নেতাকর্মীকে আটক করা হয়েছে বলে দাবি করেছেন ফখরুল।
বুধবার নিহত মকবুলসহ জুলাইয়ের শেষ থেকে এ পর্যন্ত ঢাকা, ভোলা, নারায়ণগঞ্জ, মুন্সীগঞ্জ, যশোর ও ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় পুলিশের গুলিতে বিএনপির অন্তত সাত নেতাকর্মী নিহত হয়েছেন বলে জানিয়েছে বিএনপি।
পায়ে ও হাতে পুলিশের গুলিতে আহত যুবদল কর্মী মোহাম্মদ রশিদ ঢাকা মেডিকেলে বেনারকে জানান, সকাল থেকে নয়াপল্টন কার্যালয়ের সামনে কয়েকশ বিএনপি নেতাকর্মী জড়ো হয়ে স্লোগান দিচ্ছিল।
শতাধিক পুলিশ বিএনপি নেতাকর্মীদের ওপর বিনা উসকানিতে হামলা করে জানিয়ে রশিদ বলেন, “দুপুর ২টা ৪৫ মিনিটের দিকে তারা কোনো উসকানি ছাড়াই নেতাকর্মীদের ওপর লাঠিচার্জ, ছররা গুলি ও কাঁদানে গ্যাসের শেল ছুড়তে থাকে।”
পুলিশ হামলা করলে দলীয় কার্যালয়ের ভেতরে কয়েকশ নেতাকর্মী আশ্রয় নেন জানিয়ে তিনি বলেন, পুলিশ সদস্যরা অফিসের নিচতলায় ঢুকে গুলি চালায় এবং সেখানেই আহত হন মকবুলসহ অনেকে।
নয়াপল্টন থেকে প্রায় ২৫ জনকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়েছে এবং তাদের বেশিরভাগই ছররা গুলিতে আহত হয়েছেন বলে জানান পুলিশ পরিদর্শক বাচ্চু।
অপরদিকে কাকরাইল ইসলামী ব্যাংক কেন্দ্রীয় হাসপাতালের জরুরি ওয়ার্ডের মেডিকেল অফিসার জামাল হোসেন বেনারকে বলেছেন, ছররা গুলিতে আহত দশ জনেরও বেশি বিএনপি কর্মী সেখানে চিকিৎসা নিয়েছেন।
বিএনপি নেতাকর্মীরা জানান, পুলিশ দলীয় কার্যালয়ে কয়েক ডজন কাঁদানে গ্যাসের শেল ছুড়েছে এবং সেখানে আটকে পড়া অনেক নেতাকর্মী অসুস্থ হয়ে পড়েন।

‘রাজপথে সমাবেশ নয়’
ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের মতিঝিল বিভাগের উপ-কমিশনার হায়াতুল ইসলাম খান জানান, ১০ ডিসেম্বর বিএনপির সমাবেশের জন্য পুলিশ কর্তৃপক্ষ এখনো নয়াপল্টনকে অনুমতি না দিলেও নেতাকর্মীরা বিএনপি কার্যালয় সংলগ্ন সড়ক দখল করে রাখে।
এই পুলিশ কর্মকর্তা বলেন, “বিএনপি নেতাকর্মীদের দলীয় কার্যালয়ের সামনের রাস্তা থেকে সরে যেতে অনুরোধ করলে বিনা উসকানিতে তারা পুলিশের ওপর হামলা চালায়।”
ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ কমিশনার খন্দকার গোলাম ফারুক সন্ধ্যায় এক বিশেষ সংবাদ সম্মেলনে বলেন, নয়াপল্টন কার্যালয়ের সামনে কয়েক হাজার বিরোধী দলীয় নেতাকর্মী জড়ো হওয়ায় পুলিশ প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে।
বুধবার নয়াপল্টনে ডিএমপির বিশেষায়িত ইউনিট সোয়াটকে এম-১৬ অ্যাসল্ট রাইফেল হাতে মহড়া দিতে দেখা গেছে।
রাজনৈতিক সমাবেশ ছত্রভঙ্গ করতে একটি বিশেষ অভিযানের জন্য প্রশিক্ষিত সোয়াট মোতায়েনের বিষয়ে জানতে চাইলে ডিএমপি কমিশনার বলেন, সেখানে অনেক ককটেল বিস্ফোরিত হওয়ায় সোয়াট মোতায়েন করা হয়েছিল।
তিনি বলেন, বিএনপিকে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান, টঙ্গীর ইজতেমা ময়দান বা পূর্বাচলে বাণিজ্য মেলার মাঠে সমাবেশ করতে হবে, যেখানে দশ লাখ লোকের সমাগম সম্ভব।
“আমাদের কথা পরিষ্কার, তারা (বিএনপি) রাজপথে সমাবেশ করতে পারবে না,” বলেন এই পুলিশ কর্মকর্তা।

সহিংসতার আশঙ্কা মার্কিন দূতাবাসের
আগামী ১০ ডিসেম্বর ঢাকায় বিএনপির গণসমাবেশকে কেন্দ্র করে রাজনৈতিক সহিংসতা হতে পারে উল্লেখ করে সতর্কবার্তা জারি করেছে ঢাকার মার্কিন দূতাবাস। এর আগে ব্রিটিশ হাইকমিশনের একই ধরনের সতর্কবার্তা দেয়।
বুধবার এক বিবৃতিতে মার্কিন দূতাবাস জানিয়েছে, সমাবেশ শান্তিপূর্ণ হলেও তা সংঘর্ষে পরিণত হতে পারে এবং সহিংস ঘটনা ঘটতে পারে।
বিবৃতিতে বলা হয়, বাংলাদেশে পরবর্তী সাধারণ নির্বাচন সামনে রেখে রাজনৈতিক দলের সমাবেশ এবং অন্যান্য নির্বাচনী কার্যক্রম শুরু হয়ে গেছে। সাধারণত নির্বাচন ঘনিয়ে আসার সঙ্গে সঙ্গে রাজনৈতিক সমাবেশ এবং বিক্ষোভ ক্রমবর্ধমানভাবে বাড়তে থাকে। বাংলাদেশের দুটি বৃহত্তম রাজনৈতিক দল আগামী ১০ ডিসেম্বর ঢাকার বিভিন্ন এলাকায় সমাবেশের ঘোষণা দিয়েছে।
এ অবস্থায় মার্কিন নাগরিকদের সতর্কতা অবলম্বন করা উচিত এবং মনে রাখা উচিত যে শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভ সংঘর্ষ ও সহিংসতায় পরিণত হতে পারে, জানায় মার্কিন দূতাবাস।
জাতিসংঘ শান্তিপূর্ণ সমাবেশ অনুষ্ঠান এবং মতপ্রকাশ ও গণমাধ্যমের স্বাধীনতাসহ মানবাধিকার সনদের বিভিন্ন বিধান মেনে চলার অঙ্গীকার রক্ষায় বাংলাদেশকে তাগিদ দিয়েছে। ঢাকায় নিযুক্ত জাতিসংঘের আবাসিক প্রতিনিধি গোয়েন লুইস বুধবার এক বিবৃতিতে এ তাগিদ দেন।
ঢাকায় সংঘর্ষ ও সহিংসতার পর বাংলাদেশে জাতিসংঘ আবাসিক কার্যালয়ের ওয়েবসাইট ও ফেসবুক পেজে বুধবার বিকেলে বিবৃতিটি প্রকাশ করা হয়।