নয়াপল্টনে অনুমতি না মেলায় বিকল্প স্থানে গণসমাবেশ করতে সম্মত বিএনপি

কামরান রেজা চৌধুরী
2022.12.08
ঢাকা
নয়াপল্টনে অনুমতি না মেলায় বিকল্প স্থানে গণসমাবেশ করতে সম্মত বিএনপি ঢাকার নয়াপল্টনে বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয় সংলগ্ন এলাকাটিকে ব্যারিকেড টেপ দিয়ে কর্ডন করে রাখেন পুলিশের কাউন্টার টেরোরিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইমের বোম ডিসপোজাল ইউনিটের সদস্যরা। ৮ ডিসেম্বর ২০২২।
[বেনারনিউজ]

দলীয় কার্যালয় নয়াপল্টনে গণসমাবেশের অনুমতি না মেলায় বিকল্প স্থান কমলাপুর স্টেডিয়াম অথবা মিরপুর বাঙলা কলেজ মাঠে ১০ ডিসেম্বরের ঢাকা বিভাগীয় গণসমাবেশ করতে সম্মত হয়েছে প্রধান বিরোধী রাজনৈতিক দল বিএনপি।

বৃহস্পতিবার রাতে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান বেনারকে এ তথ্য জানিয়েছেন। তিনি আরও জানান, বৃহস্পতিবার রাতে বিএনপির একটি প্রতিনিধি দলের সঙ্গে ঢাকা মহানগর পুলিশ (ডিএমপি) কর্মকর্তাদের বৈঠকে এই মতৈক্য হয়েছে।

বিএনপির ভারপ্রাপ্ত প্রচার সম্পাদক ইমরান সালেহ প্রিন্স বেনারকে জানিয়েছেন, ওই দুই স্থানের কোনো একটিতে সমাবেশ করতে রাজি আছে বিএনপি।

তিনি আরও বলেন, সরকারও সোহরাওয়ার্দী উদ্যান থেকে সরে এসেছে। এই মতৈক্যের ফলে ১০ ডিসেম্বর বিএনপির ঢাকা বিভাগীয় গণসমাবেশের স্থান নির্ধারণকে কেন্দ্র করে চলমান রাজনৈতিক উত্তেজনার অবসান ঘটবে বলে আশা করা যায়।

ওই সমাবেশ থেকেই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পদত্যাগ, বর্তমান জাতীয় সংসদ বিলুপ্তি এবং আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত করতে পরবর্তী ধাপের আন্দোলন কর্মসূচি ঘোষণা করবে বলে জানিয়েছেন দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর।

যা বললেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী

আসাদুজ্জামান খান বেনারকে বলেন, “তারা কমলাপুর স্টেডিয়ামে সমাবেশ করতে চায়। আমরা বলেছি মিরপুর বাঙলা কলেজ মাঠের কথা। কারণ কমলাপুর স্টেডিয়ামে বর্তমানে মেয়েদের ফুটবল টুর্নামেন্ট চলছে। তবে তারা মিরপুর বাঙলা কলেজে সমাবেশ করতে আপত্তি করেনি।”

তিনি বলেন, “নয়াপল্টনে সমাবেশ করলে জননিরাপত্তা বিঘ্নিত হতে পারে। রাস্তায় সমাবেশ করলে পুরো ঢাকা শহরে যানজট সৃষ্টি হবে। এই সমাবেশের ওপর কোনো নিয়ন্ত্রণ থাকবে না।”

স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, “নয়াপল্টনে তারা গতকাল পুলিশের ওপর হামলা চালিয়েছে। সেখান থেকে পুলিশ বিস্ফোরক উদ্ধার করেছে। সুতরাং, বোঝাই যাচ্ছে সেখানে কী হতে পারে। সেখানে সমাবেশ করতে দেওয়া হবে না।”

যা বলছে বিএনপি

তবে মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বৃহস্পতিবার এক সংবাদ সম্মেলনে জানান, বুধবার বিনা উসকানিতে পুলিশ বিএনপি নেতা-কর্মীদের ওপর আক্রমণ চালিয়েছে, দলীয় কার্যালয়ে তল্লাশি চালিয়ে কাগজপত্র নষ্ট করেছে, কম্পিউটার, ল্যাপটপসহ বিভিন্ন জিনিসপত্র নিয়ে গেছে। বুধবার পুলিশের গুলিতে পল্লবী থানার স্বেচ্ছাসেবক দল নেতা মকবুল নিহত হয়েছেন।

তিনি বলেন, আটক করা হয়েছে দলের সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী, বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা কাউন্সিলের সদস্য আমান উল্লাহ আমান, যুগ্ম মহাসচিব খায়রুল কবির খোকন, প্রচার সম্পাদক শহীদ উদ্দীন চৌধুরী এ্যানিসহ অনেক নেতাকে।

মির্জা ফখরুল বলেন, “গতকালের ঘটনা গণতন্ত্রের কফিনে শেষ পেরেক ঠুকে দেওয়ার শামিল। আওয়ামী লীগ দেশ পরিচালনায় ব্যর্থ হয়ে গণআন্দোলনে পতনের ভয়ে ভীত হয়ে দেশকে পুলিশি রাষ্ট্রে পরিণত করেছে।”

তিনি আরও বলেন, “পুলিশ নিজে বাইরে থেকে ককটেল ও বিস্ফোরক এনে বিএনপির ওপর দোষ চাপাচ্ছে।”

চার মামলায় আটক সাড়ে পাঁচশ

বুধবার পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষের ঘটনায় পল্টন, শাহজাহানপুর, মতিঝিল ও রমনা থানায় পৃথক চারটি মামলা দায়ের করেছে পুলিশ। মূলত দণ্ডবিধির আওতায় বিস্ফোরক, জনশৃঙ্খলা বিঘ্ন করা এবং পুলিশের ওপর আক্রমণের দায়ে এসব মামলা দায়ের করা হয়েছে।

মামলায় বিএনপির বিভিন্ন স্তরের নেতা ছাড়াও অজ্ঞাতনামা হাজারের বেশি মানুষকে আসামি করা হয়েছে।

ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের উপকমিশনার ফারুক হোসেন বৃহস্পতিবার রাতে বেনারকে বলেন, বুধবারের ঘটনায় দায়েরকৃত মামলাগুলোতে এ পর্যন্ত ৫৪৮ জনকে আটক করা হয়েছে।

মার্কিন রাষ্ট্রদূতের বিবৃতি

বৃহস্পতিবার মার্কিন দূতাবাসের এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, বুধবার ঢাকায় রাজনৈতিক সহিংসতায় নিহত ও আহত ব্যক্তিদের পরিবারের প্রতি সমবেদনা জানিয়েছেন ঢাকায় নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার হাস।

বিবৃতিতে রাষ্ট্রদূতকে উদ্ধৃত করে জানানো হয়, ঢাকার ভয়-ভীতি প্রদর্শন ও রাজনৈতিক সহিংসতার ঘটনায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র উদ্বিগ্ন। আইনের শাসনের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করে সহিংসতা, হয়রানি ও ভয়ভীতি প্রদর্শন থেকে বিরত থাকতে সংশ্লিষ্ট সব পক্ষকে আহ্বান জানান রাষ্ট্রদূত পিটার হাস।

তিনি বলেন, “সহিংসতার ঘটনা সঠিক তদন্তের মাধ্যমে মত প্রকাশ, সমাবেশ ও শান্তিপূর্ণ জমায়েতের মতো মৌলিক স্বাধীনতা রক্ষা করতে সরকারি কর্তৃপক্ষের প্রতি আহ্বান জানাচ্ছি।”

শেখ হাসিনার হুঁশিয়ারি

রাষ্ট্রীয় বার্তা সংস্থা বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থা জানায়, প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা বৃহস্পতিবার গণভবন থেকে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে রাজধানীর বঙ্গবন্ধু এভিনিউয়ে কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত আওয়ামী লীগের সহযোগী সংগঠনের যৌথ সভায় ভার্চুয়ালি যোগ দেন।

দেশে যাতে আর কেউ কোনো নৈরাজ্য ঘটাতে না পারে সে জন্য দলের নেতা-কর্মীদের তিনি প্রস্তুত থাকার আহ্বান জানিয়েছেন।

বাসস জানায়, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের প্রস্তুত থাকার নির্দেশ দিয়ে বলেন, “সবাই প্রস্তুত থাকবেন। একটা মানুষের ক্ষতি যেন কেউ করতে না পারে। কেউ আগুন দিয়ে পোড়াতে এলে, যে হাত দিয়ে আগুন দেবে ওই হাতটা ওই আগুনে পুড়িয়ে দিতে হবে। আর বসে থাকার সময় নাই। কোনো ক্ষমা নাই।”

সহিংসতার দিকে যাচ্ছে দেশ

রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. নিজাম উদ্দিন আহমেদ বৃহস্পতিবার বেনারকে বলেন, “দুই দলই যেভাবে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে তা দেখে বলা যায়, বাংলাদেশ নিশ্চিতভাবেই একটি সংঘাতময় পরিস্থিতির দিকে ধাবিত হচ্ছে। ইতোমধ্যে একজন মানুষ প্রাণ হারিয়েছেন।”

তিনি বলেন, “প্রধানমন্ত্রী তাঁর দলের নেতা-কর্মীদের প্রস্তুত থাকতে বলেছেন। এর কারণ হলো বিএনপির সমাবেশ সফল হোক, সেটি আওয়ামী লীগ চায় না। সে কারণে তাঁরা বিভাগীয় বিভিন্ন গণসমাবেশে যানবাহন বন্ধ করাসহ বিভিন্ন ধরনের বাধা দিয়েছে কিন্তু লাভ হয়নি। প্রচুর মানুষ সমাবেশে যোগ দিয়েছে।”

অধ্যাপক নিজাম বলেন, “বিএনপির বিভাগীয় গণসমাবেশে মানুষের অংশগ্রহণ দেখে আওয়ামী লীগ নেতাদের মনস্তাত্ত্বিকভাবে কিছুটা বিচলিত বলে মনে হচ্ছে। সে কারণে তারা বিএনপির ঢাকার গণসমাবেশের ব্যাপারে কঠোর অবস্থান নিয়েছে।”

“অন্যদিকে বিএনপির অবস্থা হলো, তাদের পিঠ দেয়ালে ঠেকে গেছে। সে কারণে তারা আর বসে থাকবে বলে মনে হয় না,” বলেন তিনি।

আওয়ামী লীগ ভয় পাওয়ার দল নয় মন্তব্য করে দলটির প্রেসিডিয়াম সদস্য শাজাহান খান বৃহস্পতিবার বেনারকে বলেন, “আমরা তাদের সমাবেশ করতে দেবো না—এই কথা আমরা কখনো বলিনি। সরকার বলছে, আপনারা রাস্তায় সমাবেশ করে জনভোগান্তি সৃষ্টি করতে পারবেন না; জনগণের জানমালের ক্ষতি করতে পারবেন না। উন্মুক্ত স্থানে সমাবেশ করতে তাদের বাধা কোথায় আমি বুঝলাম না।”

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।