‘রাষ্ট্র মেরামতে’ বিএনপির রূপরেখা: টানা দুইবারের বেশি প্রধানমন্ত্রী হতে পারবেন না কেউ
2022.12.19
ঢাকা
ঢাকায় ১০ ডিসেম্বর গণসমাবেশ থেকে ঘোষণা দিয়ে জাতীয় সংসদ থেকে দলের সব এমপি পদত্যাগের পর এবার “রাষ্ট্র সংস্কার” প্রস্তাব দিয়েছে প্রধান বিরোধী দল বিএনপি।
সোমবার ঢাকার ওয়েস্টিন হোটেলে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে দলটির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন ‘রাষ্ট্র মেরামতে’ ২৭ দফা রূপরেখা তুলে ধরেন। রূপরেখা অনুযায়ী, কোনো ব্যক্তি পর পর যাতে দুইবারের বেশি প্রধানমন্ত্রী থাকতে না পারেন, এমন বিধান বিএনপি সংবিধানে সংযোজন করবে বলে জানানো হয়।
মোশাররফ বলেন, জাতীয় সংসদ নির্বাচন নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত করার বিধান পুনঃপ্রবর্তনসহ দেশে প্রধানমন্ত্রী ও রাষ্ট্রপতির ক্ষমতার মধ্যে ভারসাম্য আনবে দলটি।
বিএনপি ক্ষমতায় গেলে সাংবিধানিক সংস্কারের মাধ্যমে এক কক্ষের পরিবর্তে বিভিন্ন পেশাজীবী ব্যক্তিদের সমন্বয়ে সংসদের উচ্চকক্ষ চালু করবে।
তবে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ নেতারা বিএনপির এই প্রস্তাব আমলে না নিয়ে বলছেন, এই রাষ্ট্র ধ্বংসের জন্য দায়ী বিএনপি। এসব প্রস্তাব মূলত বিএনপির আগামী সংসদ নির্বাচনে অংশগ্রহণের প্রস্তুতি বলেই মনে করছে সরকারি দল।
যদিও বিএনপি বলে আসছে, তত্ত্বাবধায়ক সরকার ছাড়া শেখ হাসিনা সরকারের অধীনে কোনো নির্বাচনে দলটি অংশ নেবে না।
যে কারণে সংস্কার প্রস্তাব
ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন প্রস্তাব উত্থাপনকালে আওয়ামী লীগকে “কর্তৃত্ববাদী সরকার” হিসেবে আখ্যা দিয়ে বলেন, বাংলাদেশ রাষ্ট্র কাঠামোকে ভেঙ্গে চুরমার করে ফেলা হয়েছে। সে কারণে এই রাষ্ট্রকে মেরামত ও পুনর্গঠন করতে হবে।
তিনি বলেন, একটি অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ, গ্রহণযোগ্য ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনে জয়লাভের পর “বর্তমান ফ্যাসিস্ট” সরকার হটানোর আন্দোলনে অংশগ্রহণকারী রাজনৈতিক দলগুলোর সমন্বয়ে একটি ‘জনকল্যাণমূলক জাতীয় ঐকমত্যের সরকার’ গঠন করা হবে।
বিএনপির এই রাজনৈতিক সংস্কার সম্পর্কে আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের সোমবার ঢাকায় এক সভায় বলেন, “বিএনপি রাষ্ট্র ধ্বংস করেছে এবং শেখ হাসিনা এই রাষ্ট্র মেরামত করেছেন।”
তিনি বলেন, আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে বামপন্থী, ডানপন্থী সব শক্তি একত্রিত হয়েছে। তবে তারা কিছুই করতে পারবে না বলে জানান কাদের।
বর্তমান সরকারকে আন্দোলনের মাধ্যমে ক্ষমতাচ্যুত করতে অক্টোবর থেকে দেশে বিভিন্ন বিভাগীয় শহরে গণসমাবেশ আয়োজন করে বিএনপি। সরকারের বিভিন্ন বাধা উপেক্ষা করে সমাবেশে লাখ লাখ মানুষের অংশগ্রহণ বিএনপিকে আন্দোলন চাঙ্গা করে তোলে।
ঢাকায় গণসমাবেশের আগের দিন আটক করা হয় বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর ও মির্জা আব্বাসকে। এছাড়াও দলের অনেক শীর্ষ স্থানীয় নেতাদের আটক করে পুলিশ। সারা দেশে হাজার হাজার বিরোধীদলীয় নেতা-কর্মীকে আটক করা হয়।
১০ ডিসেম্বর ঢাকার বিভাগীয় সমাবেশে সংসদ থেকে পদত্যাগের ঘোষণা দেন দলের সাত সংসদ সদস্য। সেই অনুসারে তাঁরা ১১ ডিসেম্বর সংসদে গিয়ে পদত্যাগপত্র জমা দেন।
সর্বশেষ আটক করা হয় বিএনপির মিত্র সংগঠন বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর আমীর ডা. শফিকুর রহমানকে।
বিএনপি ‘রাষ্ট্র সংস্কার’ প্রস্তাব সম্পর্কে আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য ফারুক খান সোমবার বেনারকে বলেন, “তাদের অতীতের কার্যক্রম বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে আজকে তারা যেসব কথা বলছে, তারা নিজেরা সেগুলোর ঠিক উল্টো কাজ করেছে। সুতরাং, এগুলো তাদের কথার কথা।”
তিনি বলেন, “বিএনপি আজকে যে প্রস্তাব দিয়েছে সেগুলো প্রকৃতপক্ষে তারা আগামী নির্বাচনকে সামনে রেখে করছে। তারা আগামী নির্বাচনে অংশ নেবে এবং বর্তমান সরকারের অধীনেই নির্বাচনে অংশ নেবে। কিন্তু তারা এই কথা জনসম্মুখে বলছে না।”
“আমি বিএনপির এই নির্বাচনী প্রস্তুতির বিষয়টিকে স্বাগত জানাই। আমরাও চাই সব রাজনৈতিক দল আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশগ্রহণ করুক,” বলেন ফারুক খান।
তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা সম্পর্কে তিনি বলেন, “এই বিএনপিই তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বিতর্কিত করেছে। নিজেদের পছন্দের ব্যক্তিকে তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রধান করতে তারা সংবিধান সংশোধন করেছে। এখন তারা নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা পুনঃপ্রবর্তন করার কথা বলছেন।”
বিএনপির স্থায়ী কমিটর সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী বেনারকে বলেন, “বাংলাদেশের নির্বাচনী ব্যবস্থা আওয়ামী লীগ যেভাবে ধ্বংস করেছে তাতে কোনো রাজনৈতিক সরকারের অধীনে নির্বাচন সুষ্ঠু হবে না।”
তিনি বলেন, “আওয়ামী লীগের অধীনে আমরা নির্বাচন মানব না এবং আমাদের অধীনে আওয়ামী লীগ মানবে না। সুতরাং, নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার ছাড়া দেশে সুষ্ঠু নির্বাচন হবে না। সে কারণে সংবিধানে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা স্থায়ী করে দিতে হবে। যেদিন রাজনৈতিক দলগুলো একমত হবে সেদিনই এই ব্যবস্থা তুলে দিতে হবে।”
বিএনপির ২৭ দফা
‘সংবিধান সংস্কার কমিশন’ গঠন করে সকল বিতর্কিত ও অগণতান্ত্রিক সংশোধনী ও পরিবর্তন পর্যালোচনা করবে বিএনপি।
প্রতিহিংসা ও প্রতিশোধের রাজনীতির বিপরীতে সকল মত ও পথের সমন্বয়ে বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদের ভিত্তিতে একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক, বৈষম্যহীন ও সম্প্রীতিমূলক ‘রেইনবো নেশন’ প্রতিষ্ঠা করবে। এজন্য একটি ‘ন্যাশনাল রিকনসিলিয়েশন কমিশন’ গঠনের কথা বলেছে দলটি।
বর্তমান ‘প্রধান নির্বাচন কমিশনার এবং অন্যান্য নির্বাচন কমিশনার নিয়োগ আইন, ২০২২’ সংশোধন করা হবে।
বিচারব্যবস্থার সংস্কারের জন্য একটি ‘জুডিশিয়াল কমিশন’ এবং মিডিয়ার সার্বিক সংস্কারের লক্ষ্যে ‘মিডিয়া কমিশন’ গঠন করা হবে। এ ছাড়া গঠন করা হবে অর্থনৈতিক সংস্কার কমিশন’।
গত দেড় দশক ধরে সংঘটিত অর্থ পাচার ও দুর্নীতির অনুসন্ধান করে শ্বেতপত্র প্রকাশ করবে বিএনপি এবং শ্বেতপত্রে চিহ্নিত দায়ী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
বামপন্থী প্রভাবে বিএনপি?
রাজনৈতিক বিশ্লেষক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. শান্তনু মজুমদার বেনারকে বলেন, “আজকে বিএনপি যে শব্দে সংস্কার প্রস্তাব দিয়েছে সেটি আসলে আমার কাছে মনে হয়েছে বামপন্থীদের ব্যবহার করা শব্দ।”
তিনি বলেন, “প্রকৃতপক্ষে শুধু সিপিবি এবং অন্য দু'একটি দল ছাড়া বামপন্থী, ডানপন্থী সব আওয়ামী লীগ বিরোধী শক্তি বিএনপির নেতৃত্বে একত্রিত হয়েছে। সে কারণে সেসব দলের দৃষ্টিভঙ্গি বিএনপির এই সংস্কার প্রস্তাবে স্থান পেয়েছে।”
ড. শান্তনু বলেন, “এই সংস্কারের মধ্যে রাষ্ট্রপতি-প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতার মধ্যে যে ভারসাম্যের কথা বলা হচ্ছে, সেটি বর্তমান ওয়েস্টমিন্সটার মডেলের মধ্যে থেকে সম্ভব নয়। সেটি করা বিপজ্জনক। যেমনটি দেখা গেছে পাকিস্তানে। বেনজীর ভুট্টোর সরকারকে তার নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট গোলাম ইসহাক খান বরখাস্ত করেছেন। নেওয়াজ শরীফকেও বরখাস্ত করেছেন তাঁর দল কর্তৃক নির্বাচিত রাষ্ট্রপতি।”
শান্তনু মজুমদার বলেন, “যদি রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতার মধ্যে ভারসাম্য আনতে হয় তাহলে ফরাসি মডেলের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। অন্যথায় প্রত্যক্ষ ভোটে নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে পরোক্ষভাবে অনির্বাচিত রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা ভাগাভাগি সঠিক ব্যবস্থা নয়।”
তিনি বলেন, “এই ‘রাষ্ট্র সংস্কার’ প্রস্তাবের মধ্যে শুধু তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা পুনঃপ্রবর্তন ছাড়া বাকি সব শর্ত থেকে সরে আসতে বিএনপি রাজি আছে মনে হয়।”
ড. শান্তনু মজুমদার বলেন, এই সংস্কার প্রস্তাব বাস্তবায়ন করতে হলে আওয়ামী লীগকে ক্ষমতা থেকে সরিয়ে বাস্তবায়ন করতে হবে। তবে তারা রাস্তার আন্দোলনের মাধ্যমে আওয়ামী লীগকে হটিয়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা পুনঃপ্রবর্তন করে ‘রাষ্ট্র সংস্কার’ করতে পারবে সেটি সম্ভব বলে মনে হচ্ছে না। ভবিষ্যতে কী হবে সেটি বলা কঠিন। এগুলোর মধ্যে আন্তর্জাতিক সমীকরণ রয়েছে, আঞ্চলিক সমীকরণ রয়েছে।”