আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহারে গুরুত্ব পায়নি মানবাধিকার
2023.12.27
ঢাকা
মানবাধিকারকর্মীদের মতে, ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহারে মানবাধিকারের গুরুত্ব কমে আসা দলটির গত ১৫ বছরের কাজকর্মেরই প্রতিফলন।
টানা তিন মেয়াদে ক্ষমতায় থাকা আওয়ামী লীগের ২০০৮ সালের নির্বাচনী ইশতেহারে মানবাধিকার ও আইনের শাসন বেশ গুরুত্ব পেয়েছিল। কিন্তু পরবর্তী নির্বাচনী ইশতেহারগুলোতে মানবাধিকারের গুরুত্ব কমে আসে।
দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণের প্রতিশ্রুতিসহ মোট ১১টি বিষয়ে বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে বুধবার আওয়ামী লীগ সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আসন্ন দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ইশতেহার ঘোষণা করেন।
এতে বলা হয়, নির্বাচনের মাধ্যমে সরকার গঠন করতে পারলে দলটি নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি, গণতান্ত্রিক চর্চার প্রসার, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর জবাবদিহি নিশ্চিত করা, আর্থিক খাতে দক্ষতা বৃদ্ধি, স্বাস্থ্যসেবা সুলভ করা ও আধুনিক প্রযুক্তিনির্ভর স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ে তোলার বিষয়গুলোতে অগ্রাধিকার দিয়ে কাজ করবে।
আওয়ামী লীগের এই ইশতেহারে মানবাধিকারের বিষয়গুলো গুরুত্ব পেয়েছে কম।
মানবাধিকার প্রসঙ্গে আগের বক্তব্য
আওয়ামী লীগের ২০০৮ সালের নির্বাচনী ইশতেহারে বলা হয়েছিল, “বিচার বিভাগের প্রকৃত স্বাধীনতা ও নিরপেক্ষতা নিশ্চিত করা হবে। বিচার বহির্ভূত হত্যাকাণ্ড বন্ধ করা হবে। আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা, স্বাধীন মানবাধিকার কমিশন গঠন ও ন্যায়পাল নিয়োগ করা হবে। মানবাধিকার লঙ্ঘন কঠোরভাবে বন্ধ করা হবে।”
এছাড়া ওই ইশতেহারে “রাষ্ট্রীয় বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও প্রশাসনকে দলীয়করণ মুক্ত” এবং “রাজনৈতিক উদ্দেশ্য সাধনে প্রশাসনকে ব্যবহার বন্ধ নিশ্চিত” করারও প্রতিশ্রুতি ছিল।
‘এগিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ’ শিরোনামে আওয়ামী লীগের ২০১৪ সালের নির্বাচনী ইশতেহারে মানবাধিকার প্রসঙ্গে সুস্পষ্ট বক্তব্য ছিল না।
এতে বলা হয়, “সবার জন্য আইনের সমান প্রয়োগ, আইনের শাসন ও মানবাধিকার প্রতিষ্ঠা কার্যক্রম জোরদার করা হবে। ন্যায়পাল নিয়োগ ও স্বাধীন মানবাধিকার কমিশনকে আরও কার্যকর প্রতিষ্ঠানে পরিণত করা হবে।”
“আওয়ামী লীগ আইনের শাসন ও মানবাধিকারের সপক্ষে সব সময়ই সোচ্চার,” উল্লেখ করে ২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত একাদশ সংসদের নির্বাচনী ইশতেহারে দলটি “আইনের শাসন, মৌলিক মানবাধিকার, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক সাম্য, স্বাধীনতা এবং সুবিচার নিশ্চিত” করার ঘোষণা দেয়।
তবে এবারের ইশতেহারে বিচার বহির্ভূত হত্যাকাণ্ড বন্ধ করা বা এ সংক্রান্ত বিষয়ে তেমন কিছু বলা হয়নি।
এ প্রসঙ্গে মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) নির্বাহী পরিচালক ফারুখ ফয়সল বেনারকে বলেন, “গত ১৫ বছরের শাসনকালে উন্নয়নমূলক নানা কাজ করলেও আওয়ামী লীগ মানুষের অধিকার হরণ করেছে। যে নির্বাচন করতে যাচ্ছে তাও অধিকার হরণের উদাহরণ। তাই আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহারে মানবাধিকার উপেক্ষিত হবে এটাই স্বাভাবিক।”
“মানবাধিকার নিয়ে ভালো কথা বলা এখন আর আওয়ামী লীগের কাজ নয়,” মন্তব্য করে তিনি বলেন, “তারা যেভাবে রাষ্ট্রক্ষমতায় টিকে রয়েছে এটি ধরে রাখার জন্য হলেও তাদেরকে মানবাধিকারের বিষয়গুলোকে উপেক্ষা করেই যেতে হবে।”
বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তরের সাম্প্রতিক এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০২২ সালে বাংলাদেশে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড, গুমের ঘটনাও ঘটেছে। স্বাধীন মতপ্রকাশে বাধা, সভা-সমাবেশে বলপ্রয়োগ, জাতীয় ও আন্তর্জাতিক মানবাধিকার প্রতিষ্ঠানকে বাধা প্রভৃতি অন্যান্য সময়ের মতো অব্যাহত ছিল।
সাউথ আফ্রিকার আন্তর্জাতিক মানবাধিকার গ্রুপ সিভিকাস মনিটর এক প্রতিবেদনে বলেছে, বাংলাদেশের নাগরিক সমাজের কথা বলার স্থান বন্ধ (ক্লোজড) হয়ে গেছে।
সিভিকাস মনিটরের করা এই প্রতিবেদনে বাংলাদেশের অবস্থা ‘সবচেয়ে খারাপ ছিল’ উল্লেখ করে বলা হয়েছে, ৭ই জানুয়ারি জাতীয় নির্বাচনকে সামনে রেখে বিরোধী রাজনীতিক ও নিরপেক্ষ সমালোচকদের বিরুদ্ধে সরকারের গণ-দমনপীড়নের ফলে বাংলাদেশের এই অবনমন হয়েছে।
উল্লেখ্য, মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগে ২০২১ সালে র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়নের (র্যাব) সাবেক ও বর্তমান সাত কর্মকর্তার ওপর নিষেধাজ্ঞা দেয় যুক্তরাষ্ট্র। এরপর থেকে র্যাব-পুলিশের হাতে ক্রসফায়ারে মৃত্যু কমে গেলেও বিভিন্ন উপায়ে মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা অব্যাহত রয়েছে।
তবে মানবাধিকারের বিষয়গুলো উপেক্ষা করার দাবি অস্বীকার করেছেন আওয়ামী লীগের নেতারা।
এ প্রসঙ্গে ঢাকা মহানগর দক্ষিণ আওয়ামী লীগের দপ্তর সম্পাদক রিয়াজ উদ্দিন রিয়াজ বেনারকে বলেন, আওয়ামী লীগ মানবাধিকার বিষয়ে খুবই সচেতন এবং আওয়ামী লীগই মানবাধিকার কমিশন গঠন করেছে।”
“মানবাধিকার ও আইনের শাসন নিয়ে বেশি সচেতন হবার পরও উল্টো আমাদের দল মানবাধিকার ইস্যুতে নানা দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্রের শিকার,’ বলেন তিনি।
ইশতেহারে গুরুত্ব পেয়েছে দ্রব্যমূল্য
স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ার অঙ্গীকার ও গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ, আইনের শাসন, সুশাসন নিশ্চিত করা, অর্থ পাচারকারীদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থার প্রতিশ্রুতি দিয়ে প্রকাশ করা নতুন ইশতেহারে বলা হয়েছে, আগামীতে সরকার গঠন করতে পারলে আওয়ামী দ্রব্যমূল্য দ্রব্যমূল্য ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে নিয়ে আসার জন্য কাজ করবে।
১৫ বছর ধরে টানা ক্ষমতায় থাকা আওয়ামী লীগ আগের নির্বাচনী ইশতেহারগুলোতেও দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে রাখার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল।
তবে সরকারি প্রতিষ্ঠান ট্রেডিং কর্পোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) তথ্য অনুযায়ী, শুধু গত তিন বছরে নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দাম ৩৮ থেকে ২১৯ শতাংশ বেড়েছে, যা নিম্ন ও নিম্ন-মধ্যম আয়ের মানুষদের মারাত্মক কষ্টের মধ্যে ফেলেছে।
“শুধু প্রতিশ্রুতিতে কোনো সমাধান মিলবে না। প্রধানত মূল্যস্ফীতির কারণে দ্রব্যমূল্য লাগামহীন হয়ে পড়ে, তাই মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের জন্য কার্যকর উদ্যোগ নিতে হবে,” বেনারকে বলেন বিশ্বব্যাংকের বাংলাদেশ আবাসিক মিশনের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন।
তিনি বলেন, সমস্যা সমাধানে বিভিন্ন বিশেষজ্ঞ ও গবেষণা থেকে যেসব পরামর্শ আসে সেগুলোর প্রতি নজর দিয়ে তার আলোকে সিদ্ধান্ত নিলেই দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো অক্টোবরে খাদ্য মূল্যস্ফীতি ১২.৫৬ শতাংশ রেকর্ড করেছে, যা গত এক দশকের মধ্যে সর্বোচ্চ।
সর্বশেষ ২০১৮ সালের নির্বাচনী ইশতেহারে আওয়ামী লীগ দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স দেখানো, অর্থ পাচারকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া, দারিদ্র্য বিমোচন, দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ, আরও কর্মসংস্থান সৃষ্টি এবং আইনের শাসন ও মানবাধিকার নিশ্চিত করার অঙ্গীকার করেছিল।
“সরকার তো নানারকম প্রতিশ্রুতি দেয়। এসব নিয়ে আমাদের আগ্রহ নেই। আমরা জানি নাগরিক হিসেবে আমাদের মূল্য কতটুকু। সুতরাং কী ইশতেহার আর কী ভোট সেসব আমাদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ কিছু নয়,” বেনারকে বলেন ঢাকার একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কর্মরত মিনহাজুল ইসলাম পলাশ।
রাজধানীর ধানমন্ডি এলাকার এই ভোটার বলেন, “এই প্রতিশ্রুতে দেয়া বা না দেয়া রাজনৈতিক দলগুলোর জন্য একটা নিয়মের খেলা হয়তো। আমরা এগুলো বুঝি না।
এই ইশতেহার তামাশা: বিএনপি
এদিকে মঙ্গলবার বিকেলে সংবাদ সম্মেলনে দেশের প্রধান বিরোধী দল বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন, এই ইশতেহারকে মানুষ ‘সার্কাসের জোকারের তামাশার মতো’ দেখছে।
“এই নির্বাচনে জনগণের কোনো অংশগ্রহণ নেই। ...একটি প্রহসনের নির্বাচন করার জন্য তিনি (প্রধানমন্ত্রী) খুব তোড়জোড় করছেন। নিজে নিজেই একটি ইশতেহার দলের পক্ষ থেকে পাঠ করেছেন। ...এই নির্বাচনী ইশতেহারকে সাধারণ মানুষ দেখছে সার্কাসের জোকারের তামাশার মতো,” বলেন তিনি।
আগামী ৭ জানুয়ারি অনুষ্ঠিতব্য নির্বাচনে বিএনপিসহ বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক দল অংশ না নিয়ে সরকারের পদত্যাগ ও নির্বাচনকালীন দল নিরপেক্ষ সরকারের দাবিতে রাজপথে আন্দোলন করছে।