সাবেক মন্ত্রীর টায়ার কারখানায় আগুন: লুট করতে গিয়ে নিখোঁজ শতাধিক

কামরান রেজা চৌধুরী
2024.08.27
ঢাকা
সাবেক মন্ত্রীর টায়ার কারখানায় আগুন: লুট করতে গিয়ে নিখোঁজ শতাধিক নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জে গাজী টায়ার কারখানায় আগুন নেভানোর চেষ্টা করছেন ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা। ২৬ আগস্ট ২০২৪।
[বেনারনিউজ]

নারায়ণগঞ্জের গাজী টায়ার কারখানায় অগ্নিকাণ্ডের পর নিখোঁজ ব্যক্তিরা লুট করতে গিয়েছিলেন বলে জানিয়েছে দমকল বাহিনী।

মঙ্গলবার পর্যন্ত বাহিনীটি ১৭৩ জন নিখোঁজ ব্যক্তির তালিকা প্রস্তুত করেছে, যার একটি কপি বেনারের কাছে এসেছে। যদিও আনুষ্ঠানিকভাবে সরকারের কাছ থেকে নিখোঁজ ব্যক্তিদের কোনো সংখ্যা প্রকাশ করা হয়নি।

সংস্থাটির মতে, কারখানাটির মালিক ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের সাবেক মন্ত্রী গোলাম দস্তগীর গাজী আটক হওয়ার দিন রোববার রাত সাড়ে ১০টার দিকে নারায়ণগঞ্জে রূপগঞ্জে অবস্থিত কারখানাটির নিয়ন্ত্রণ নিয়ে দুটি সশস্ত্র গ্রুপের মধ্যে সংঘর্ষ বাঁধে এবং একটি গ্রুপ কারখানার শাটার নামিয়ে দিয়ে আগুন ধরিয়ে দেয়।

ভেতরে লুটে ব্যস্ত মানুষদের কেউ বের হতে পারেননি বলে আশঙ্কা রয়েছে। নিখোঁজ ব্যক্তিদের পরিবার-পরিজন ও আত্মীয়রা মঙ্গলবার রাত পর্যন্ত কারখানার সামনে অপেক্ষা করে চলে যান।

দমকল বাহিনী নিখোঁজ ব্যক্তিদের বিষয়ে আনুষ্ঠানিক কিছু জানাতে পারেনি। কারা এসব ঘটনার সঙ্গে জড়িত সেই রহস্যের জট খোলেনি। এ ঘটনায় থানায় মামলা হয়নি, একটি সাধারণ ডায়েরি হয়েছে।

লুট করতে গিয়ে, দেখতে গিয়ে নিখোঁজ

নিখোঁজ ব্যক্তিদের একজন নারায়ণগঞ্জ জেলার তারাবো এলাকার একটি টেক্সটাইল কারখানার কর্মচারী মো. শরিফ (২৮)।

তাঁর চাচাতো ভাই মো. হৃদয় মঙ্গলবার বেনারকে বলেন, গোলাম দস্তগীর গাজী আটক হওয়ার খবর ছড়িয়ে পড়লে প্রধানমন্ত্রীর বাড়ি (গণভবন) লুট দেখে উৎসাহিত হয়ে এলাকার হাজার হাজার মানুষ গাজীর কারখানায় লুট করতে যায়। এর মধ্যে শরিফও যায়।

তিনি বলেন, শরিফ কখনও খারাপ কাজ করেনি। কিন্তু সেদিন তাঁর বন্ধু-বান্ধবরা তাঁকে ফোন করে কারখানায় যেতে বলে।

হৃদয় বলেন, বিকাল পাঁচটার দিকে শরিফ কিছু লোহার রড় এবং অন্যান্য ধাতব সামগ্রী নিয়ে কারখানার অদূরে দক্ষিণ রূপসী গ্রামে তাঁর বাড়িতে আসেন। রাতের খাবার খেয়ে রাত নয়টার দিকে আবার কারখানায় যায়।

তিনি বলেন, “আমরা জেনেছি, রাতে মালামাল লুট করা নিয়ে সেখানে দুই গ্রুপের মধ্যে মারামারি লেগে যায়। এরপর এক গ্রুপ কারাখানার সকল শাটার নামিয়ে দিয়ে আগুন লাগিয়ে দেয়। তখন ভিতরে লুট করতে ব্যস্ত থাকা মানুষজন আটকা পড়েন।”

হৃদয় বলেন, “শরিফ সর্বশেষ রাত সাড়ে নয়টায় কথা বলেন। এরপর থেকে তাঁর ফোন বন্ধ এবং তাঁর খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে না।”

তিনি বলেন, “শরিফের মা ক্যান্সারের রোগী। তিন বছর ধরে বিছানায় পড়ে আছেন। তাঁর বাবা হার্টের রোগী। তাঁর স্ত্রী এবং ছেলে কেঁদে যাচ্ছে। আমরা এখনও খোঁজ পাইনি।”

সোমবার দমকল বাহিনীর করা তালিকায় শরিফের নাম থাকলেও মঙ্গলবার রাত পর্যন্ত তারা শরিফের কোনো সন্ধান দিতে পারেনি বলে জানান হৃদয়।

নিখোঁজ ব্যক্তিদের তালিকা সম্পর্কে দমকল বাহিনী কিছু না বললেও তাঁদের করা তালিকার একটি কপি ও কয়েকটি ভিডিও বেনারের হাতে এসেছে, যেখানে দেখা যাচ্ছে দমকল বাহিনীর সদস্যরা নিখোঁজ ব্যক্তিদের তালিকা করছেন।

নিখোঁজ আরেক ব্যক্তি মো. নিজামের (৩৮) মামা শ্বশুর মো. আমজাদ হোসেন মঙ্গলবার বেনারকে বলেন, তাঁর ভাগ্নিজামাই রোববার রাত থেকে নিখোঁজ রয়েছেন।

নিজাম লুট করতে যাননি, দেখার জন্য গিয়েছিলেন জানিয়ে আমজাদ বলেন, লুট করতে যাওয়া নিজামের অন্যান্য আত্মীয়-স্বজন ফোন করে তাঁকে কারখানায় যেতে বলেন। সেখানে গিয়ে আর ফিরে আসেননি নিজাম।

তিনি বলেন, “অন্যান্যদের কাছ থেকে শুনেছি, কারখানার মধ্যে দুই গ্রুপে মারামারি শুরু হয়। এরপর কারখানায় আগুন লাগানো হয়।”

আমজাদ বলেন, “নিজামের এক ছেলে, এক মেয়ে, তার বউ, কাঁদছে। কিন্তু কেউ তার ব্যাপারে কিছু জানাতে পারছেন না।” 

মন্তব্যের জন্য গাজী গ্রুপের কর্মকর্তাদের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করেও তা সম্ভব হয়ে উঠেনি। গাজী গ্রুপের ওয়েবসাইটও বন্ধ। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে লিঙ্কডইন এ দেওয়া তথ্য অনুসারে গাজী গ্রুপের কর্মীর সংখ্যা সর্বোচ্চ পাঁচ হাজার। তবে কারখানায় কত কর্মচারী কাজ করতেন সে ব্যাপারে কোনো তথ্য দেওয়া নেই।

IMG_5984.jpg
নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জে গাজী টায়ার কারখানায় অগ্নিকাণ্ডে নিখোঁজদের সন্ধানে গেটের সামনে স্বজনদের অপেক্ষা। ২৬ আগস্ট ২০২৪। [বেনারনিউজ]

‘পরিকল্পিতভাবে’ আগুন ধরানো হয়

গাজী টায়ার কারখানায় অগ্নিকাণ্ড বন্ধে নেতৃত্ব দেওয়া দমকল বাহিনীর উপ-সহকারী পরিচালক আব্দুল মান্নান মঙ্গলবার রাতে বেনারকে বলেন, রোববার রাত সাড়ে ১০টার দিকে গাজীর কারখানায় পরিকল্পিতভাবে আগুন দেয় দুর্বৃত্তরা এবং দমকল বাহিনীর সদস্যরা ১০টা ৩৫ মিনিটে সেখানে পৌঁছায়।

তিনি বলেন, ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা পালিয়ে যাওয়ার পর থেকে কারখানা বন্ধ ছিল এবং খুব অল্প সংখ্যক মানুষ সেখানে ছিলেন এবং তাঁরা সেখান থেকে ৩৪ জনকে উদ্ধার করেন।

আব্দুল মান্নান বলেন, গাজী গ্রুপের কোনো কর্মকর্তা-কর্মচারী নিখোঁজ হননি বলে দমকল বাহিনীকে জানানো হয়েছে। যাঁরা নিখোঁজ রয়েছেন, তারা সবাই লুট করতে গেছেন অথবা তাদের সহায়তা করতে গেছেন।

তিনি বলেন, “কারখানাটি বিশাল, ছয় তলা কংক্রিট ভবনের প্রতি ফ্লোরে প্রায় এক লাখ বর্গফুট জায়গা আছে। আমরা সেখানে গিয়ে দেখি কারখানার ভিতরে হাজার হাজার মানুষ। তারা লুট করছে, ভাঙচুর করছে।”

আব্দুল মান্নান বলেন, “কারখানার ভিতরে প্লাস্টিকের দানা, রাবারের কাঁচামাল এবং অন্যান্য দাহ্য পদার্থ ছিল। কমপক্ষে ১২টি বিস্ফোরণ হয়েছে। ৩২ ঘণ্টা পর আগুন নিয়ন্ত্রণে এসেছে। এখনো মাঝে মধ্যে ছোটখাটো আগুনের শিখা দেখা যাচ্ছে। আমরা সেগুলো নিভিয়ে দিচ্ছি।”

তিনি বলেন, “আগুন নিভেছে। কিন্তু ভবনের ভেতরে সব ছাই হয়ে গেছে। ভবনটি যে কোনো মুহূর্তে ভেঙে পড়তে পারে।”

রাজনৈতিক কারণে শিল্প প্রতিষ্ঠান ধ্বংস কাম্য নয়

অর্থনীতিবিদদের মতে, রাজনৈতিক মত পার্থক্যের কারণে বাণিজ্যিক অথবা শিল্প প্রতিষ্ঠান ধ্বংস করা কোনোভাবেই কাম্য নয়।

বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের সম্মানিত ফেলো ড. মোস্তাফিজুর রহমান মঙ্গলবার বেনারকে বলেন, “রাজনৈতিক পরিচয়ের কারণে কোনো শিল্প কারখানা ধ্বংস করা বা লুট করা-কোনোভাবেই কাম্য নয়। গাজী গ্রুপে কমপক্ষে পাঁচ হাজার মানুষ কাজ করতেন। তাঁরা সবাই তো বেকার হয়ে গেলেন। দেশে বেকারত্ব বাড়ল।”

কারখানার মালিক ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে ব্যবসাটি করছেন উল্লেখ করে তিনি বলেন, অগ্নিকাণ্ডের ফলে “ব্যাংক ক্ষতিগ্রস্ত হলো, বীমা প্রতিষ্ঠান ক্ষতিগ্রস্ত হলো। এর প্রভাব প্রত্যেকটি খাতে পড়বে।”

ড. মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, সরকারের উচিত হবে অবিলম্বে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতি করা যাতে আর কোনো প্রতিষ্ঠান ক্ষতিগ্রস্ত না হয়। মানুষ যেন বেকার না হয়।

গাজী টায়ার কারখানায় আগুন লাগানোর ঘটনা রাজনৈতিক কারণ না ব্যবসায়ীক বিরোধ না নিয়ে বিভিন্ন আলোচনা রয়েছে।

গোলাম দস্তগীর গাজীর নির্বাচনী এলাকা নারায়ণগঞ্জ জেলার রূপগঞ্জ এলাকা। সেখানে দেশের অন্যতম একটি বড়ো ব্যবসায়ী গ্রুপের সাথে হাউজিং ব্যবসাকে কেন্দ্র করে গাজী গ্রুপের বিরোধ চলে আসছে বছরের পর বছর। ওই ব্যবসায়ী গ্রুপের সাথে গাজী ও তাঁর পরিবারের প্রকাশ্য দ্বন্দ্ব রয়েছে।

এর আগে ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর একই মালিকের গাজী টায়ার্স ও গাজী পাইপে আগুন দেওয়া হয়। সে সময় টানা চার দিন ধরে কারখানা দুটি আগুনে পোড়ে। লুটপাট করা হয় কারখানা দুটিতে।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।