টিউলিপের বিরুদ্ধে যুক্তরাজ্যে অভিযোগের অধিকতর তদন্তের দাবি জোরালো হচ্ছে বাংলাদেশে
2025.01.17
ঢাকা

ক্ষমতাচ্যুত সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভাগ্নি ব্রিটিশ এমপি টিউলিপ সিদ্দিকের সম্পত্তি নিয়ে ব্রিটেনে অধিকতর তদন্তের দাবি ক্রমশ জোরালো হচ্ছে বাংলাদেশে।
খালার সাথে যোগসাজশে দুর্নীতির অভিযোগের ওঠার পর সম্প্রতি পদত্যাগ করেছেন ব্রিটিশ সরকারের এই দুর্নীতি দমন বিষয়ক মন্ত্রী।
শেখ হাসিনার সাথে আর্থিক লেনদেনে তাঁর পরিবারের উপকৃত হওয়াসহ ধারাবাহিক অভিযোগ ওঠার মধ্যেই কিয়ার স্টারমারের নেতৃত্বাধীন লেবার পার্টির সরকার থেকে এ সপ্তাহের শুরুতে পদত্যাগ করেন টিউলিপ সিদ্দিক। তাঁর অনৈতিক আর্থিক সুযোগ-সুবিধা নেয়ার অভিযোগ তদন্ত করছে বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারও।
তবে দুর্নীতি ও আর্থিক অনিয়মের অভিযোগ টিউলিপ সিদ্দিক অস্বীকার করে বলেছেন, সরকারের মনোযোগ যাতে তাঁর বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগে বিঘ্নিত না হয় সে জন্য তিনি পদত্যাগ করেছেন।
ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল, বাংলাদেশের নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বেনারকে বলেন, যুক্তরাজ্যের একজন স্বতন্ত্র উপদেষ্টা যে তদন্ত প্রতিবেদন দিয়েছেন, তাতে টিউলিপ সিদ্দিকের বিরুদ্ধে অভিযোগগুলোর সত্যতা পাওয়া যায়নি। তবে একটা বিষয় স্পষ্ট যে, অভিযুক্ত তাঁর স্বার্থের দ্বন্দ্বের বিষয়টিকে যথাযথ গুরুত্বের সাথে ম্যানেজ করতে পারেননি।
“এই ইস্যুতে টিউলিপের যে নৈতিক বিচ্যুতি ঘটেছে সেটা স্পষ্ট। তাঁর অবস্থানের অপব্যবহারের যে ঝুঁকি ছিল সে বিষয়ে তিনি সতর্ক থাকেননি। অধিকতর তদন্তে হয়তো বিষয়গুলো আরো স্পষ্ট হবে,” বলেন ইফতেখারুজ্জামান।
তাঁর বিরুদ্ধে বাংলাদেশের অভিযোগগুলো সুনির্দিষ্ট উল্লেখ করে ড. ইফতেখার বলেন, “আমাদের দেশে কর্তৃত্ববাদের কেন্দ্রবিন্দু তো পরিবারতন্ত্র। এই পরিবারতন্ত্রের যে অবস্থান, সেখানে প্রধানমন্ত্রীর ভাগ্নি হিসেবে তিনি সুবিধা নিয়েছেন। এই সুবিধাটা নৈতিকভাবে অগ্রহণযোগ্য।”
“বাংলাদেশে রাজউক আইনের যে ধারায় সাবেক প্রধানমন্ত্রীর পরিবারের ছয় সদস্যকে জমি দেওয়া হয়েছে, সে ধারাটা শুধুমাত্র ক্ষমতাসীনদের সুবিধা দেওয়ার জন্যই যুক্ত করা। সুতরাং ক্ষমতার অপব্যবহারের ঝুঁকি তো ছিল। এখানে অদৃশ্য ক্ষমতার ব্যবহার হয়েছে। সুবিধাভোগী হিসেবে টিউলিপ সিদ্দিক তাঁর দায় এড়াতে পারেন না,” বলেন টিআইবি প্রধান।
এছাড়াও তিনি বলেন, লেবার পার্টির নির্বাচনে আওয়ামী লীগের যুক্তরাজ্য শাখাকে ব্যবহার করে টিউলিপকে এমপি নির্বাচিত করার অভিযোগও আছে। এগুলো প্রমাণযোগ্য।

ড. ইফতেখারুজ্জামান দুই ব্রিটিশ সংবাদপত্র টিউলিপের সম্পত্তি নিয়ে ফিনান্সিয়াল টাইমস ও সানডে টাইমসের করা দুটি রিপোর্টের দিকে ইঙ্গিত করেছেন। তাদের অনুসন্ধানী প্রতিবেদনে আওয়ামী লীগের রাজনীতির সাথে ঘনিষ্ঠভাবে সম্পৃক্ত ব্যক্তির উপহার হিসেবে দেয়া ফ্ল্যাটে টিউলিপ বসবাস করেছিলেন যেটি পরবর্তীতে তাঁর বোন বিক্রি করে দেন বাংলাদেশি মুদ্রায় ১২ কোটি টাকায়।
অনুসন্ধানী সেই প্রতিবেদনে বলা হয়, টিউলিপ তাঁর নির্বাচনে আওয়ামী লীগ যুক্তরাজ্য শাখার সমর্থন নিয়েছিল, যেটি তিনি পরে দাবিও করেছিলেন যে সে সমর্থন ছাড়া তিনি বিজয়ী হতে পারতেন না।
তবে প্রতিবেদনগুলোতে বলা হয়, অভিযোগ ওঠার পরে টিউলিপ তাঁর প্রচারে আওয়ামী লীগের সমর্থনের বিষয়ে বিস্তারিত কিছু জানেন না বলে উল্লেখ করেন।
গত ডিসেম্বরের ১৯ তারিখে আওয়ামী লীগ যুক্তরাজ্য ইউনিটের প্রধান সৈয়দ ফারুক বিবিসিকে বলেন, টিউলিপের বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগ সাজানো ও ভিত্তিহীন।
এদিকে বাংলাদেশ থেকে লুটে নেয়া অর্থ দিয়ে বিদেশে কেনা সম্পত্তি অবশ্যই বাংলাদেশে ফিরে আসা উচিত বলে জানিয়েছেন বাংলাদেশের অন্তবর্তীকালীন সরকারের প্রধান ড. মোহাম্মদ ইউনূস।
গত সপ্তাহে টাইমসের সাথে এক সাক্ষাৎকারে টিউলিপের বিরুদ্ধে অভিযোগের বিষয়ে পরিহাস করে ইউনূস বলেন, “দুর্নীতিবিরোধী মন্ত্রী দুর্নীতির দায়ে অভিযুক্ত হয়েছেন।”
“তিনি দুর্নীতি দমনের দায়িত্বে থেকে সম্পত্তি নিয়ে ওঠা অভিযোগ আত্মপক্ষ সমর্থন করছেন”, বলেন অধ্যাপক ইউনূস।
টাইমসকে ইউনূস বলেন, “অন্তর্বর্তী সরকারের তৈরি এক প্রতিবেদনে দেখা যাচ্ছে, শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকারের সাথে ঘনিষ্ঠ ব্যক্তিরা বাংলাদেশ থেকে প্রতি বছর বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার পাচার করেছে, এবং তার কিছু বিদেশে সম্পত্তির কেনার কাজে ব্যবহার হয়েছে। সে টাকার মালিক বাংলাদেশের জনগণ।”
টিউলিপের লন্ডনের সম্পত্তি সে অভিযোগের মধ্যে পড়ে কি না জানতে চাইলে ইউনূসের বলেন, “নিঃসন্দেহে।”
“একজন ব্রিটিশ এমপি যদি এটার সাথে জড়িত থাকেন, তাহলে নিঃসন্দেহে একটি বড়ো ঘটনা”, যোগ করেন তিনি।

বাংলাদেশে দুর্নীতি মামলা
বাংলাদেশে সরকারের দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) গত ১৩ জানুয়ারি টিউলিপ সিদ্দিক, তাঁর মা রেহানা সিদ্দিক (শেখ রেহানা), দুই ভাইবোনসহ খালা সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নামে একটি মামলা দায়ের করেছে। টিউলিপের বিরুদ্ধে অভিযোগ, ঢাকার একটি অভিজাত এলাকার প্রস্তাবিত কূটনৈতিক এলাকায় তাঁর মা ও ভাইবোনের নামে নিয়ম ভেঙ্গে প্লট বরাদ্দ পেতে হস্তক্ষেপ করেছেন তিনি।
দুদকের মহাপরিচালক (প্রতিরোধ) আক্তার হোসেন বেনারনিউজকে বলেন, তাদের তদন্ত এখনো প্রাথমিক স্তরে রয়েছে। এসব অভিযোগের খুঁটিয়ে দেখার জন্য কমিশন এখন একটি তদন্ত টিম গঠন করবে।
দুদকের প্রাথমিক তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়, টিউলিপ সিদ্দিক ব্রিটিশ এমপি থাকা অবস্থায় নিজের বিশেষ ক্ষমতা ব্যবহার করে মা ও ভাইবোনকে প্লট পাইয়ে দিয়েছেন।
টিউলিপের পরিবারের সদস্যদের প্রত্যেককে ১০ কাঠা (প্রায় সাড়ে ১৩ হাজার বর্গফুট) করে জায়গা বরাদ্দ দেয়া হয়েছে বলে প্রতিবেদনে বলা হয়।
পৃথকভাবে দুদকের অনুসন্ধান ও তদন্ত শাখা রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের প্রকল্প থেকে ৫ বিলিয়ন ডলার পাচারের অভিযোগ অনুসন্ধান করছে।
আক্তার হোসেন বলেন, তারা প্রাথমিকভাবে তথ্য প্রমাণ সংগ্রহ করছেন এ বিষয়ে। তবে, এখনো বলার মতো কোনো অগ্রগতি হয়নি।
দুদক উচ্চ আদালতের রূপপুর বিদ্যুৎকেন্দ্রের দুর্নীতি তদন্তে রিটের প্রেক্ষিতে এ তদন্ত করছে বলে জানান তিনি।

গত ৩ সেপ্টেম্বর রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের ৫০০ মিলিয়ন ডলার আত্মসাতের অভিযোগের অনুসন্ধান ও তদন্ত সংশ্লিষ্টদের ব্যর্থতা ও নিষ্ক্রিয়তা চ্যালেঞ্জ করে রিট আবেদন করে ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক পার্টির প্রধান ববি হাজ্জাজ। শেখ হাসিনার আমলের দুর্নীতি ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের প্রতিবাদে সোচ্চার ছিলেন।
“টিউলিপ রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নিয়ে হওয়া প্রতিটি মিটিংয়ে উপস্থিত ছিল। নিঃসন্দেহে তিনি এসব চুক্তি থেকে উপকৃত হয়েছেন,” বেনারকে বলেন তিনি।
তবে কীভাবে নিশ্চিত হলেন সেই ব্যাখ্যা অবশ্য ববি হাজ্জাজ দেননি।
হাজ্জাজ বলেন, শেখ হাসিনা ও আওয়ামী পরিবার দেশের লুট করা অর্থসম্পদ দিয়ে টিউলিপকে ব্রিটিশ রাজনীতিতে প্রতিষ্ঠিত করেছে, যাতে এ দেশের অর্থসম্পদ লুট করে নিরাপদে ইউরোপের মাটিতে নিয়ে যাওয়া যায়।
বাংলাদেশের জনগণের টাকা লুট করার সাথে যুক্ত থাকা ও শেখ হাসিনার ফ্যাসিবাদী শাসন সহযোগী হওয়ার দায়ে টিউলিপ বিচারের আওতায় আসা উচিত বলে মনে করেন এই আইনজীবী।
গত ১৪ জানুয়ারি প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইং থেকে দেয়া এক বিবৃতিতে রূপপুর বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে পাচার করা সম্ভাব্য টাকার পরিমাণ কয়েক বিলিয়ন ডলার।
বিবৃতিতে বলা হয় “এ বিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকে পাঁচ বিলিয়ন ডলার পাচারের যে তদন্ত চলছে তাতে গত সরকারের দুর্নীতির ব্যাপকতা সম্পর্কে একটা ধারণা পাওয়া যায়।”
এটাসহ বিভিন্ন প্রকল্প থেকে জনগণের সম্পদ লুটে নেয়া শুধুমাত্র দেশের জনগণকে বঞ্চিতই করেনি, এটি দেশের কাঙ্ক্ষিত অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা অর্জনকেও বাধাগ্রস্ত করেছে বলে বিবৃতিতে উল্লেখ করা হয়।
সানডে টাইমসের সাথে সাক্ষাৎকারে ড. ইউনূস শেখ হাসিনার দুর্নীতির প্রভাব নিয়ে তির্যক মন্তব্য করেন।
“দুর্নীতির ক্ষত বুঝাতে “দূষণ” শব্দটি অনেক হালকা। বলতে হবে দেশ সম্পূর্ণভাবে ধ্বংস হয়ে গেছে এ দুর্নীতিতে। এটা দূষণ নয়। সরলভাবে বললে এটা ‘ডাকাতি’,” বলেন ইউনূস।