বাংলাদেশে ক্ষমতার পালাবদল: ১৫ বছর পর শেখ হাসিনার পতন

বেনারনিউজ স্টাফ
2024.08.06
ঢাকা, ওয়াশিংটন ও ব্যাংকক
বাংলাদেশে ক্ষমতার পালাবদল: ১৫ বছর পর শেখ হাসিনার পতন তৃতীয় মেয়াদে নির্বাচিত হবার পর ঢাকায় সাংবাদিকদের শুভেচ্ছা জানাচ্ছেন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ৩১ ডিসেম্বর ২০১৮।
[এপি]

শেখ হাসিনার সরকারি বাসভবন ভাংচুর এবং তাঁর প্রয়াত পিতা ও বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সম্মানে প্রতিষ্ঠিত জাদুঘরে আগুন ধরিয়ে দেয়ার মাধ্যমে বিক্ষোভকারীরা প্রতীকীভাবে দেশের সবচেয়ে দীর্ঘমেয়াদী প্রধানমন্ত্রীর শাসন থেকে পরিত্রাণ পাওয়ার মনোভাব প্রকাশ করেছেন। কারণ শেখ হাসিনার ক্ষমতায় উত্থানের সাথে তাঁর নিহত পিতা শেখ মুজিবের প্রভাব অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত।

বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করা দুই নারীর একজন হাসিনা (৭৬), যিনি সোমবার পদত্যাগ করে দেশ ছেড়ে পালিয়ে যান। কর্তৃত্ববাদের ধারায় চলমান ১৫ বছরের একটানা শাসনের পর তাঁর সরকারের ক্ষমতাচ্যুতির দাবিতে ছাত্র-নেতৃত্বাধীন বিক্ষোভকারীরা আবার রাজধানী ঢাকায় একত্রিত হওয়ায় ঘটনা প্রবাহের এক আশ্চর্য মোড়ে সেনাপ্রধান তাঁর পদত্যাগের কথা ঘোষণা করেন।

সমর্থকদের দ্বারা "মানবতার জননী" আখ্যায়িত হাসিনা একটি নড়বড়ে অর্থনীতির মধ্যে টানা চতুর্থ মেয়াদে নির্বাচিত ও পঞ্চমবারের মতো ক্ষমতায় আসার মাত্র সাত মাস পর পদত্যাগ করেন।

শেখ হাসিনার দল আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে ভোট কারসাজির ব্যাপক অভিযোগ রয়েছে। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন আয়োজনের দাবি মেনে না নেয়ায় তাঁর কট্টর শত্রু খালেদা জিয়ার নেতৃত্বাধীন বিরোধী দল বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) ৭ জানুয়ারির সাধারণ নির্বাচন বয়কট করেছিল।

২০০৯ সালে ক্ষমতা গ্রহণের পর থেকে, হাসিনা ১৭ কোটি জনসংখ্যার বাংলাদেশকে শক্তিশালী অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির পথে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। কিন্তু সাম্প্রতিক বছরগুলোতে তিনি ক্রমবর্ধমান লৌহ-কঠিন পন্থা অবলম্বন এবং সাংবাদিক ও সমালোচকদের রেকর্ডসংখ্যক জোরপূর্বক গুম এবং গ্রেপ্তারের অভিযোগের আন্তর্জাতিক মহলের সমালোচনায় ছিলেন।

“আমি যদি পথ চলায় কোনো ভুল করে থাকি, তাহলে আপনাদের কাছে আমার অনুরোধ রইল বিষয়টি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখুন,” গত জানুয়ারিতে নির্বাচনের আগে জাতির উদ্দেশে টেলিভিশন ভাষণে বলেছিলেন হাসিনা। “আমি আবার সরকার গঠন করতে পারলে ভুল শুধরে নেওয়ার সুযোগ পাব,” বলেন তিনি।

রাজনীতিবিদ হিসেবে হাসিনার জন্ম হয়েছিল ঘাতকদের ছোড়া বুলেটের পরিপ্রেক্ষিতে।

১৯৭৫ সালে এক অভ্যুত্থানের সময় তাঁর পিতা শেখ মুজিবুর রহমান, তাঁর মা এবং পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের গুলি করে হত্যার ছয় বছর পর তিনি আনুষ্ঠানিকভাবে আওয়ামী লীগের দায়িত্ব গ্রহণ করেন।

হাসিনা এবং তাঁর বোন শেখ রেহানা শেখ মুজিবুর রহমান হত্যার সময় বিদেশে থাকায় ভাগ্যক্রমে রক্ষা পান। ১৯৭১ সালে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের নেতা ছিলেন শেখ মুজিব।

শেখ হাসিনা জানুয়ারিতে তাঁর নির্বাচনী ভাষণে জাতির উদ্দেশে বলেন, “আমি আমার বাবার স্বপ্ন পূরণের জন্য রাজনীতিতে পা দিয়েছি।”

হাসিনা তাঁর রাজনীতিকে প্রয়াত পিতার উত্তরাধিকার এগিয়ে যাওয়ার মিশন হিসেবে দেখেছিলেন। ২০২১-২২ সালে তাঁর সরকার মুজিবের স্মৃতিকে স্মরণ করতে এবং স্বাধীনতার ৫০তম বছর উপলক্ষে শত শত কোটি টাকা ব্যয় করেছিল।

hasina2.jpeg
শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে পদত্যাগ করার পর ঢাকায় তাঁর পিতা এবং বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা শেখ মুজিবুর রহমানের একটি বড়ো ভাস্কর্য ভেঙে ফেলার চেষ্টা করছেন বিক্ষোভকারীরা। ৫ আগস্ট ২০২৪। [এপি]

বিশ্লেষকদের মতে, স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী ঘনিয়ে আসার সাথে সাথে বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা শেখ মুজিব সম্পর্কে স্বাধীনভাবে কথা বলা ক্রমবর্ধমানভাবে বিপজ্জনক হয়ে ওঠে। কারণ তাঁর মেয়ের সরকার মুজিবকে নিয়ে ঐতিহাসিক বিবরণ নিয়ন্ত্রণ করার জন্য মুজিবের মানহানির বিরুদ্ধে কঠোর আইন তৈরি করেন।

শেখ মুজিবও তরুণ দেশটির নেতা হওয়ার পর তাঁর নিজস্ব ধরনের স্বৈরাচারী শাসনে চলে যান। তাঁকে হত্যার এক বছর আগে মুজিব সমস্ত রাজনৈতিক দল এবং অধিকাংশ সংবাদপত্র নিষিদ্ধ করেছিলেন এবং বাকশাল নামে একটি চীনা কমিউনিস্ট পার্টি-স্টাইলের একদলীয় ব্যবস্থা গঠন করেছিলেন।

গত মাসে হাসিনা বিরোধী যে ব্যাপক বিক্ষোভ শুরু হয়েছিল এবং ৫ অগাস্ট তাঁকে ক্ষমতাচ্যুত করার মাধ্যমে যা শেষ হয়েছিল সেটি সরকারি চাকরিতে ১৯৭১ সালের মুক্তিযোদ্ধাদের পরিবারের জন্য সংরক্ষিত কোটা নিয়ে ছাত্রদের ক্ষোভ থেকে উদ্ভূত হয়েছিল। এই কোটা ব্যবস্থা ছিল মুক্তিযোদ্ধাদের নাতি-নাতনিদের ব্যাপক অনুকূলে।

দেশের সর্বোচ্চ আদালত কোটা হ্রাস করতে এবং দেশের বেশিরভাগ সরকারি চাকরি যোগ্যতাভিত্তিক আবেদনের সুযোগ তৈরি করতে আদেশ দেওয়ার পরেও প্রাণঘাতী বিক্ষোভ অব্যাহত ছিল। প্রসঙ্গত, দেশটির তরুণদের মধ্যে বেকারত্বের হার উচ্চ।

hasina3.jpeg
বাঙালি জাতীয়তাবাদী নেতা শেখ মুজিবুর রহমান ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে আনুমানিক ১০ লাখ লোকের এক জনসভায় ভাষণ দেওয়ার জন্য মাইক্রোফোনের দিকে হেঁটে যাচ্ছেন। ১১ জানুয়ারি ১৯৭২। ১৯৭৫ সালের আগস্টে এক সামরিক অভ্যুত্থানে শেখ মুজিব নিহত হন। [এপি]

রাজনৈতিক জীবনের শুরু

১৯৮০ সালে লন্ডন থেকে স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলন শুরু করেন শেখ হাসিনা। পরের বছর তাঁর অনুপস্থিতিতে আওয়ামী লীগ তাঁকে দলীয় প্রধান নির্বাচিত করে। ১৯৮১ সালে দেশে ফেরেন তিনি। তখন বাংলাদেশে শাসন করতেন রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান, একজন সামরিক জেনারেল, যিনি কয়েক বছর আগে বিএনপি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন।

শেখ হাসিনা ফিরে আসার পর এক অভ্যুত্থানে জিয়াউর রহমান নিহত হন, যা আরেক সেনা জেনারেল হুসেইন মুহম্মদ এরশাদকে ক্ষমতা দখলের পথ করে দেয়।

একটি বেসামরিক গণ আন্দোলনে এরশাদকে ক্ষমতাচ্যুত করতে জিয়াউর রহমানের বিধবা পত্নী বিএনপি নেত্রী খালেদা জিয়ার সাথে সহযোগিতা করেছিলেন শেখ হাসিনা।

১৯৯৬ সালে ক্ষমতাসীন বিএনপি একটি নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবি অগ্রাহ্য করে নির্বাচন আয়োজন করলে বিরোধী দলগুলোকে নির্বাচন বর্জন করতে নেতৃত্ব দেন শেখ হাসিনা।

গত ৭ জানুয়ারি হাসিনার সর্বশেষ বিজয়ের অনুরূপ সেসময় বিএনপি কার্যত বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় ক্ষমতায় ফিরে আসে। কিন্তু আওয়ামী লীগের ক্রমাগত রাস্তার আন্দোলন খালেদা জিয়ার সরকারকে পদত্যাগ করতে বাধ্য করে এবং একটি নবগঠিত তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থার অধীনে নতুন নির্বাচনের আয়োজন হয়।

ওই নির্বাচনে শেখ হাসিনা প্রথমবারের মতো প্রধানমন্ত্রী হন।

তাঁর দল আক্রমণাত্মক এবং নিরলস রাজনৈতিক কৌশলের জন্য পরিচিত হয়ে ওঠে, এমনকি যখন রাষ্ট্রক্ষমতা ২০০১ সালে আবার বিরোধী দলের হাতে চলে যায় তখনও। আওয়ামী লীগের ডাকা বারবার দেশব্যাপী ধর্মঘট এবং সড়ক অবরোধ বিএনপি সরকারকে চাপে রাখে।

আওয়ামী লীগের পরিসংখ্যান অনুসারে, তিনি ১৯টির মতো হত্যাচেষ্টা থেকে বেঁচে গিয়েছিলেন, যার মধ্যে সবচেয়ে সাম্প্রতিকটি ঘটেছিল ২০০৪ সালে। সেই ঘটনায় তিনি একটি গ্রেনেড হামলা থেকে অল্পের জন্য রক্ষা পেয়েছেন, যাতে এক ডজনেরও বেশি লোক নিহত হয়।

hasina4.jpeg
ঢাকায় জাতীয় সংসদের উদ্বোধনী অধিবেশনে বক্তব্য রাখছেন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ১৪ জুলাই ১৯৯৬। [এপি]

২০০৬ সালে নির্বাচন ঘনিয়ে এলে বিএনপি তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থায় কারসাজি করেছে অভিযোগ তুলে হাসিনার দল আবারও নির্বাচন বয়কট করে। সেবারের রক্তাক্ত রাজপথের যুদ্ধ ২০০৭ সালে সামরিক বাহিনীকে হস্তক্ষেপ করতে সুযোগ করে দিয়েছিল, এবং সে ঘটনায় তিনি বিজয় মিছিল করেছিলেন। কিন্তু নতুন সেনা-সমর্থিত সরকার দুর্নীতির অভিযোগে হাসিনা ও খালেদা জিয়া উভয়কেই কারাগারে পাঠায়।

এক বছর পরে ২০০৮ সালের নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার জন্য দুজনকেই মুক্তি দেওয়া হয়েছিল, যেটাতে হাসিনা বিপুল ভোটে জিতেছিলেন।

সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বিশেষ করে ইসলামিক স্টেট এবং আল-কায়েদার মতো গোষ্ঠীগুলো দেশে ধর্মনিরপেক্ষ লেখক এবং ব্লগারদের হত্যা করার পরে বাংলাদেশে ইসলামী চরমপন্থার সমস্যা মোকাবেলার জন্য হাসিনাকে ব্যাপকভাবে কৃতিত্ব দেওয়া হয়েছিল। দেশের সবচেয়ে ভয়ঙ্কর সন্ত্রাসী হামলাও তাঁর আমলে ঘটেছিল। আইএস-পন্থী জঙ্গিরা ঢাকার গুলশানে একটি ক্যাফেতে বিদেশী নাগরিকসহ কিছু মানুষকে রাতভর জিম্মি করেছিল। ঐ ঘটনায় কমপক্ষে ২০ জন মারা যান।

এদিকে নিরাপত্তা বাহিনীর বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের অভিযোগ উঠতে থাকে। স্থানীয় এবং আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠনগুলোর মতে ২০১৮ সালে, যেটি ছিল নির্বাচনী বছর, মাদকবিরোধী অভিযানে ৪০০ জনেরও বেশি লোককে হত্যা করা হয়েছিল।

সেই ২০১৮ সালেই সরকার ইন্টারনেট নিয়ন্ত্রণে নতুন করে একটি আইন চালু করেছিল যা এ সংক্রান্ত আগের আইনটিকে আরও কঠোর করেছে। ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্ট সাংবাদিকদের এবং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে দেয়া বক্তৃতাকে অসামঞ্জস্যপূর্ণভাবে টার্গেট করে, নিরবচ্ছিন্ন মতপ্রকাশের পরিবেশকে রোধ করে এবং তাঁর সরকারের সমালোচকদের গ্রেপ্তারের সুযোগ করে দেয়।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।