ছাত্রদের নতুন রাজনৈতিক দল: প্রধান এজেন্ডা আওয়ামী লীগ বিরোধিতা ও নির্বাচন পেছানো
2025.03.06
ঢাকা

জুলাই অভ্যুত্থানে নেতৃত্ব দেওয়া ছাত্ররা জাতীয় ঐক্য প্রতিষ্ঠার ঘোষণা দিয়ে সম্প্রতি নতুন রাজনৈতিক দল গঠন করলেও এখন পর্যন্ত দলটির মূল এজেন্ডা ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ বিরোধিতা ও নির্বাচন পেছানোর দাবিকে কেন্দ্র করে আবর্তিত হচ্ছে।
বিশ্লেষকদের মতে, জাতীয় ঐক্য প্রতিষ্ঠা করতে হলে সব দলকে নিয়েই করতে হবে। কাউকে বাদ দিয়ে করা সম্ভব নয়।
জাতীয় ঐক্যের পাশাপাশি নতুন সংবিধান প্রণয়নের ঘোষণা দিয়ে গত ২৮ ফেব্রুয়ারি আত্মপ্রকাশ করে ছাত্রদের দল জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি)। দলটির মতে, বিদ্যমান নানা অস্থিরতায় এই মুহূর্তে দেশে নির্বাচনের পরিবেশ নেই। এছাড়া দলটি যেকোনো মূল্যে ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগকে নির্বাচন প্রক্রিয়া থেকে দূরে রাখতে চায়।
গণহত্যা ও মানবাধিকার লঙ্ঘনসহ বিভিন্ন অপরাধে অভিযুক্ত সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও তাঁর দলের নেতাদের বিচারের পক্ষে দৃঢ় অবস্থান ব্যক্ত করলেও বিএনপিসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও বিশ্লেষকদের মতে, আওয়ামী লীগকে বাদ দিয়ে নির্বাচনে যাওয়া বা ‘জাতীয় ঐক্য’ প্রতিষ্ঠার সুযোগ নেই।
এ প্রসঙ্গে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপক ড. নিজাম উদ্দিন আহমেদ বেনারকে বলেন, “ছাত্ররা জাতীয় ঐকমত্যের কথা বলছে। নতুন দল গঠন করেছে। তাদের কথায় মানুষ আশা দেখতে পারে। কিন্তু তারা তো আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করতে চায়, নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে দিতে চায় না।”
বিএনপির সাথেও নতুন দলটির সংবিধান প্রণয়নসহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে “ব্যাপক মতানৈক্য রয়েছে,” উল্লেখ করে তিনি বলেন, এ অবস্থায় দলটি কীভাবে “জাতীয় ঐক্যমত্য” প্রতিষ্ঠা করবে তা পরিষ্কার নয়।
“জাতীয় ঐক্যমত্য চাইলে সব দলমত নিয়ে করতে হবে। কাউকে বাদ দিয়ে হবে না,” বলেন তিনি।
ছাত্রদের নতুন দল করায় কোনো অসুবিধা নেই জানিয়ে বর্তমানে ভারতে অবস্থান করা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক বাহাউদ্দিন নাসিম ফোনে বেনারকে বলেন, “তারা রাজনীতি করবে, জাতীয় ঐকমত্য প্রতিষ্ঠা করবে, সেটিও ভালো কথা। কিন্তু মনে রাখতে হবে, আওয়ামী লীগ বাংলাদেশের বৃহৎ দল। আওয়ামী লীগকে বাদ দিয়ে বাংলাদেশে জাতীয় ঐকমত্য প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব নয়।”
অধ্যাপক ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তী সরকার ও গত জুলাই-আগস্টে শেখ হাসিনা বিরোধী আন্দোলনকারী ছাত্ররা বাংলাদেশে “রাজনৈতিক বিভাজন বাড়িয়ে দিয়েছে” বলে অভিযোগ করেন নাসিম।
গত আগস্টের পর আওয়ামী লীগকে টার্গেট করে আক্রমণ, নেতা-কর্মীর বাড়িঘর ভাঙা, লুটপাট, “শত শত নেতাকর্মীদের হত্যা” এবং সর্বশেষ বঙ্গবন্ধুর স্মৃতি বিজড়িত ধানমন্ডি ৩২ নম্বরের বাড়িটি ভেঙে দেবার ঘটনা উল্লেখ করে তিনি বলেন, “এগুলো করে কীভাবে জাতীয় ঐক্যমত্য প্রতিষ্ঠা হবে?”
প্রসঙ্গত, ছাত্র ও গণ আন্দোলনের মুখে গত ৫ আগস্ট পদত্যাগ করে ভারতে পালিয়ে যান তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ৮ আগস্ট নোবেল বিজয়ী অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে দেশের ক্ষমতা গ্রহণ করে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার।
নির্বাচন পেছানোর পক্ষে এনসিপি
দল গঠনের কয়েকদিন পরই গত ৪ মার্চ এনসিপির উত্তরাঞ্চলের মুখ্য সংগঠক সারজিস আলম সাংবাদিকদের বলেন, “আগামী নির্বাচনের আগেই শেখ হাসিনাকে বাংলাদেশে নিয়ে এসে ফাঁসির মঞ্চে নিতে হবে। যতদিন না আমরা খুনি হাসিনাকে ওই ফাঁসির মঞ্চে দেখছি, এই বাংলাদেশে কেউ যেন ভুলক্রমেও ওই নির্বাচনের কথা না বলে।”
তাঁর এই বক্তব্যের সমালোচনা করে বিএনপি’র স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী বেনারকে বলেন, “শেখ হাসিনার বিচারের সাথে আগামী নির্বাচনের কোনো সম্পর্ক নেই। শেখ হাসিনা ও আওয়ামী লীগের বিচার হতে হবে। আগামী নির্বাচিত সরকারও তাঁদের বিচারে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ থাকবে।”
তিনি বলেন, “অন্তর্বর্তী সরকার দ্রুত নির্বাচিত সরকারের কাছে দায়িত্ব হস্তান্তর করবে-মানুষ এটাই প্রত্যাশা করে।”
প্রসঙ্গত আগামী জাতীয় নির্বাচন চলতি বছরের শেষ অথবা আগামী বছরের প্রথমার্ধে অনুষ্ঠিত হতে পারে বলে বিভিন্ন সময় গণমাধ্যমকে জানিয়েছেন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস।
এদিকে বৃহস্পতিবার এক প্রতিবেদনে বার্তা সংস্থা রয়টার্স জানায়, দেশের জননিরাপত্তা এখনো পুরোপুরি নিশ্চিত না হওয়ায় এ বছর জাতীয় নির্বাচন আয়োজন করা কঠিন হতে পারে বলে মন্তব্য করেছেন এনসিপি’র আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম।
“গত সাত মাসে আমরা আশা করেছিলাম, কিছুটা সংস্কারের মাধ্যমে পুলিশের কার্যক্রম ও আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক হবে। কিছুটা উন্নতি হলেও তা প্রত্যাশার চেয়ে কম,” নাহিদ বলেন।
তিনি আরও বলেন, “বর্তমান আইনশৃঙ্খলা ও পুলিশের পরিস্থিতি দেখে মনে হচ্ছে, এর মধ্যে জাতীয় নির্বাচন আয়োজন করা সম্ভব নয়।”

জাতীয় ঐক্য নিয়ে বিতর্ক
বিএনপির চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা জহির উদ্দিন স্বপন বেনারকে বলেন, “এনসিপি জাতীয় ঐকমত্য প্রতিষ্ঠার যে কথা বলেছে, সেটি আমরাও বলি। জাতীয় ঐকমত্য প্রতিষ্ঠা প্রয়োজন। কিন্তু সেটা হতে হবে অংশীজনদের মধ্যে সংলাপের মাধ্যমে।”
তাঁর মতে, “বর্তমানে ছাত্রদের নতুন দলের নেতারা যেভাবে এগোচ্ছেন, সেটি সঠিক নয়। তাদের কাজের ধরণ হলো, তারা বলবে এবং আমরা সবাই তাদের কথায় সায় দিয়ে সেটি বৈধ করে দেবো। এটি তো গণতান্ত্রিক উপায় নয়।”
এনসিপি নেতারা জাতীয় ঐক্যমত্যের কথা বললেও “বিপরীতমুখী” “কাজ করছেন মন্তব্য করে তিনি বলেন, “এটি স্ববিরোধিতা।”
এদিকে এনসিপির যুগ্ম সদস্য-সচিব মুশফিক উস সালেহীন বেনারকে বলেন, “জাতীয় ঐকমত্য প্রতিষ্ঠা করতে গেলে বিএনপিসহ বিভিন্ন দলগুলোর মতামত নিয়েই করতে হবে। আমাদের বিশ্বাস এক পর্যায়ে বিএনপি আমাদের প্রস্তাবের গুরুত্ব বুঝবে এবং রাজী হবে।”
তিনি বলেন, “আওয়ামী লীগের ব্যাপারে আমাদের অবস্থান হলো দলটির যেসব নেতারা অপরাধ করেছে, অপরাধগুলোকে সমর্থন করেছে, তাদের বিচার হতে হবে। দল হিসাবে আওয়ামী লীগের বিচার হতে হবে।”
“তবে যেসব আওয়ামী লীগ নেতা কোনো অপরাধ করেননি তাঁরা যদি দলের কৃতকর্মের নিন্দা জানিয়ে--ভুল স্বীকার করে; তাহলে তাদের রাজনীতি করা নিয়ে আমাদের আপত্তি থাকবে না,” বলেন তিনি।
এ বিষয়ে আওয়ামী লীগের দেড় দশকের শাসনামলে বেশিরভাগ সময় বিরোধী দলের ভূমিকায় থাকা জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান জি এম কাদেরের মতে, “আওয়ামী লীগকে একেবারে বাদ দিয়ে নির্বাচনের মতো পরিস্থিতি তৈরি হয়নি।”
“গত নির্বাচনের সময়ও বলেছিলাম, বাংলাদেশের রাজনৈতিক বাস্তবতায় বিএনপি বা আওয়ামী লীগ—যেকোনো একটিকে বাদ দিয়ে অন্তর্ভুক্তিমূলক নির্বাচন হবে না। জনগণের প্রকৃত প্রত্যাশা ও ইচ্ছার প্রতিফলন তাতে ঘটবে না। জনগণ সিদ্ধান্ত নেবে তারা কাকে দেখতে চায়,” বলেন তিনি।