স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছর পর বাংলাদেশে শেখ মুজিব সম্পর্কে কথা বলা প্রতি নিয়তই বিপজ্জনক হয়ে উঠছে। বিশ্লেষকদের মতে, দেশটির প্রতিষ্ঠাতা মুজিবের কন্যার শাসনাধীন বাংলাদেশে সরকারি বিবরণের বাইরে যে কোনো ঐতিহাসিক বিশ্লেষণই বর্তমানে অপরাধ হিসেবে গণ্য।
যুক্তরাষ্ট্রের ইন্ডিয়ানা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজনীতি বিদ্যার অধ্যাপক সুমিত গাঙ্গুলীর মতে, শেখ মুজিবকে তাঁর কন্যা ও বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিজের সরকার ও আওয়ামী লীগের রক্ষাকবচ হিসেবে ব্যবহার করছেন।
শেখ হাসিনা তাঁর পূর্ববর্তী খালেদা জিয়া সরকার দ্বারা “ক্ষুণ্ণ হওয়া মুজিবের ভাবমূর্তি নির্মাণ করে চলেছেন,” মন্তব্য করে সুমিত বেনারকে বলেন, “তিনি একই সাথে তাঁর বাবার অর্জন ও অবদানকে সুরক্ষিত করার পাশাপাশি দেশের ওপর নিজের নিয়ন্ত্রণও সুসংহত করছেন।”
“এর কারণ হচ্ছে হাসিনার কর্তৃত্ববাদী মনোভাব। খালেদা জিয়া- যিনি নিজেও ধোয়া তুলসী পাতা ছিলেন না, বর্তমানে খুবই অসুস্থ। তাঁর দল বিএনপিকে শেখ হাসিনা প্রায় ধ্বংস করে দেয়ায় দলটি সম্পূর্ণ দিশেহারা। দেশের সব ধরনের প্রতিষ্ঠানই এখন সরকারের নিয়ন্ত্রণে,” বলেন সুমিত।
পাকিস্তান থেকে স্বাধীনতা সংগ্রামে নেতৃত্ব দেয়া শেখ মুজিব বাংলাদেশে সর্বসাধারণে শ্রদ্ধার পাত্র। ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ দেশের স্বাধীনতা ঘোষণাকারী শেখ মুজিব সরকারিভাবে বাংলাদেশের জাতির পিতা হিসেবে গণ্য। পাকিস্তানের বিপক্ষে নয় মাস স্বাধীনতা যুদ্ধের পর ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর বিজয় অর্জন করে বাংলাদেশ, দিনটি বাংলাদেশে ‘বিজয় দিবস’ হিসেবে গণ্য।
স্বাধীন দেশে ক্ষমতা গ্রহণের মাত্র চার বছরের মাথায় ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট সেনা সদস্যদের হাতে শেখ মুজিব সপরিবারে হত্যার শিকার হন।
সুমিত গাঙ্গুলীর মতে, খালেদা জিয়ার শাসনামলে শেখ মুজিবের ভাবমূর্তির যতটা অবনমন হয়েছিল, শেখ হাসিনা সেই ক্ষতি পুষিয়ে মুজিবের ভাবমূর্তিকে আরো বহু দূর পর্যন্ত বিস্তৃত করছেন। হাসিনা সরকারের আইনে শেখ মুজিবের সমালোচনাও অপরাধ হিসেবে গণ্য।
এ প্রসঙ্গে ওয়াশিংটন ডিসির থিংক-ট্যাংক উইলসন সেন্টারের এশিয়া কর্মসূচির উপপরিচালক মাইকেল কুগেলম্যান বেনারকে বলেন, সদ্য স্বাধীন অনেক দেশেই “স্বাধীনতা ও দেশের প্রতিষ্ঠাতা সম্পর্কিত বিষয়গুলো খুবই স্পর্শকাতর হয়ে থাকে।” এসব ক্ষেত্রে সমালোচনাকারীদের প্রায়ই “জাতীয়তাবাদ বিরোধী” হিসেবে গণ্য করা হয়।
তিনি বলেন, “ক্ষমতাসীন অনেকেই দেশের প্রতিষ্ঠাতার ভাবমূর্তিকে পূতপবিত্র হিসেবে সংরক্ষণ করতে চান, বাংলাদেশের ক্ষেত্রে যা আবার পারিবারিক বিষয়ও বটে।”
এর মানে হলো, কন্যাশাসিত বাংলাদেশে শেখ মুজিবের সমালোচনা “আগের যে কোনো সময়ের চেয়ে বেশি বিপজ্জনক,” বেনারকে বলেন কুগেলম্যান।
আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস ওয়াচের দক্ষিণ এশিয়া বিভাগের পরিচালক মীনাক্ষী গাঙ্গুলীর মতে, শেখ হাসিনা শুধু তাঁর এবং তাঁর প্রশাসনের প্রশংসাকেই অনুমোদনযোগ্য বলে মনে করেন।
“প্রশংসা করার মতো বিষয় সেখানে রয়েছে, কিন্তু দুর্বলতাগুলো চিহ্নিত করাও নাগরিক সমাজের কাজ,” বেনারকে বলেন মীনাক্ষী।
এ বিষয়ে মন্তব্যের জন্য ওয়াশিংটন ডিসিতে বাংলাদেশ দূতাবাসের সাথে বেনারের পক্ষ থেকে যোগাযোগ করে তাৎক্ষণিক কোনো সাড়া পাওয়া যায়নি।
![ঢাকায় নিজ বাসভবনে দর্শনার্থীদের সাথে কথা বলছেন বাংলাদেশের জাতির পিতা শেখ মুজিবুর রহমান। ১৪ মার্চ ১৯৭১। [এপি]](/resizer/v2/CMMBH2VYGB32G4ELTYMLGKSHM4.jpg?auth=9adbeea9648f9ffee9b8e64bcc712736298dd78820527417fc1f6978f489c5f1&width=800&height=450)
সমালোচনা দমনের হাতিয়ার ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন
সরকার ও নিজের বাবা শেখ মুজিবুর রহমানের সমালোচনা দমন করতে হাসিনা সরকারের প্রিয় হাতিয়ার ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন।
এই আইনে পরোয়ানা ছাড়াই সন্দেহভাজনকে পুলিশ গ্রেপ্তার করতে পারে। আইনটির বেশিরভাগ ধারাই অজামিনযোগ্য, ফলে এই আইনের অধীনে গ্রেপ্তার হওয়া মানে প্রায় অবধারিত কারাবাস।
ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দেয়া বা সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিনষ্ট করার অপরাধে সাজা ছাড়াও ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন অনুসারে কেউ যদি “বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, জাতির পিতা, জাতীয় সংগীত বা জাতীয় পতাকার বিরুদ্ধে কোনো প্রকার প্রপাগান্ডা ও প্রচারণা চালান বা উহাতে মদদ প্রদান করেন,” তবে তাও শাস্তিযোগ্য অপরাধ।
এই আইনে কেউ অপরাধী প্রমাণিত হলে সর্বোচ্চ ১৪ বছর কারাদণ্ডের পাশাপাশি এক কোটি টাকা অর্থদণ্ড বা উভয়দণ্ডে দণ্ডিত হতে পারেন।
“কেউ যাতে শেখ হাসিনা এবং তাঁর সরকারের সমালোচনা করতে না পারে,” মূলত সেজন্যই ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনটি তৈরি করা হয়েছে বলে মনে করেন সুমিত গাঙ্গুলী।
“কর্তৃত্ববাদীরা সমালোচনা পছন্দ করে না- হাসিনা এবং খালেদা দুজনেরই কর্তৃত্ববাদী প্রবণতা রয়েছে,” বলেন তিনি।
বাংলাদেশে বর্তমানে সরকার বিরোধীদের কথা বলার প্রায় কোনো সুযোগই নেই বলে মনে করেন কুগেলম্যান।
তিনি বলেন, “বাংলাদেশ, যেখানে স্বাধীন মত প্রকাশের সুযোগ ক্রমশই সংকুচিত হচ্ছে, সেখানে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমটাই ছিল সমালোচনাকারীদের একমাত্র বিকল্প, সরকার সেখানেও হস্তক্ষেপ করেছে।”
তাঁর মতে, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনটি মূলত সরকারের অপছন্দের বিষয়াদির ওপর “দমন অভিযান” ছাড়া কিছু নয়।
সুমিত গাঙ্গুলীর মতে, শেখ মুজিব সম্পর্কে বাংলাদেশের গণমাধ্যম এতটাই ভীত যে, কিছু কিছু ক্ষেত্রে স্বয়ং ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের সমালোচনা করা হলেও আইনটির ভয়ে বাংলাদেশে শেখ মুজিব সম্পর্কিত বিশ্লেষণ ও সমালোচনা প্রায় অনুপস্থিত।
সুমিত গাঙ্গুলীর কথার সত্যতা পাওয়া যায় যখন ওয়াশিংটন ডিসি থেকে এ বিষয়ে মন্তব্যের জন্য বেনারনিউজের পক্ষে বাংলাদেশি গণমাধ্যম সম্পাদকদের সাথে ইমেইলে যোগাযোগ করা হয়। “এ বিষয়ে এখন কথা বলা যাবে না,” জাতীয় মন্তব্য করে তাঁরা সকলেই বিষয়টি সম্পর্কে মন্তব্য করতে অপারগতা প্রকাশ করেন।
![ঢাকায় শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতিকৃতির সামনে দিয়ে যাত্রী নিয়ে যাচ্ছেন এক রিকশা চালক। ১ ডিসেম্বর ২০২১। [এএফপি]](/resizer/v2/EFBB3EAOBRWFISIWU74PRJGAFA.jpg?auth=013283f17560112971d8c343aa88a7253730236e08cbc710e217f0dc055c057b&width=800&height=450)
গানের জন্য কারাদণ্ড
খুলনায় তন্ময় মালিক নামে একজনকে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের পূর্বতর সংস্করণ আইসিটি আইনে ২০১৪ সালের সেপ্টেম্বর সাজা দেয় আদালত।
একটি ইলেক্ট্রনিকস দোকানের মালিক ২৭ বছর বয়স্ক তন্ময়ের অপরাধ ছিল শেখ হাসিনা ও শেখ মুজিবকে নিয়ে একটি গান লেখা। গানটি তন্ময়ের বন্ধুরা মাইক বাজিয়ে গাওয়ার পরই তাঁর নামে মামলা হয়, এবং বিচার শেষে গানটি লেখার অপরাধে তন্ময়কে সাত বছরের কারাদণ্ড দেয় আদালত।
পরবর্তী সময়ে সারা দেশেই শেখ মুজিবের সমালোচনা বন্ধ হয়ে তাঁর ব্যাপক বন্দনা বাড়তে থাকে। ২০২০ সালে শেখ মুজিবুর রহমানের জন্ম শতবর্ষ উদযাপন উপলক্ষে সারা দেশে সরকারি তহবিলে তাঁর এক হাজারের বেশি ভাস্কর্য স্থাপন করা হয়।
আওয়ামী লীগের দুইজন নির্বাচিত পৌর মেয়রকেও সম্প্রতি ‘শেখ মুজিব অবমাননা’র দায়ে পদ ছাড়তে হয়।
এদের মধ্যে, বঙ্গবন্ধুর মুরাল স্থাপন “ইসলামি শরিয়ত মোতাবেক সঠিক না” বলার দায়ে ডিসেম্বরে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মামলায় গ্রেপ্তারও হন রাজশাহীর কাটাখালী পৌরসভার মেয়র আব্বাস আলী।
এর আগে গত সেপ্টেম্বরে বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধকালে শহীদের সংখ্যা ৩০ লাখ নিয়ে সন্দেহ প্রকাশের দায়ে গত নভেম্বরে গাজীপুর সিটি করপোরেশনের মেয়র জাহাঙ্গীর আলমকে তাঁর পদ থেকে সাময়িক বরখাস্ত করে সরকার।
মুক্তিযুদ্ধকালে তিন মিলিয়ন (৩০ লাখ) বাংলাদেশি শহীদ হওয়ার তথ্যটি প্রথম লন্ডনে এক সংবাদ সম্মেলনে শেখ মুজিব নিজেই দিয়েছিলেন। তবে তাঁর বলা এই সংখ্যাটি সম্পর্কে ২০১১ সালে অক্সফোর্ডের এক অধ্যাপকের বইয়ে সন্দেহ প্রকাশ করা হয়েছে। এতে বলা হয়, শেখ মুজিব হয়তো শহীদের সংখ্যা ‘তিন লাখ’ বলতে গিয়ে ভুলবশত ‘তিন মিলিয়ন’ বলে ফেলেছেন, যা পরবর্তীতে সরকারি সংখ্যা ‘ত্রিশ লাখ’ হিসেবে গ্রন্থিত হয়েছে।
কিন্তু বাংলাদেশে “জাতীয়তাবাদের নামে কিছু ঐতিহাসিক বিবরণ ধরাছোঁয়ার ঊর্ধ্বে রাখার স্বার্থে শহীদের সংখ্যা নিয়ে প্রশ্ন তোলার সুযোগ নেই,” বলেন মীনাক্ষী গাঙ্গুলী।
প্রসঙ্গত, এখন পর্যন্ত মুক্তিযুদ্ধকালে শহীদের সংখ্যা বিষয়ক কোনো জরিপ প্রতিবেদন বাংলাদেশে প্রকাশিত হয়নি।
মুজিব 'গণতন্ত্রী ছিলেন না '
সুমিত গাঙ্গুলীর মতে, বর্তমানে হাসিনা যা করছেন, তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বী খালেদা জিয়া ক্ষমতায় থাকলে একই কাজ করতেন, এমনকি আজ যদি স্বয়ং শেখ মুজিবও ক্ষমতায় থাকতেন, তবে তিনিও হয়তো একই কাজ করতেন।
অথবা বেঁচে থাকলে বাক স্বাধীনতার ওপর শেখ হাসিনার দমনপীড়ন দেখে শেখ মুজিবও “হয়তো আপত্তি করতেন না,” বলেন সুমিত।
“তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা রেখেই বলা যায়, মুজিব নিজেও গণতান্ত্রিক ছিলেন না। তাঁর শাসনামলের শেষ দিকে তিনি দেশের সব রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধ করে দিয়েছিলেন,” মন্তব্য করে সুমিত গাঙ্গুলী বলেন, “মুজিব বেড়ে উঠেছিলেন এক কর্তৃত্ববাদী রাষ্ট্রে, এছাড়া পাকিস্তান ছিল একইসাথে একটি দুর্নীতিগ্রস্ত দেশ।”
এ প্রসঙ্গে কুগেলম্যান বলেন, “মুজিব স্বাধীনতা রক্ষায় সোচ্চার হলেও, আমি নিশ্চিত না, স্বাধীনতার পক্ষে তাঁর এই অবস্থান সমাজের সাধারণ অধিকার ও মত প্রকাশের স্বাধীনতা পর্যন্ত বিস্তৃত হতো কি না।”
“স্বাধীনতা যুদ্ধ ও স্বাধীনতা আন্দোলনের গণতান্ত্রিক অনেক নেতাকেই পরবর্তীকালে আমরা স্বৈরাচারের ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে দেখি,” বলেন কুগেলম্যান।