জামায়াত নেতা সাঈদীর মৃত্যু: ঢাকা, চট্টগ্রাম ও কক্সবাজারে পুলিশের সাথে সংঘর্ষ

কামরান রেজা চৌধুরী
2023.08.15
ঢাকা
জামায়াত নেতা সাঈদীর মৃত্যু: ঢাকা, চট্টগ্রাম ও কক্সবাজারে পুলিশের সাথে সংঘর্ষ বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধকালীন মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে আমৃত্যু কারাদণ্ডপ্রাপ্ত জামায়াত নেতা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর মৃত্যুকে কেন্দ্র করে জামায়াত–শিবিরের নেতাকর্মীরা ঢাকার বায়তুল মোকাররম জাতীয় মসজিদ প্রাঙ্গণে বিক্ষোভ প্রদর্শনের চেষ্টা করলে পুলিশ তাদের ছত্রভঙ্গ করে দেয়। ১৫ আগস্ট ২০২৩।
[বেনারনিউজ]

জামায়াত নেতা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর মৃত্যুকে কেন্দ্র করে দেশের বিভিন্ন স্থানে পুলিশের সাথে জামায়াত-শিবির কর্মীদের সংঘর্ষ হয়েছে। এসব ঘটনায় একজনের মৃত্যু হয়েছে, আহতের সংখ্যা প্রায় ৫০, গ্রেপ্তার হয়েছেন অন্তত ৪০ জন।।

সোমবার রাতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতালে মানবতাবিরোধী অপরাধে দণ্ডিত সাঈদী (৮৩) মারা যান।

ঢাকা ছাড়াও চট্টগ্রাম ও কক্সবাজারে গায়েবানা জানাজা করার চেষ্টা করেন জামায়াত-শিবির কর্মীরা। ওইসব এলাকায় পুলিশের সাথে তাঁদের সংঘর্ষ হয়েছে।

কক্সবাজারের চকরিয়ায় পুলিশের সাথে জামায়াত-শিবির নেতাকর্মীদের সংঘর্ষ চলাকালে জামায়াত কর্মী মো. ফোরকানুর রহমান (৫০) নিহত হয়েছেন। জামায়াত দাবি করেছে, পুলিশের গুলিতে তাঁর মৃত্যু হয়, পুলিশ এই অভিযোগ অস্বীকার করেছে।

এদিকে চকরিয়ার পেকুয়ায় পুলিশের ওপর জামায়াত কর্মীরা হামলা করলে ওসিসহ ২০জন আহত হয়েছেন বলে স্থানীয় সাংবাদিকদের নিশ্চিত করেছে চকরিয়া থানা পুলিশ।

চট্টগ্রামে গায়েবানা জানাজার চেষ্টা করলে পুলিশ জামায়াত-শিবির কর্মীদের ছত্রভঙ্গ করে দেয়। এসময় ১৫ জন আহত ও ৩০ জনকে গ্রেপ্তার করার কথা সাংবাদিকদের জানান কোতোয়ালি থানার ওসি জাহিদুল কবির।

জামায়াতের পক্ষ থেকে ঢাকায় জানাজা করার চেষ্টা করা হলেও পুলিশ অনুমতি দেয়নি। এমনকি বুধবার ঢাকায় গায়েবানা জানাজা করারও অনুমতি মেলেনি।

মঙ্গলবার দুপুরে ঢাকায় বায়তুল মোকাররম জাতীয় মসজিদ প্রাঙ্গণে জামায়াত-শিবিরের একদল কর্মী সাঈদীর গায়েবানা জানাজা আয়োজন করতে গেলে আওয়ামী লীগ কর্মীদের সঙ্গে তাদের ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া হয়। এসময় অন্তত পাঁচজন আহত হয়।

পুলিশ লাঠিচার্জ করে সাঈদী সমর্থকদের ছত্রভঙ্গ করে দেয়, গ্রেপ্তার করে কয়েকজনকে। তবে পুলিশ গ্রেপ্তারের সংখ্যা জানায়নি।

এর আগে মঙ্গলবার ভোর রাতে জামায়াত ও এর অঙ্গ সংগঠনের নেতাকর্মীরা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণ দখল করে সাঈদীর মরদেহ আটকে রাখে, জোর করে জানাজা করার চেষ্টা চালায়। এসময় পুলিশসহ ৮-১০ জন আহত হয়।

ঢাকা মহানগর পুলিশ কমিশনার খন্দকার ফারুক আহমেদ মঙ্গলবার সংবাদ ব্রিফিংয়ে জানান, তারা পুলিশের ওপর আক্রমণ করে এবং কয়েকটি মোটর সাইকেলে আগুন ধরিয়ে দেয়। সেকারণে তাদের ওপর মৃদু শক্তি প্রয়োগ করা হয়।

তবে জামায়াত নেতাদের মতে, তাঁরা ঢাকায় সাঈদীর জানাজা করতে চাইলে পুলিশ সেই অনুমতি দেয়নি। বরং পুলিশ তাঁদের ওপর আক্রমণ করেছে বলে ফেসবুক লাইভে দাবি করা হয়।

মঙ্গলবার পিরোজপুর শহরের সাঈদী ফাউন্ডেশন মাঠে জানাজা শেষে ফাউন্ডেশনের কাছে তাঁকে সমাধিস্থ করা হয় বলে জামায়াতে ইসলামীর পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে। জানাজায় কয়েক হাজার মানুষ অংশ নেন।

গাজীপুরে কাশিমপুর কারাগারে সাঈদী বুকে ব্যথা অনুভব করলে তাঁকে সোমবারই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতালে নেওয়া হয়।

সেখানেই তিনি হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যান বলে সাংবাদিকদের জানায় হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ।

তবে সাঈদীর ছেলে মাসুদ বিন সাঈদী মঙ্গলবার সাংবাদিকদের বলেন, কারা কর্তৃপক্ষ তাদের সঠিক তথ্য দেয়নি। কী হয়েছে, কোন হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে তাও বলা হয়নি।

মাসুদ বলেন, গত ৫০ বছর ধরে তাঁর বাবা ডায়াবেটিকে আক্রান্ত, হার্টে পাঁচটি রিং পরানো। কিন্তু তিনি সুচিকিৎসা পাননি।

09fb026d-5343-4fc3-beb9-1d532c2f3e4e.jpg
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধকালীন মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে আমৃত্যু কারাদণ্ডপ্রাপ্ত জামায়াত নেতা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর গায়েবানা জানাজাকে ঘিরে সংঘর্ষকালে চট্টগ্রামে ওয়াসায় এলাকা থেকে জামায়াত–শিবিরের নেতাকর্মীদের আটক করে নিয়ে যাচ্ছে পুলিশ। ১৫ আগস্ট ২০২৩। [বেনারনিউজ]

আইনশৃঙ্খলা বাহিনী সক্রিয় ছিল

১৫ আগস্ট জাতীয় শোক দিবস উপলক্ষে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী আগে থেকেই তৎপর ছিল। ১৪ আগস্ট রাতে সাঈদীর মৃত্যুর পর উদ্ভূত পরিস্থিতিতে বাহিনীগুলো আরও সক্রিয় হয়।

এ ছাড়া শোক দিবসের নানা অনুষ্ঠান নিয়ে মাঠে ছিলেন ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা। ১৫ আগস্ট শহরজুড়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ভাষণ বাজানো হয়।

সাঈদীর মৃত্যুর খবর ছড়িয়ে পড়লে রাত এগারোটার দিকে জামায়াত-শিবিরের কর্মীরা হাসপাতাল প্রাঙ্গণসহ শাহবাগের আশেপাশে অবস্থান নিতে শুরু করেন।

জামায়াতের ফেসবুক পেজ থেকে প্রতিটি ঘটনা সরাসরি প্রচার করা হয় এবং তাঁদের নেতা-কর্মীদের ঢাকায় জানাজায় অংশগ্রহণের আহ্বান জানানো হয়।

পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের জন্য শাহবাগ এলাকায় বিপুলসংখ্যক পুলিশ মোতায়েন করা হয়।

ঢাকার পুলিশ কমিশনার গোলাম ফারুক মঙ্গলবার সকালে এক সংবাদ সম্মেলনে জানান, পরিবারের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী লাশ ময়না তদন্ত ছাড়াই মঙ্গলবার ভোরে সাঈদীর গ্রামের বাড়ি পিরোজপুর জেলায় পাঠানোর সময় জামায়াত ও এর অঙ্গ সংগঠন ইসলামী ছাত্র শিবিরের কর্মীরা অ্যাম্বুলেন্সের সামনে শুয়ে পড়েন। রাবার বুলেট ও কাঁদানে গ্যাস ছুঁড়ে তাদের ছত্রভঙ্গ করে দেয়ার পর পুলিশের পাহারায় মরদেহ পিরোজপুরে পাঠানো হয়।

দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী। ফাইল ছবি। [বেনারনিউজ]
দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী। ফাইল ছবি। [বেনারনিউজ]
সাঈদীর মৃত্যু ও রাজনীতিতে জামায়াত

দেশের প্রধান রাজনৈতিক বিরোধী দল বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের (বিএনপি) প্রধান রাজনৈতিক মিত্র বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী দেশের সবচেয়ে বড়ো ইসলামী দল। দেশের ভোটের রাজনীতিতে তাদের গুরুত্ব রয়েছে।

তবে যুদ্ধাপরাধের দায়ে আদালতের রায় অনুযায়ী নির্বাচন কমিশন দলটির নিবন্ধন বাতিল করেছে। এরপর থেকে দলটি প্রকাশ্যে সভা-সমাবেশ করতে পারে না। গত কয়েক বছরের মধ্যে সম্প্রতি দলটি ঢাকায় একটি বড়ো সমাবেশ করে। এরপর জামায়াত কয়েক দফা সমাবেশ করার অনুমতি চাইলেও পুলিশ তা দেয়নি। দলটির উল্লেখযোগ্য নেতাদের অনেকেই জেলে রয়েছেন।

১৯৯৬ সালে কোনো জোটে অংশগ্রহণ ছাড়া এককভাবে নির্বাচন করে জামায়াত মোট ভোটের শতকরা ৮ দশমিক ৬১ ভাগ ভোট পায়। অন্যদিকে ২০০৯ সালে বিএনপির সাথে জোটবদ্ধ হয়ে নির্বাচনে অংশ নিয়ে চার দশমিক সাত ভাগ ভোট পায় দলটি।

সাংগঠনিকভাবে শক্তিশালী হলেও জামায়াতের ভোট কম হওয়ার অন্যতম কারণ হলো ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে তাদের ভূমিকা।

বর্তমান ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ শুরু হলে জামায়াত বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিপক্ষে অবস্থান নেয়।

রাজাকার, আল-বদর, আল-শামসসহ বিভিন্ন দল গঠন করে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর পাশাপাশি তারাও তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে হত্যা, খুন, ধর্ষণ, গুম, অগ্নিসংযোগসহ সংখ্যালঘু হিন্দুদের জোর করে ধর্মান্তরিত করাসহ বিভিন্ন মানবতাবিরোধী অপরাধের সাথে যুক্ত হয়ে পড়ে।

জামায়াতের যেসব নেতার বিরুদ্ধে এমন অপরাধের নেতৃত্ব দেয়ার অভিযোগ রয়েছে তাঁরা হলেন; গোলাম আযম, মতিউর রহমান নিজামী, দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী, আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ, মো. কামারুজ্জামান, আব্দুল কাদের মোল্লা, আব্দুস সোবহানসহ আরও অনেকে।

জামায়াতের এসব নেতা ১৯৭১ সালে তাঁদের অপরাধ এবং রাজনৈতিক ভুলের জন্য কখনও ক্ষমা চাননি। তাঁরা বাংলাদেশের স্বাধীনতাকে রাজনৈতিকভাবে ভারতীয় আগ্রাসন বলে মনে করতেন।

১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট এক সামরিক অভ্যুত্থানে বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের মূল নেতা ও জাতির জনক শেখ মুজিবুর রহমান সপরিবারে প্রাণ হারানোর পর ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত সামরিক শাসক মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমানের সময় রাজনীতিতে প্রতিষ্ঠা পায় জামায়াত।

রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, যুদ্ধাপরাধের সাথে সংশ্লিষ্ট জামায়াতের ওইসব নেতার কারণে স্বাধীন বাংলাদেশের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে একটি নায্য যুদ্ধ বলে স্বীকার করেনি দলটি। বরং রাজাকারের দল হিসাবে আখ্যা পেয়েছে জামায়াত।

২০০৯ সালে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়ে ১৯৭১ সালের যুদ্ধাপরাধের দায়ে ফাঁসি দেয়া হয় মতিউর রহমান নিজামী, আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ, মো. কামারুজ্জামান, আব্দুল কাদের মোল্লাসহ কয়েকজনকে।

আমৃত্যু কারাবাস দেয়া হয় গোলাম আযম এবং দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীকে।

তবে জামায়াতের অন্যান্য নেতাদের চেয়ে সবচেয়ে বেশি জনপ্রিয় ছিলেন সাঈদী। তার ইসলামী জলসা বা ওয়াজ মাহফিলে লাখ লাখ মানুষ অংশ নিতেন।

১৯৯৬ সালে জামায়াতে যে তিনজন নেতা সংসদ-সদস্য নির্বাচিত হন তাঁদের একজন ছিলেন সাঈদী।

000_33RA3EG.jpg
পিরোজপুরে জামায়াত নেতা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর জানাজার অ্যারিয়েল ফটো। ১৫ আগস্ট ২০২৩। [এএফপি]

জামায়াতের ফেসবুক পেজে জানানো হয়েছে, সাঈদীর মৃত্যুতে শোক জানিয়েছেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান ও মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। অরাজনৈতিক হলেও কওমি মাদ্রাসাভিত্তিক ইসলামি মোর্চা হেফাজতে ইসলামও শোক প্রকাশ করেছে।

রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. নিজাম উদ্দিন আহমেদ মঙ্গলবার বেনারকে বলেন, “জামায়াতের যেসব বড়ো নেতা স্বাধীনতার বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছিলেন যুদ্ধাপরাধের বিচারের মাধ্যমে তাঁদের প্রায় সবার ফাঁসি হয়েছে অথবা কারাগারে মারা গেছেন।”

তিনি বলেন, “সাঈদীর মৃত্যুতে জামায়াতের পুরানো পাকিস্তানপন্থী রাজনীতিকদের প্রায় সবাই চলে গেলেন।”

অধ্যাপক নিজাম বলেন, “এর ফলে জামায়াতের রাজনীতিতে একটি ইতিবাচক পরিবর্তন আসতে পারে বলে আমি মনে করি। ১৯৭১ সালের পরের প্রজন্মের হাতে জামায়াতের নেতৃত্ব চলে আসলে তাঁরা হয়তো তাঁদের পূর্ব পুরুষদের অপকর্মের দায় নেবেন না এবং ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে ভূমিকার জন্য তারা জাতির কাছে ক্ষমা চাইবে।”

তিনি বলেন, “সেক্ষেত্রে ভবিষ্যতে বাংলাদেশের রাজনীতিতে ইতিবাচক ভূমিকা রাখতে পারে জামায়াত। তবে তাদের সহিংস রাজনৈতিক কৌশল অবশ্যই বন্ধ করতে হবে।”

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।