পরীমনির রিমান্ড: দুই বিচারকের ব্যাখ্যায় হাইকোর্টের অসন্তোষ
2021.09.15
ঢাকা
চিত্রনায়িকা পরীমনিকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য তিন দফা রিমান্ড মঞ্জুরের বিষয়ে ঢাকা মহানগর হাকিম আদালতের দুই বিচারক ক্ষমা চাইলেও তাঁদের দেওয়া ব্যাখ্যায় সন্তুষ্ট হয়নি উচ্চ আদালত।
দুই ম্যাজিস্ট্রেট; দেবব্রত বিশ্বাস ও আতিকুল ইসলামের বক্তব্য “হাইকোর্টকে আন্ডারমাইন করেছে” অভিমত প্রকাশ করে বিষয়টির উপর পরবর্তী আদেশের জন্য আগামী ২৯ সেপ্টেম্বর দিন ধার্য করেছে উচ্চ আদালত।
বুধবার দুই বিচারকের পৃথক লিখিত ব্যাখ্যা বিচারপতি মোস্তফা জামান ইসলাম ও বিচারপতি কে এম জাহিদ সারওয়ার কাজলের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চে উপস্থাপন করলে আদালত এ আদেশ দেয়।
“হাইকোর্টের এই সিদ্ধান্ত যথাযথ। হাইকোর্টের মাননীয় বিচারকদ্বয় রিমান্ডের অপব্যবহার বন্ধে এবং মানুষের প্রতি ন্যায়বিচারের পক্ষে শক্ত অবস্থান নিয়েছেন। এতে বিচারবিভাগের প্রতি মানুষের আস্থা ও শ্রদ্ধাবোধ বাড়বে,” বেনারকে বলেন আবেদনকারী মানবাধিকার সংস্থা আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) আইনজীবী জেড আই খান পান্না।
তবে শুধু এই একটি ঘটনায় হাইকোর্টের হস্তক্ষেপের কারণে রিমান্ডের অপব্যবহার বন্ধ হবে বলে মনে করেন না সুপ্রিম কোর্টের বিশিষ্ট আইনজীবী এডভোকেট মঞ্জিল মোরশেদ।
“রিমান্ডের অপব্যবহার নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা। এগুলো বন্ধ করতে হলে সকল ঘটনার ক্ষেত্রেই হাইকোর্টের নজরদারি থাকা দরকার,” বেনারকে বলেন তিনি।
এর আগে একই বেঞ্চ গত ২ সেপ্টেম্বর পরীমনির দ্বিতীয় ও তৃতীয় দফায় রিমান্ড মঞ্জুরের বিষয়ে দুই ম্যাজিস্ট্রেটকে লিখিত ব্যাখ্যা দেওয়ার নির্দেশ দেয়।
গত ৮ সেপ্টেম্বর পাঁচ পৃষ্ঠায় প্রকাশিত ওই আদেশে চিত্রনায়িকা পরীমনিকে তিন দফা রিমান্ডে নেওয়ার ঘটনায় প্রশ্ন তুলে হাইকোর্ট বলে, “পুলিশ ডিপার্টমেন্টের বোঝা উচিত—মানুষের জীবন অত্যন্ত মূল্যবান। আইনি ভিত্তি ছাড়া পুলিশ রিমান্ড চাইতে পারে না। অথচ, পুলিশ পরীমনিকে তিন বার রিমান্ডে নিয়েছে, যা ফৌজদারি বিচার ব্যবস্থাকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে।”
গত ৪ আগস্ট বনানীতে অভিযান চালিয়ে পরীমনিকে গ্রেপ্তার করে র্যাব। আটকের সময় তাঁর বাসায় কয়েক বোতল মদ এবং কিছু নিষিদ্ধ মাদকদ্রব্য পাওয়া যায় বলে র্যাবের পক্ষ থেকে জানানো হয়। পরদিন এ বিষয়ে তাঁর বিরুদ্ধে বনানী থানায় মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইনে মামলা হয়।
পরবর্তীতে পরীমনিকে পুলিশের কাছে হস্তান্তর করা হলে তাঁকে আদালতে হাজির করে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য রিমান্ডের আবেদন করা হয়।
ঢাকা মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালত প্রথম দফায় চার দিনের পুলিশি রিমান্ড মঞ্জুর করে। প্রথম দফা রিমান্ড শেষে আরেক দফা রিমান্ড আবেদন করে পুলিশ। তখন আরও দুদিনের রিমান্ড মঞ্জুর করে আদালত। এরপর আরেক দফা রিমান্ড আবেদন করলে এক দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করে আদালত।
গত ৩১ আগস্ট পরীমনিকে জামিন দেয় বিচারিক আদালত। এরপর ১ সেপ্টেম্বর কাশিমপুর কেন্দ্রীয় মহিলা কারাগার থেকে মুক্তি পান চিত্রনায়িকা পরীমনি।
রিমান্ড আদেশ ছিল “অনিচ্ছাকৃত ভুল”
বুধবার হাইকোর্টের কাছে প্রদত্ত পৃথক ব্যাখ্যায় উক্ত দুই বিচারক বলেছেন-রিমান্ড মঞ্জুরের ক্ষেত্রে ত্রুটি-বিচ্যুতি হয়ে থাকলে তা অনিচ্ছাকৃত ও সরল বিশ্বাসে হয়েছে। এই ভুলত্রুটি মার্জনা করে অধিক ব্যাখ্যার দায় থেকে তাঁদের অব্যাহতি দেওয়ার আরজি জানানো হয়।
শুনানিকালে হাইকোর্ট বেঞ্চের জ্যেষ্ঠ বিচারক বিচারপতি মোস্তফা জামান ইসলাম দুই ম্যাজিস্ট্রেটের দাখিল করা ব্যাখ্যার অংশবিশেষ পড়ে শোনান।
তিনি বলেন, “আমরা তাঁদের (বিচারক) কারণ দর্শাতে বলেছি, কেন দ্বিতীয় ও তৃতীয় দফায় রিমান্ড মঞ্জুর করা হয়েছে? এখানে তাঁরা বলছেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন ছাত্র এলএসডি গ্রহণের পর একজন ডাব বিক্রেতার কাছ থেকে ছুরি নিয়ে নিজের গলায় পোঁচ মেরেছেন।”
বিচারপতি বলেন, দুই হাকিমের একজন তাঁর ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে একটি দৃষ্টান্ত তুলে ধরে মাদকের ভয়াবহতার কথা লিখেছেন। তিনি উচ্চ আদালতকে শিক্ষা দিতে চেয়েছেন। আরেকজন হাকিম রিমান্ড মঞ্জুরের ক্ষেত্রে যে ত্রুটি হয়েছে, তা বিশ্বাসই করেন না।
“রিমান্ড নিয়ে হাইকোর্ট ও সুপ্রিম কোর্টের যে গাইডলাইন এবং আমাদের প্রচলিত আইন আছে, তাঁরা (দুই ম্যাজিস্ট্রেট) এগুলোর বিরুদ্ধে। যে কারণে তাঁদের জবাবে আমরা সন্তুষ্ট নই। এই মামলায় দ্বিতীয় ও তৃতীয় দফা রিমান্ড মঞ্জুর করার ক্ষেত্রে আমরা সন্তুষ্ট নই, যে কারণে পরবর্তী আদেশের জন্য ২৯ সেপ্টেম্বর পরবর্তী তারিখ রাখলাম,” বলেন তিনি।
এর আগে রিমান্ড চাওয়ার কারণ ও নিজের অবস্থান ব্যাখ্যা করতে নথিসহ (সিডি) মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তাকে ১৫ সেপ্টেম্বর আদালতে হাজির হতে নির্দেশ দেওয়া হয়। সেই নির্দেশ অনুযায়ী আজ তদন্ত কর্মকর্তা আদালতে উপস্থিত হয়ে সিডি উপস্থাপন করলে তাঁকে আগামী ২৯ সেপ্টেম্বর পরবর্তী আদেশের দিন উপস্থিত থাকার নির্দেশ দেয়।
পরীমনির মামলায় উচ্চ আদালতের এই অবস্থানের পর রিমান্ডের অপব্যবহার ও নির্যাতনের বিষয়টি আবার বড়ো করে আলোচনায় এসেছে।
দেশে রিমান্ডের নামে মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা অহরহ ঘটছে বলে অভিযোগ করেছেন মানবাধিকার কর্মীরা। আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলো কারণে-অকারণে আসামিদের রিমান্ডে নিতে চায় এবং নিম্নআদালত তা মঞ্জুর করে বলে অভিযোগ আছে।
বাংলাদেশে বর্তমানে “কাউকে আটক করার সঙ্গে সঙ্গে রিমান্ড চাওয়াটা দেশের আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর রীতিতে পরিণত হয়ে গেছে,” বলে বেনারের কাছে মন্তব্য করেন মানবাধিকার কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান ড. মিজানুর রহমান।
“জটিল কোনো মামলায় তাৎপর্যপূর্ণ বা প্রয়োজনীয় তথ্যের জন্য রিমান্ড প্রয়োজনীয় হতে পারে। কিন্তু যেভাবে ঢালাওভাবে ব্যবহার করা হচ্ছে, এতে করে এর গ্রহণযোগ্যতা, কার্যকারিতা সবকিছুই নষ্ট হয়ে গেছে। মানবাধিকার লঙ্ঘনের অন্যতম হাতিয়ারও হয়ে গেছে রিমান্ড,” বলেন তিনি।