বিরোধিতার মুখে সংসদে বিদ্যুতের বিশেষ আইন পাশ

কামরান রেজা চৌধুরী
2021.09.16
ঢাকা
বিরোধিতার মুখে সংসদে বিদ্যুতের বিশেষ আইন পাশ ঘন ঘন বিদ্যুৎ চলে যায় তাই রাতে ঘরে আলোর ব্যবস্থা করতে হারিকেন কিনছেন ঢাকার বাসিন্দারা। ১৩ এপ্রিল ১৯৯৯।
[রয়টার্স]

বিরোধী দলের তীব্র সমালোচনা ও বিরোধিতার মুখেই জরুরি ভিত্তিতে বিদ্যুৎ ঘাটতি মেটাতে এক দশক আগের বিতর্কিত বিশেষ আইনের মেয়াদ আরও পাঁচ বছর বৃদ্ধি করতে জাতীয় সংসদে বৃহস্পতিবার একটি বিল পাশ হয়েছে। ওই আইনের আওতায় অন্তত ৬৫টি বিদ্যুৎকেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল, যেগুলো ‘কুইক রেন্টাল প্লান্ট’ নামে পরিচিত। 

বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ “বিদ্যুৎ ও জ্বালানির দ্রুত সরবরাহ বৃদ্ধি (বিশেষ বিধান) (সংশোধন) বিল-২০২১” প্রস্তাব করলে তা কণ্ঠভোটে পাশ হয়। প্রতিমন্ত্রী বুধবার বিলটি সংসদে উত্থাপন করেছিলেন। বিরোধী দলের সংসদ সদস্যদের মতে, বিশেষ এই আইনের মাধ্যমে অনিয়ম-দুর্নীতির বৈধতা দেওয়া হচ্ছে। 

তবে বিলটি সংশোধনের উদ্দেশ্য ও কারণ সম্পর্কে নসরুল হামিদ জাতীয় সংসদে বলেন, “টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জন, ২০৩০ সালের মধ্যে উচ্চ মধ্য আয়ের দেশ এবং ২০৪১ সালের মধ্যে উন্নত দেশে পরিণত হওয়ার লক্ষ্যে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতের চলমান অবকাঠামোগত উন্নয়ন ধারা অব্যাহত রাখা অপরিহার্য।” 

“এই আইন করে আমরা অনিয়ম-দুর্নীতির বৈধতা দিচ্ছি,” মন্তব্য করে বিএনপির সাংসদ হারুনুর রশীদ বলেন, “বিশেষ বিধান কেন ১৬ বছর ধরে চলবে। বিশেষ বিধান সাময়িক সময়ের জন্য করলেন। আজকে কেন আবার পাঁচ বছর? বিশেষ বিধান এভাবে বছরের পর বছর চলতে পারে না।”

গণ ফোরামের সাংসদ মোকাব্বির খান বলেন, “জনগণের টাকা অন্যের হাতে তুলে দেওয়ার জন্য এই আইন করা হয়েছে।”

জাতীয় পার্টির সাংসদ মুজিবুল হক চুন্নু বলেন, “এলাকায় চার-পাঁচ ঘণ্টাও বিদ্যুৎ থাকে না। জোরে বৃষ্টি হলে বিদ্যুৎ যায়। বাতাস হলে বিদ্যুৎ যায়। আমাদের বাঁচান। আইনের এক্সটেনশন দরকার নেই। বিদ্যুৎ দেন।”

তিনি বলেন, “আপনারা বলছেন ২৫ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন হয়। অর্ধেক ব্যবহার হয়। সঞ্চালন লাইন নেই। পায়রার কয়লাভিত্তিক কেন্দ্রের বিদ্যুৎ কিনতে পারছেন না সঞ্চালন লাইন নেই বলে। ওইগুলো কেনেন। প্রকল্প বসে আছে।”

“কিছু লোকের জন্য এই আইনের দরকার নেই। সঞ্চালন লাইন করেন,” বলেন মুজিবুল হক চুন্নু।

“মন্ত্রী নিজেই স্বীকার করেছেন দেশে বিদ্যুতের ঘাটতি রয়েছে,” মন্তব্য করে বিএনপির রুমিন ফারহানা বলেন, “এই আইনে কিছু মানুষের দায়মুক্তি দেওয়া হয়েছে। জনগণের টাকা কিছু মানুষের হাতে টাকা তুলে দেওয়া হবে, কিন্তু তা নিয়ে কথা বলা যাবে না। বড়ো বড়ো কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলো পরিকল্পিতভাবে অচল করা করে রাখা হচ্ছে।” 

কেন এই আইন?

২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকার গঠনের পর দেশের দৈনিক বিদ্যুৎ উৎপাদন প্রায় চার হাজার মেগাওয়াট ছিল বলে জানিয়েছে বিদ্যুৎ বিভাগ। বিদ্যুতের অভাবে কলকারখানা বন্ধ রাখা হতো ঘণ্টার পর ঘণ্টা।

একইসাথে সারাদেশে বাসাবাড়িতে বিদ্যুৎ বিভ্রাটের ফলে জনজীবন প্রায় স্থবির হয়ে পড়ে। এই প্রেক্ষাপটে দেশে বিদ্যুৎ সরবরাহ দ্রুত বৃদ্ধির জন্য বেসরকারি খাতকে যুক্ত করে স্থানান্তরযোগ্য রেন্টাল পাওয়ার প্ল্যান্ট থেকে বিদ্যুৎ কেনে সরকার।

এই বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো গ্যাস, ডিজেল ও ফার্নেসঅয়েল পুড়িয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন করে এবং সরকার তাদের কাছ থেকে তুলনামূলক বেশি দামে বিদ্যুৎ কিনে নেয়। 

বেসরকারি খাতকে রক্ষা করতে ২০১০ সালে দুই বছরের জন্য “বিদ্যুৎ ও জ্বালানির দ্রুত সরবরাহ বৃদ্ধি (বিশেষ বিধান) আইন” পাশ করে সরকার। এই আইনে বলা হয়, এর অধীন সরকারি সিদ্ধান্তকে কোনো আদালতে চ্যালেঞ্জ করা যাবে না। তবে সেই আইন আর বাতিল হয়নি।  

‘নিয়মনীতি মেনেও কাজ করা যায়’

তেল-গ্যাস-খনিজ সম্পদ ও বিদ্যুৎ-বন্দর রক্ষা জাতীয় কমিটির সদস্যসচিব অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ বেনারকে বলেন, “এই আইন একটি দায়মুক্তিমূলক আইন। এই আইনের আওতায় দেশের বিদ্যুৎ খাতে সরকারের কোনো সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে আদালতে যাওয়া যাবে না।”

তিনি বলেন, “এই অস্বচ্ছ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে সরকার স্বচ্ছতা নিশ্চিত করার পরিবর্তে অস্বচ্ছতাকে উৎসাহিত করছে; দুর্নীতিকে উৎসাহিত করছে।”

২০১০ সালে যখন এই আইন প্রথমবারের মতো পাশ করা হয় তখনও তাঁরা এই আইনের বিরোধিতা করেছিলেন জানিয়ে আনু মুহাম্মদ বলেন, “কিছু সরকারি দলের লোকজন এবং তাদের সমর্থিত ব্যবসায়ীদের সুবিধা দিতেই নিয়ম করে এই আইনের মেয়াদ বৃদ্ধি করা হচ্ছে।”

“এই আইনের অধীনে সম্পাদিত চুক্তি অনুযায়ী বেসরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো বিদ্যুৎ উৎপাদন না করলেও তাদের ক্যাপাসিটি চার্জ দিতে হয়। সরকার এভাবে বেসরকারি কোম্পানিগুলোকে নয় হাজার কোটি টাকা পরিশোধ করে। এই বিপুল খরচের বোঝা আসে জনগণের মাথায়,” বলেন তিনি।

দেশের প্রচলিত আইনকানুন মেনেই বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো পরিচালনা করা যায় বলে মনে করেন অধ্যাপক আনু মোহাম্মদ। 

‘দরকার আছে এই আইন’

বাংলাদেশে বর্তমানে ১৪৩টি বিদ্যুৎকেন্দ্র রয়েছে, এর মধ্যে ৮৮টি বেসরকারি কেন্দ্র জানিয়ে বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের জনসংযোগ পরিচালক সাইফুল হাসান চৌধুরী বেনারকে বলেন, বর্তমানে সরবরাহ করা বিদ্যুতের মধ্যে শতকরা ৪৩ ভাগ আসে বেসরকারি খাত থেকে, বাকি ৫৭ ভাগ আসে সরকারি বিদ্যুৎ উৎপাদনকেন্দ্র থেকে। 

বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ে আওতাধীন পরিকল্পনা ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান পাওয়ার সেলের মহাপরিচালক মোহাম্মদ হোসাইনের মতে, “সবাইকে মানসম্মত নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহ করতে এই আইনের দরকার আছে।”

“আমাদের সরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো গ্যাস ভিত্তিক। দেশের গ্যাস মজুদ কমে আসছে। গ্যাস দিয়ে সরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে আমরা ১১ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে পারতাম। এখন এই সক্ষমতা ছয় হাজার মেগাওয়াটে নেমেছে,” বেনারকে বলেন তিনি।

তিনি বলেন, “এই আইন না থাকলে আমরা পুরো বিদ্যুৎ খাতের কোনো অবকাঠামো নির্মাণ করতে পারতাম না, বিদ্যুৎ সরবরাহ বৃদ্ধি করতে পারতাম না। আইনি প্রক্রিয়ায় জটিলতা সৃষ্টি হতে পারত।” 

বেসরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্রের মালিকদের সংগঠন বিপ্পার সভাপতি ইমরান করিম বেনারকে বলেন, “সরকারিভাবে বলা হচ্ছে বাংলাদেশের বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতা ২৫ হাজার মেগাওয়াটের বেশি। এর মধ্যে কিন্তু স্বাধীনতার আগের বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোও রয়েছে, যেগুলোর অনেকগুলোকে বাতিল করতে হবে।”

তিনি বলেন, “আবার এই ২৫ হাজার মেগাওয়াট সক্ষমতার মধ্যে বেসরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্রের অবদান কমপক্ষে ১৬ হাজার মেগাওয়াট। সুতরাং, বেসরকারি বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলো দরকার আছে।”

“এই আইনের মেয়াদ বৃদ্ধির আরেকটি কারণ হতে পারে যে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে অবকাঠামো বেসরকারি খাতে ছেড়ে দিতে পারে বলে আমরা জেনেছি। সুতরাং, এই আইন এই খাতের উন্নয়নে অবদান রাখবে,” বলেন ইমরান করিম।

বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের তালিকা অনুযায়ী, বেসরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্রের মালিকদের মধ্যে রয়েছে সামিট গ্রুপ, ওরিয়ন গ্রুপ, এসআলম গ্রুপ, ইউনাইটেড গ্রুপসহ প্রভাবশালী কয়েকটি ব্যবসায়ী গ্রুপ। এ ছাড়া একাধিক সাবেক ও বর্তমান সাংসদ এবং সরকার দলীয় নেতারা আছেন এসব কেন্দ্রের মালিকানায়।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।