কয়লাভিত্তিক মাতারবাড়ি বিদ্যুৎকেন্দ্রের দ্বিতীয় ধাপে অর্থায়ন করবে না জাপান

আহম্মদ ফয়েজ
2022.06.24
ঢাকা
কয়লাভিত্তিক মাতারবাড়ি বিদ্যুৎকেন্দ্রের দ্বিতীয় ধাপে অর্থায়ন করবে না জাপান কক্সবাজারে নির্মাণাধীন মাতারবাড়ি বিদ্যুৎ প্রকল্প। ১২ ডিসেম্বর ২০২১।
[সৌজন্যে: বিদ্যুৎ বিভাগ]

জাপানের অর্থায়নে নির্মিতব্য মহেশখালীর মাতারবাড়ি দ্বিতীয় কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রে অর্থায়ন থেকে সরে যাওয়ার ঘোষণা দিয়েছে জাপান সরকার।

বুধবার এক সংবাদ সম্মেলনে জাপানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র হিকো উনো কয়লা বিদ্যুৎ প্রকল্পে সরকারি উন্নয়ন সহায়তা স্থগিতের ঘোষণা দেন বলে জানায় জাপানী গণমাধ্যমগুলো।

হিকো উনো জানান, বাংলাদেশ ও ইন্দোনেশিয়ার দুটি প্রকল্প বাতিলের সিদ্ধান্ত নিয়েছে তাঁর সরকার। এর একটি হচ্ছে মাতারবাড়ি আলট্রা সুপার ক্রিটিক্যাল কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র (১ হাজার ২০০ মেগাওয়াট দ্বিতীয় পর্যায়)।

জাপানের প্রভাবশালী দৈনিক নিকেই বলছে, কার্বন নিঃসরণ কমাতে কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্রে অর্থায়ন থেকে সরে এসেছে জাপান সরকার।

মাতারবাড়ি বিদ্যুৎকেন্দ্রে অর্থায়ন বাতিলের সিদ্ধান্ত সম্পর্কে ঢাকায় জাপানের রাষ্ট্রদূত ইতো নাওকি বেনারকে বলেন, কার্বন নিঃসরণ কমাতে এবং জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলার অংশ হিসেবে জাপান ইন্টারন্যাশনাল কো-অপারেশন এজেন্সি (জাইকা) এই উদ্যোগ গ্রহণ করেছে।

“জাইকা মাতারবাড়ি কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের প্রথমটির কাজ শেষ করবে। তবে কার্বন নিঃসরণ কমাতে এবং জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলার অংশ হিসেবে দ্বিতীয়টিতে না থাকার সিদ্ধান্ত নিয়েছে,” বলেন ইতো।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে বিদ্যুৎ বিভাগের সচিব মো: হাবিবুর রহমান বেনারকে বলেন, “অর্থায়ন বন্ধে জাপান একটি সিদ্ধান্ত নিয়েছে বলে আমরা শুনেছি। তবে আনুষ্ঠানিকভাবে এখনো কিছু জানতে পারিনি।”

তিনি বলেন, এখন আমাদের সামনে দুটি করণীয় রয়েছে। একটি হচ্ছে বিকল্প অর্থায়নের চেষ্টা করা এবং অপরটি হচ্ছে কয়লাভিত্তিক না করে অন্য উপায়ে করা যায় কিনা, সেই বিষয়টি বিবেচনা করা।

আনুষ্ঠানিকভাবে তথ্য পেলে আলাপ-আলোচনার ভিত্তিতে সরকার প্রয়োজনীয় সিদ্ধান্ত নেবে বলে জানান তিনি।

জাপানের সিদ্ধান্ত প্রশংসনীয়’

বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন কোল পাওয়ার জেনারেশন কোম্পানি বাংলাদেশ লিমিটেডের (সিপিজিসিবিএল) তথ্যমতে, মাতারবাড়ি এলাকায় ১ হাজার ২০০ মেগাওয়াট ক্ষমতার দুটি কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের পরিকল্পনা নেয় সরকার। দুটি কেন্দ্রের জন্য ১ হাজার ৪০০ একর জমিও অধিগ্রহণ করা হয়। প্রথম কেন্দ্রের কাজ চলছে।

বিদ্যুৎ ও জ্বালানী মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, জাপানের সুমিতোমো কর্পোরেশন, তোশিবা কর্পোরেশন ও আইএইচআই কর্পোরেশন এর কনসোর্টিয়ামকে মাতারবাড়ি ছয়শ মেগাওয়াট করে এক হাজার দুইশ মেগাওয়াট আল্ট্রাসুপার ক্রিটিক্যাল কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ প্রকল্পের ইপিসি ঠিকাদার হিসেবে নিয়োগ করা হয়েছে।

গত ২২ আগস্ট ২০১৭ ইঞ্জিনিয়ারিং, প্রকিউরমেন্ট এবং কনস্ট্রাকশনের (ইপিসি) ঠিকাদারেরা বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ প্রকল্পের কাজ শুরু করেছে।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০১৮ সালের জানুয়ারিতে মাতারবাড়ি কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ প্রকল্পের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেছেন।

গত বছরের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত ভৌত অগ্রগতি ৫৫ দশমিক ২০ শতাংশ এবং পোর্ট ও পাওয়ার প্ল্যান্ট কাজের ভৌত অগ্রগতি ৬৫ দশমিক ৯৬ শতাংশ।

তিন মাস আগে মাতারবাড়ি কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র প্রকল্পের প্রথম ধাপ বাস্তবায়নকারী তিনটি ইপিসি ঠিকাদারদের মধ্যে সুমিতোমো কর্পোরেশন দ্বিতীয় ধাপে আর সম্পৃক্ত থাকবে না বলে ঘোষণা দেয়।

সুমিতোমো ঘোষণার পর মাতারবাড়ি বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণকারী সরকারি মালিকানাধীন কোম্পানি কোল পাওয়ার জেনারেশন কোম্পানি বাংলাদেশ লিমিটেডের নির্বাহী পরিচালক আবুল কালাম আজাদ গণমাধ্যমকে  বলেন, প্রকল্পের দ্বিতীয় পর্যায়ের পরিবেশগত প্রভাব মূল্যায়ন সরকারের অনুমোদনের অপেক্ষায় রয়েছে।

দেশ-বিদেশের পরিবেশ বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, মাতারবাড়ি কয়লা বিদ্যুৎ প্রকল্পের দ্বিতীয় পর্যায়ের পরিবেশগত প্রভাব মূল্যায়নের বিষয়টি গ্রহণযোগ্য নয়।  সংবেদনশীল উপকূলীয় এলাকায় পরিবেশগত ও জনস্বাস্থ্য সংক্রান্ত উদ্বেগগুলোকে সমাধান করতে ব্যর্থ হয়েছে ওই মূল্যায়ন।

সিপিজিসিবিএল-এর তথ্যমতে, এই প্রকল্পের প্রাক্কলিত ব্যয় ধরা হয়েছে ৫১ হাজার ৮৫৪ কোটি টাকা। প্রকল্পের মোট অর্থায়নের ৪৩ হাজার ৯২১ কোটি টাকা প্রকল্প সাহায্য হিসেবে জাইকা থেকে এবং অবশিষ্ট ৭ হাজার ৯৩৩ কোটি টাকা বাংলাদেশ সরকার ও সিপিজিসিবিএল এর নিজস্ব তহবিল থেকে সংস্থান করা হবে।

মাতারবাড়ি কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র প্রকল্পের জন্য সরকার ইতিমধ্যে ১,৬০৮ একর জমি অধিগ্রহণ করেছে, যার মধ্যে ১২০০ মেগাওয়াটের আরও দুটি ইউনিট নির্মাণে দ্বিতীয় পর্যায়ের নির্মাণকাজ রয়েছে।

বাংলাদেশ ওয়ার্কিং গ্রুপ অন এক্সটার্নাল ডেবট (বিডব্লিউজিইডি) এর একটি  সমীক্ষা অনুযায়ী, এই প্রকল্পের কার্যক্রম ইতিমধ্যে ৫০ হাজারেরও বেশি মানুষকে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে।

বাংলাদেশ ইতিমধ্যেই প্রয়োজনের তুলনায় অনেক বেশি বিদ্যুৎ উৎপাদন করেছে দাবি করে দেশি-বিদেশি পরিবেশকর্মীরা দীর্ঘদিন ধরে মাতারবাড়ি প্রকল্প বাতিলের দাবি জানিয়ে আসছেন।

কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের অর্থায়ন থেকে সরে আসায় জাপান সরকারকে স্বাগত জানিয়ে বিডব্লিউজিইডি সদস্য সচিব হাসান মেহেদী বেনারকে বলেন, “জাপানের এই সিদ্ধান্ত প্রশংসনীয়। নিশ্চয়ই পরিবেশ এবং প্রতিবেশ রক্ষায় বাংলাদেশসহ অন্যান্য দেশ জাপানকে অনুকরণ করবে।”

আরো কমপক্ষে তিনটি কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র চলমান রয়েছে জানিয়ে হাসান বলেন, মাতারবাড়ি বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের জন্য ইতোমধ্যে অধিগ্রহণকৃত জমিতে ‘কমিউনিটি লিড রিনিউয়েবল’ বিদ্যুৎকেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করা যেতে পারে।

বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতির (বেলা) প্রধান নির্বাহী সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বেনারকে বলেন, জাইকার এই সিদ্ধান্ত প্রমাণ করে জাপান সরকার তার জনগণের কথা শোনে।

“আফসোসের বিষয়, বাংলাদেশে তা হয় না। যদিও আমরা জাপানের জনগণ এবং সরকারকে আমাদের পাশে দাঁড়ানোর জন্য এবং আমাদের বৈধ দাবি মেনে নেওয়ার জন্য অভিনন্দন জানাই। আমরা বিশ্বাস করি যে বাংলাদেশ সরকারও একই পথ অনুসরণ করবে এবং মাতারবাড়ি পাওয়ার প্লান্টের প্রথম পর্যায়টি পরিত্যাগ করবে যা ইতিমধ্যে স্থানীয় ইকো সিস্টেমের জন্য ধ্বংসাত্মক প্রমাণিত হয়েছে,” বলেন এই পরিবেশকর্মী।

ফিনল্যান্ড ভিত্তিক গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর রিসার্চ অন এনার্জি অ্যান্ড ক্লিন এয়ার-এর ২০১৯ সালে প্রকাশিত একটি সমীক্ষা বলছে, মাতারবাড়ি কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রটি খুব কাছাকাছি দূরত্বে পরিকল্পনা করা আটটি কয়লাভিত্তিক কেন্দ্রের একটি, যা আগামী ৩০ বছরে ১৪ হাজার কর্মক্ষম মানুষের দূষণজনিত মৃত্যুর কারণ হতে পারে।

আন্তর্জাতিক চাপ এবং কয়লা বিদ্যুৎ সম্প্রসারণের জন্য তহবিল না পাওয়ায় গত বছর বাংলাদেশ ১০টি কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদন প্রকল্প বাতিল করেছে।

গত বছরের জুনে ইংল্যান্ডের কর্নওয়ালে অনুষ্ঠিত জি-৭ সম্মেলনে কার্বন নিঃসরণ কমাতে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে সরে আসার বিষয়ে একমত হয় জাপান, কানাডা, ফ্রান্স, জার্মানি, ইতালি, যুক্তরাজ্য এবং যুক্তরাষ্ট্র।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।

মন্তব্য

মোঃ ফখরুল ইসলাম।
2022-07-09 15:05

বেশ ভালো কথা। কিন্তু এই জাপান ই তো আকিজ বিড়ির মালিকানা ক্রয় করে নতুন ভাবে তামাকজাত পণ্য তৈরী করে বাংলাদেশের কোটি কোটি মানুষকে তিল তিল করে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিছে। কই ইএ বিষয়ে তো জাপান সরকার কোন বাবস্থা নিছে না।