বিদুৎকেন্দ্রের সক্ষমতার পেছনে বছরে খরচ সাড়ে সাত হাজার কোটি টাকা
2023.10.10
ঢাকা
চাহিদার প্রায় দ্বিগুণ উৎপাদন ক্ষমতা তৈরি করতে বেসরকারি বিদুৎকেন্দ্রগুলোর পেছনে ‘ক্যাপাসিটি চার্জ’ ও ভাড়া বাবদ বছরে গড়ে প্রায় সাড়ে সাত হাজার কোটি টাকা খরচ করছে সরকার, অথচ প্রয়োজন মতো উৎপাদন না হওয়ায় বিদ্যুৎ বিভ্রাট বন্ধ হয়নি।
বাংলাদেশে উৎপাদনকেন্দ্রগুলো থেকে বিদুৎ কেনার একমাত্র ক্রেতা সরকার। বেসরকারি কেন্দ্রগুলো থেকে কোনো কারণে বিদুৎ না কিনলেও দেশের ৮২টি ইনডিপেনডেন্ট পাওয়ার প্রডিউসার (আইপিপি) কেন্দ্রকে সার্বক্ষণিক উৎপাদনের জন্য প্রস্তুত রাখতে সরকার যে ভর্তুকি দেয়, তাই ‘ক্যাপাসিটি চার্জ’ নামে পরিচিত।
অন্যদিকে, ৩২টি রেন্টাল পাওয়ার প্ল্যান্টকে উৎপাদন সক্ষম রাখতে ভাড়া দিতে হয়।
বর্তমানে দেশের সর্বোচ্চ দৈনিক বিদুৎ চাহিদা ১৫ হাজার মেগাওয়াট হলেও উৎপাদন সক্ষমতা ২৮ হাজার মেগাওয়াট। বিশ্লেষকদের মতে, বাড়তি এই উৎপাদন ক্ষমতা ধরে রাখতে প্রতি বছর বিদুৎকেন্দ্রগুলোকে দেয়া কোটি কোটি টাকা অপচয়ের পেছনে মূলত দায়ী ভুল পরিকল্পনা।
অন্যদিকে, জ্বালানি সংকটের কারণে দৈনিক চাহিদার চেয়ে কম বিদুৎ উৎপাদন হওয়ায় লোডশেডিং দিয়ে বিদ্যুতের ঘাটতি সামলানো হচ্ছে বলে জানিয়েছেন কর্মকর্তারা।
বর্তমানে দেশের ১৫ হাজার মেগাওয়াট দৈনিক চাহিদার বিপরীতে উৎপাদন “১২ থেকে ১৪ হাজার মেগাওয়াট’” হয় বলে সোমবার বেনারকে জানান বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের জনসংযোগ পরিচালক শামীম হাসান।
বর্তমানে দৈনিক “৫০০ থেকে এক হাজার মেগাওয়াট পর্যন্ত লোডশেডিং করা হচ্ছে” জানিয়ে তিনি বলেন, “লোডশেডিং হয় মূলত ঢাকার বাইরে।”
সক্ষমতা থাকার পরও কেন চাহিদা অনুযায়ী বিদ্যুৎ সরবরাহ করা যাচ্ছে না জানতে চাইলে পাওয়ার সেলের মহাপরিচালক মোহাম্মদ হোসাইন বেনারকে বলেন, “দেশে এখন গ্যাস, কয়লাসহ জ্বালানির সংকট রয়েছে। ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে দাম বেড়ে যাওয়ায় জ্বালানির সরবরাহ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। সে কারণে চাহিদা অনুযায়ী বিদ্যুৎ উৎপাদন এবং সরবরাহ করা যাচ্ছে না।”
১৪ বছরে খরচ এক লাখ কোটি টাকার বেশি
চলতি বছরের ৫ সেপ্টেম্বর সংসদে প্রশ্নোত্তর পর্বে গণফোরামের সংসদ সদস্য মোকাব্বির খানের প্রশ্নের লিখিত জবাবে বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ জানান, ২০০৯ সাল থেকে চলতি বছরের ৩০ জুন পর্যন্ত আওয়ামী লীগ সরকারের তিন মেয়াদে ৮২টির মধ্যে ৭০টি আইপিপি এবং ৩২টি রেন্টাল বিদ্যুৎকেন্দ্রকে ক্যাপাসিটি চার্জ ও ভাড়া মিলিয়ে মোট এক লাখ চার হাজার ৯২৬ কোটি টাকার বেশি পরিশোধ করা হয়েছে।
৭০টি আইপিপিকে ক্যাপাসিটি চার্জ বাবত ৭৬ হাজার কোটি টাকার বেশি এবং ৩২টি রেন্টাল পাওয়ার প্ল্যান্টকে ভাড়া দেয়া হয়েছে সাড়ে ২৮ হাজার কোটি টাকার বেশি দেয়া হয়েছে বলে জানান প্রতিমন্ত্রী।
এই প্রথমবারের মতো ক্যাপাসিটি চার্জ সংক্রান্ত রাষ্ট্রীয় খরচ সম্পর্কে আনুষ্ঠানিক তথ্য জানাল সরকার।
প্রতিমন্ত্রীর হিসাব অনুযায়ী গত ১৪ বছর ক্যাপাসিটি চার্জ ও ভাড়া বাবদ সরকারের বার্ষিক খরচ প্রায় সাড়ে সাত হাজার কোটি টাকা।
বর্তমানে দৈনিক বিদ্যুতের চাহিদা ১৫ হাজার মেগাওয়াট জানিয়ে প্রতিমন্ত্রী জানান, বর্তমানে নবায়নযোগ্য জ্বালানিসহ দেশে মোট বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতা ২৮ হাজার মেগাওয়াট থেকে বেশি, যা ২০০৯ সালে ছিল মাত্র প্রায় পাঁচ হাজার মেগাওয়াটের কাছাকাছি।
বাংলাদেশের দৈনিক বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা ২০৩০ সালে ৪০ হাজার এবং ২০৪১ সালে ৬০ হাজার মেগাওয়াটে উন্নীত করার কার্যক্রম বাস্তবায়ন করা হচ্ছে বলেও জানান তিনি।
‘মাস্টার প্ল্যানে সমস্যা’
বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) অর্থনীতিবিদ ড. গোলাম মোয়াজ্জেমের মতে, দেশের বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা বৃদ্ধির জন্য গত ১৪ বছরে ক্যাপাসিটি চার্জের নামে যত অর্থ ব্যয় করা হয়েছে “সেগুলোর একটি বড়ো অংশ দেশের কাজে লাগেনি এবং লাগবে না।”
তাঁর মতে, “সরকার মনে করেছিল বাংলাদেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি (জিডিপি) যেভাবে বাড়ছে” সেই হিসাবে বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য কোম্পানিগুলোকে “প্রস্তুত রাখতে হবে, যাতে প্রয়োজনের সময় তাদের কাছ থেকে বিদ্যুৎ পাওয়া যায়।”
তিনি বেনারকে বলেন, সেই বিবেচনায় “ঢালাওভাবে” সরকারের পক্ষ থেকে বিদ্যুৎ কোম্পানিগুলোকে বলা হয়েছিল, “তোমরা প্ল্যান্ট রেডি রাখো, আমরা তোমাদের কাছ থেকে বিদ্যুৎ কিনব; না কিনলে তোমাদের ক্যাপাসিটি চার্জ দেবো।”
“প্রকৃতপক্ষে বিদ্যুতের চাহিদা বাড়ছে না। কিন্তু সক্ষমতা বৃদ্ধি অব্যাহত রাখা হলো,” বলেন ড. মোয়াজ্জেম।
তিনি বলেন, বর্তমানে বাংলাদেশের উৎপাদন সক্ষমতার “অর্ধেক আমাদের কাজে লাগছে, বাকি ১৪ হাজার মেগাওয়াটের জন্য আমরা বসিয়ে বসিয়ে ক্যাপাসিটি চার্জ দিয়ে গেলাম।”
কেন বিদ্যুতের চাহিদা বাড়ল না বিষয়টি ব্যাখ্যা করতে গিয়ে তিনি বলেন, “আমাদের বার্ষিক জিডিপি প্রবৃদ্ধি গড়ে সাড়ে ছয় হারে বাড়ছে। সেই বিষয়টি মাথায় রেখে বিদ্যুতের চাহিদা হিসাব করেছে বিদ্যুৎ বিভাগ। বাংলাদেশের ক্ষেত্রেই সরল হিসাব সঠিক নয়। কারণ বাংলাদেশের অর্থনীতি মূলত সেবা খাতের ওপর নির্ভরশীল। জিডিপিতে এই খাতের অবদান প্রায় শতকরা ৫২ ভাগ। আর শিল্পের অবদান ৩৬ ভাগ এবং কৃষি ১৩ ভাগ। অর্থাৎ জিডিপির প্রায় শতকরা ৬৫ শতাংশ অশিল্প খাত।”
ড. মোয়াজ্জেম বলেন, “শিল্প খাতের অবদান বৃদ্ধি ছাড়া বিদ্যুতের চাহিদা বাড়বে না। সেবা খাত এবং কৃষি খাতের মাধ্যমে বিদ্যুতের চাহিদা বাড়বে না। একটি বিউটি পার্লার প্রতিষ্ঠা করলে সেখানে বিদ্যুতের চাহিদা কতটুকু হবে! কৃষি খাতেও চাহিদা খুব কম। যদি একটি কারখানা প্রতিষ্ঠা করা হয়, সেখানে বিদ্যুতের চাহিদা প্রচুর হবে।
“বিদ্যুৎ বিভাগের কাছে এই জাতীয় তথ্য ছিল। তারপরও তারা বিদ্যুৎ উৎপাদনের সক্ষমতা বাড়িয়ে চলেছে। এর কারণ হলো কিছু কোম্পানিকে সুবিধা দেওয়া। আর কিছু নয়,” বলেন তিনি।
বিদ্যুৎ ও জ্বালানি বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক বদরুল ইমামের মতে, “আমাদের বিদ্যুৎ চাহিদার যে হিসাব করা হয়েছে, সেই মাস্টার প্ল্যানেই সমস্যা।”
তিনি বলেন, প্রকৃত চাহিদার চেয়ে উৎপাদন সক্ষমতা “শতকরা ২০ থেকে ২৫ ভাগ বেশি রাখতে হয়। সেটি কোনো ক্রমেই দ্বিগুণ হতে পারে না।”
“এই বাড়তি সক্ষমতার জন্য আমাদের টাকা দিতে হচ্ছে কিন্তু আমরা বিদ্যুৎ বিভ্রাট থেকে বের হতে পারিনি,” বলেন অধ্যাপক বদরুল ইমাম।
কর্মকর্তাদের মতে, উৎপাদন প্রক্ষেপণ ঠিক আছে
বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের সদস্য (উৎপাদন) এস. এম. ওয়াজেদ আলী সরদার বেনারকে বলেন, “দেশের অর্থনৈতিক অগ্রগতি, জিডিপি, মাথাপিছু বিদ্যুতের চাহিদা কতটুকু বাড়তে পারে এসব বিষয়গুলো মাথায় রেখেই বিদ্যুৎ উৎপাদনের সক্ষমতা নির্ধারণ করা হয়।”
প্রকৃত চাহিদার চেয়ে উৎপাদন সক্ষমতা দ্বিগুণ করা হয়েছে—দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে তিনি বলেন, “কেন্দ্রগুলোও সব সময় সবগুলো উৎপাদনে থাকে না। রক্ষণাবেক্ষণের জন্য বসিয়ে রাখা হয়। সে জন্যই সক্ষমতা বেশি রাখা হয়, যাতে প্রয়োজন হলে বিকল্প সংস্থান থেকে বিদ্যুৎ পাওয়া যায়।”
পাওয়ার সেলের মহাপরিচালক মোহাম্মদ হোসাইনের মতে, “আমাদের বিদ্যুৎ উৎপাদন প্রক্ষেপণ ঠিক আছে।”