রোজার আগে দাম বাড়ল ভোগ্যপণ্যের, বিক্রেতারা বলছেন ‘কিছু করার নেই’
2024.03.08
ঢাকা
প্রতিবছরের মতো এবারও রোজা শুরুর এক সপ্তাহ আগে থেকেই বাড়তে শুরু করেছে ভোগ্যপণ্যের দাম।
ব্যবসায়ীদের তথ্যমতে, খেজুরসহ বিভিন্ন ধরনের ফল, ছোলা, গরু ও মুরগির মাংস এবং নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম বেড়েছে শতকরা পাঁচ থেকে ১০ শতাংশ।
রোজার কারণেই এই দাম বেড়েছে বলে জানিয়েছেন রাজধানীর কারওয়ান বাজারের পাইকারি ব্যবসায়ী ও বিভিন্ন খুচরা দোকানিরা।
বৃহস্পতিবার বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অধীন ট্রেডিং কর্পোরেশন অব বাংলাদেশ (টিসিবি) এর পণ্য বিক্রির অনুষ্ঠানে বাণিজ্য প্রতিমন্ত্রী আহসানুল ইসলাম টিটু বলেন, টিসিবির পণ্য বিক্রির কারণে বাজারে চাহিদা কমবে, ফলে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যে দাম বাড়বে না। তিনি আরও বলেন, চিনির পর্যাপ্ত মজুত থাকায় সংকট হবে না এবং চিনির দাম এক টাকাও বাড়বে না।
কেউ পণ্য মজুত করে দাম বাড়ানোর চেষ্টা করলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলেও হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেন তিনি।
তবে এই হুঁশিয়ারি কোনো কাজে আসেনি! জ্বালানি তেলের দাম কমলেও বাজারে এর প্রভাব পড়েনি।
ক্রেতাদের ভাষ্য, অসাধু ব্যবসায়ীদের কারণে বাজারে পণ্যের দাম বেশি। তবে ব্যবসায়ীরা বলছেন, ডলারের মূল্য বৃদ্ধির কারণে আমদানি খরচ বেড়েছে—সেই কারণে দামও বেড়েছে।
চাঁদ দেখা সাপেক্ষে আগামী ১১ মার্চ সোমবার থেকে বাংলাদেশে রোজা শুরু হতে পারে।
বিক্রেতাদের ‘কিছু করার নেই’
রাজধানীর মিরপুর ১২ নম্বর সেকশন এলাকার মুরগি বিক্রেতা রফিক বেনারকে বলেন, “রোজার কারণে দাম বেড়ে বর্তমানে মুরগি প্রতি কেজি ২৬০ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে। কয়েক দিন আগে দাম ছিল ২৩০ টাকা। ব্রয়লার মুরগির কেজি ছিল ২১০ টাকা, এখন বেড়ে ২৩০ টাকা হয়েছে।”
তিনি বলেন, রোজার প্রথম ১০ দিন বিক্রি বেশি হয়। পরের ১০ দিন বিক্রি কম থাকে, এরপর আবার বাড়ে।
“রোজার শেষের দিকে ঈদের কারণে আরেক দফা দাম বাড়ে,” বলেও জানান রফিক।
ছোলার দাম কয়েকদিন আগে কেজিপ্রতি ১০০ টাকা থাকলেও বর্তমানে তা বেড়ে ১১০ টাকা হয়েছে বলে শুক্রবার বেনারকে জানান পল্লবী এলাকার খুচরা ব্যবসায়ী আলম।
একইভাবে প্রতি কেজি মুগ ডাল ১২০ টাকা থেকে বেড়ে ১৮৫ টাকা, প্রতি কেজি কিসমিস প্রায় ২০০ টাকা বেড়ে ৮০০ টাকা হয়েছে বলে জানান তিনি।
এ বছর এখন পর্যন্ত ছোলা, তেল ও চিনির দাম “তেমন না বাড়লেও খেজুরসহ বিভিন্ন ফলের দাম বেড়েছে,” বলে বেনারকে জানান মিরপুর সাড়ে এগারো এলাকার ব্যবসায়ী সুবল সাহা।
রোজায় ভোক্তাদের অনেকেই ভাজাপোড়া কম খেয়ে ফল খান বলে এর চাহিদার সাথে দামও বাড়ে বলে জানান সুবল।
তিনি বলেন, “মরিয়ম খেজুরের দাম কেজিতে প্রায় ২০০ টাকা বেড়ে এক হাজার টাকায় বিক্রি হচ্ছে। মালটা প্রতি কেজি ৩৩০ টাকা বিক্রি হচ্ছে, আগে ছিল ২৮০ টাকা।”
মালটার দাম বাড়ার কারণ হিসেবে তিনি বলেন, পাইকারি বাজারে আগে “এক কার্টন মাল্টার দাম দুই হাজার ৮০০ টাকা ছিল, এখন হয়েছে চার হাজার ২০০ টাকা।”
কারওয়ান বাজারের খুচরা ব্যবসায়ী নুরুন্নবী ইসলাম রুবেল বেনারকে বলেন, “আমরা প্রতিদিনের চাহিদা মাথায় রেখে ডিলারদের কাছ থেকে ৫০-৬০ কেজি মাল কিনে আনি, ডিলাররা আনেন আমদানিকারকদের কাছ থেকে। ডিলাররা আমাদের কাছে যে দর নেয়, তার চেয়ে কিছুটা লাভ রেখে আমরা বিক্রি করি।”
“ডিলার ও আমদানিকারকরা যে দাম নির্ধারণ করেন বাজার সেভাবেই চলে, আমাদের কিছু করার নেই,” বলেন নুরুন্নবী।
সমস্যা সময়মতো সরবরাহ নিশ্চিত করতে পারে না
কনজুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের সাধারণ সম্পাদক হুমায়ূন কবির ভূঁইয়া শুক্রবার বেনারকে বলেন, রোজা আসার আগেই প্রতিবছরের মতো নিত্যপণ্যের দাম বাড়তে শুরু করেছে। মধ্যপ্রাচ্যের অনেক দেশে পণ্যের দাম রোজা উপলক্ষে কমিয়েছে; বাংলাদেশে বিপরীত চিত্র।
তিনি বলেন, “অনেক মানুষ শুধু রোজায় ইফতারে খেজুর খান। সে কারণে খেজুরের চাহিদা বাড়ে। এই সুযোগে খেজুরের দাম প্রতি কেজিতে কমপক্ষে ৪০০ টাকা বেড়েছে। ছোলা, বেগুন, ডাল, মুরগিসহ সব কিছুর দামই বৃদ্ধি পেতে শুরু করেছে।”
দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির কারণ হিসেবে হুমায়ূন মনে করেন, “মূল সমস্যা হলো বাংলাদেশে শাক-সবজি থেকে শুরু করে চাল, ডাল, আটা সব কিছুর দাম নির্ধারণ করে থাকে সাত থেকে আট জন ব্যক্তি অথবা প্রতিষ্ঠান।”
“সরকার এদের কাছে জিম্মি, এদের সঙ্গে পারে না,” মন্তব্য করে তিনি বলেন, “সরকারের দিক থেকে প্রধান ব্যর্থতা হলো, বাজারে প্রয়োজন অনুযায়ী সঠিক সময়ে পর্যাপ্ত সরবরাহ নিশ্চিত করতে পারে না। কোনো ব্যবসায়ী মজুদ করছে কি না সেটি মনিটর করতে পারে না সরকারি সংস্থাগুলো।”
হুমায়ূন বলেন, “ভোক্তা অধিকার সংস্থা কিছুটা চেষ্টা করলেও তারা অসাধু ব্যবসায়ীদের সঙ্গে পেরে উঠছে না। তারা বলে, ডলারের রেটের কারণে দাম বাড়ছে। ডলারের দাম তো রোজা উপলক্ষে বাড়েনি, তাহলে প্রতি কেজি খেজুরের দাম ৪০০ টাকা বাড়ল কেন?”
“এর কারণ হলো, হাতেগোনা বড়ো বড়ো কিছু প্রতিষ্ঠান এলসি (আমদানি ঋণপত্র) খুলতে পারছে—ছোট ব্যবসায়ীদের এলসি খুলতে দেওয়া হচ্ছে না। ফলে সবাই পণ্য আমদানি করতে পারছে না। পণ্যের বাজার ছয়-সাত জনের হাতে নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে। তারা যেমন দাম নির্ধারণ করছে, সেই দামেই বিক্রি হচ্ছে,” বলেন হুমায়ূন।
সবাইকে এলসি খোলার অনুমতি দেওয়া হলে সমস্যা অনেকাংশে কমে যাবে বলে মনে করেন তিনি। তিনি বলেন, “ব্যবসায়ীদের মধ্যে প্রতিযোগিতা আনতে কমিশন প্রতিষ্ঠা করা হলেও তারা দৃশ্যমান ভূমিকা রাখতে পারছে না।”
ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন ফেডারেশন অব বাংলাদেশ চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির সাবেক সভাপতি মীর নাসির হোসেন শুক্রবার বেনারকে বলেন, প্রতিবছর রোজায় পণ্যমূল্য বৃদ্ধি পাওয়ার অন্যতম কারণ হলো, দেশের সরবরাহ চেইন রক্ষা করা যায় না।
তিনি বলেন, “বাংলাদেশ বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ ভোগ্যপণ্যের আমদানিকারক দেশ। আমাদের পেঁয়াজ থেকে শুরু করে বিভিন্ন প্রকারের ডাল, আদা-রসুন, ফল আমদানি করতে হয়। আমাদের দেশের ব্যবসায়ীদের মধ্যে সবাই ভালো না। যারা ভালো না, তারাই দাম বৃদ্ধিতে ভূমিকা রাখে। আরেকটি অন্যতম কারণ হলো, ব্যবসার বড়ো অংশ হয় রোজা ও ঈদের মধ্যে। সারা বছরের ব্যবসা এই সময়ে।”
তিনি বলেন, “সংযুক্ত আরব আমিরাতে ও সৌদি আরবে রোজায় দাম কমানো হয়। পশ্চিমা দেশগুলোতে ক্রিসমাসের সময় দাম কমানো হয়, বিভিন্ন অফার দেওয়া হয় কিন্তু আমাদের সংস্কৃতিতে এগুলো নেই।”
মীর নাসির হোসেন বলেন, “এগুলো নিয়ে ভাবার সময় এসেছে। এগুলোর পরিবর্তন দরকার। এছাড়া, সরকারি মনিটরিং দরকার।”