ঈদের পর ফের বেড়েছে পণ্যমূল্য, চাপে স্বল্প আয়ের মানুষ

রিয়াদ হোসেন
2023.05.12
ঢাকা
ঈদের পর ফের বেড়েছে পণ্যমূল্য, চাপে স্বল্প আয়ের মানুষ ঢাকায় সরকার পরিচালিত কম মূল্যের ভ্রাম্যমাণ বিক্রয়কেন্দ্র থেকে পণ্য কিনতে ক্রেতাদের ভিড়। ১৭ নভেম্বর ২০২২।
[এএফপি]

রমজান মাসে কিছু পণ্যের দাম সামান্য কমলেও ঈদের পরে আবারও বেড়েছে অধিকাংশ নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্যের মূল্য।

সরকারি প্রতিষ্ঠান ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) হিসাব অনুযায়ী, চিনি, ভোজ্য তেল, পেঁয়াজ, আলুসহ বেশ কিছু পণ্যের দাম গত এক মাসের ব্যবধানে বেড়েছে ছয় থেকে ৫৫ শতাংশ পর্যন্ত।

রাজধানী ঢাকার একাধিক বাজার ঘুরে দেখা গেছে, কোনো কোনো সবজির দাম গত এক মাসের ব্যবধানের প্রায় দ্বিগুণ বেড়েছে। ফলে নতুন করে চাপে পড়েছেন সাধারণ ভোক্তা শ্রেণি ও অপেক্ষাকৃত স্বল্প আয়ের মানুষ।

মিরপুর সংলগ্ন ইব্রাহিমপুর এলাকার বাসিন্দা মোহাম্মদ রবি আলম পেশায় গাড়িচালক। সার্বিক খরচ বেড়ে যাওয়ায় সম্প্রতি শিশু সন্তান ও স্ত্রীকে ভোলায় গ্রামের বাড়ি পাঠিয়ে দিয়েছেন তিনি।

“জিনিসপত্রের দাম এত বেড়েছে যে, এখন পরিবারসহ ঢাকায় থাকা সম্ভব হচ্ছে না। এজন্য তাদের বাড়িতে পাঠিয়ে দিয়ে নিজে মেসে থাকছি। সেখানেও খরচ বেড়েছে,” বেনারকে বলেন রবি।

এই গাড়িচালকের মাসিক আয় ১৯ হাজার টাকা। তিনি বলেন, “মাসে ৫০ হাজার টাকার নিচে আয় হলে এখন ঢাকায় পরিবার নিয়ে থাকা সম্ভব নয়।”

রাজধানীর একাধিক বাজার ঘুরে বিক্রি কমে যাওয়ার তথ্যও পাওয়া গেছে। ইব্রাহিমপুর বাজারের সবজি বিক্রেতা মো. সাকিব বেনারকে বলেন, “বিক্রি কমে গেছে। যার এক কেজি দরকার, তিনি আধা কেজি কিনছেন।”

বাজারে পণ্যমূল্যের বাড়তি দামের বিষয়টি স্বীকার করে শিল্প প্রতিমন্ত্রী কামাল আহমেদ মজুমদার বৃহস্পতিবার রাজধানীর পল্টনে এক অনুষ্ঠানে বলেন, “আমি অনেককে দেখেছি বাজার করতে গিয়ে কাঁদছে। কারণ বাজারের যে অবস্থা, তার পকেটে সে টাকা নেই। এটার একমাত্র কারণ সিন্ডিকেট।'

টিসিবি’র তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, চিনির কেজি এক মাসে ১১৫ টাকা থেকে বেড়ে হয়েছে ১৪০ টাকা। সয়াবিন তেলের লিটার ১৭৫ থেকে বেড়ে হয়েছে ১৮৫ টাকা।

এছাড়াও গত এক মাসের ব্যবধানে আলুর দাম কেজিপ্রতি ৩০ টাকা থেকে বেড়ে ৪০ টাকা, পেঁয়াজের দাম ৪৫ টাকা থেকে বেড়ে ৭০ টাকা, রসুনের দাম ১৪০ টাকা থেকে বেড়ে ১৬০ টাকা এবং আদার দাম ২৬০ টাকা থেকে বেড়ে ৩৬০ টাকা হয়েছে।  

ঢাকার কারওয়ানবাজারে ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, এক মাসে মুরগির মাংসের দাম ৪১ শতাংশ (১৭০ টাকা থেকে ২৪০ টাকা) বেড়েছে।

প্রতিবেশী ভারতের তুলনায় বাংলাদেশে এসব পণ্যের দাম দ্বিগুণেরও বেশি। চিনিমান্ডি ডটকম নামে ভারতের একটি ওয়েবসাইটে বিভিন্ন রাজ্যের চিনির সর্বোচ্চ খুচরা মূল্য পর্যালোচনায় দেখা যায়, কলকাতায় সবচেয়ে বেশি দাম শূন্য দশমিক ৫৫ ডলারে বিক্রি হচ্ছে প্রতি কেজি চিনি। যেখানে বাংলাদেশে বিক্রি হচ্ছে প্রায় এক দশমিক ৪০ ডলারে।

যেসব কারণ দায়ী

গত বছরের ফেব্রুয়ারিতে ইউক্রেনে রাশিয়ার হামলার পর সাপ্লাই চেইনে বিঘ্ন ঘটে। বাড়তে থাকে বিভিন্ন পণ্যের দাম। এর মধ্যেই মার্কিন ডলারের বিপরীতে দর হারাতে থাকে স্থানীয় মুদ্রা টাকা।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, গত বছরের মার্চের পর থেকে এ পর্যন্ত ডলারের বিপরীতে টাকার মান কমেছে প্রায় ২৮ শতাংশ। ফলে আমদানিকৃত পণ্যে বাড়তি টাকা গুনতে হচ্ছে, যার ভার যাচ্ছে ভোক্তার ওপর। আবার জ্বালানি তেল, বিদ্যুৎ ও গ্যাসের দাম বাড়ানোর প্রভাবও পণ্যমূল্যে পড়েছে।

এছাড়া আমদানি ব্যয়ে চাহিদা অনুযায়ী ডলারের যোগান দিতে পারছে না ব্যাংকগুলো। মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ মাহবুবুর রহমান সম্প্রতি বেনারকে তিনি বলেন, “চাহিদা অনুযায়ী ডলারের যোগান দিতে পারছি না। কেউ ১০০ ডলার চাইলে হয়তো ৫০ ডলার দেওয়া হচ্ছে।”

ভোজ্য তেলের দাম নাগালে রাখতে সরকার ভ্যাট কমিয়ে দেয়, যার মেয়াদ গত ৩০ এপ্রিল শেষ হওয়ার পর আর বাড়েনি। এর চার দিনের মাথায় গত ৪ মে সয়াবিন তেলের দাম সাড়ে ছয় শতাংশ বাড়িয়ে প্রায় এক দশমিক ৮৫ ডলার নির্ধারণ করে দেয়। এর এক সপ্তাহের মধ্যেই চিনির দাম ১৫ শতাংশ বাড়িয়ে প্রায় এক দশমিক ১৬ ডলার নির্ধারণ করে। কিন্তু বাজারে বিক্রি হচ্ছে তার চেয়েও অনেক বেশি দামে।

দেশের ভোজ্য তেলের সরবরাহকারী টি কে গ্রুপের সিনিয়র কর্মকর্তা সাইফুল আতাহার তসলিম বেনারকে বলেন, “হ্রাসকৃত ভ্যাটের সুবিধার মেয়াদ না বাড়ানোয় ভোজ্য তেলের দাম বেড়েছে।”

বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি বৃহস্পতিবার এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন, “তেলের মূল্য মূলত বৃদ্ধি পেয়েছে ভ্যাট সুবিধা বাতিল করার কারণে। আমরা মন্ত্রণালয় থেকে এনবিআরকে চিঠি দিয়েছিলাম কিন্তু তারা (এনবিআর) তা করেননি। যার জন্য তেলের মূল্য বেড়েছে।”

চিনির দাম বৃদ্ধির কারণ জানতে দেশের শীর্ষ একটি আমদানিকারক প্রতিষ্ঠানের শীর্ষ পর্যায়ের কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে ক্রমাগত ডলারের দর বৃদ্ধিকে একটি কারণ বলে দাবি করেন।

চিনির আমদানি পর্যায়ে ২৫ শতাংশ নিয়ন্ত্রণমূলক শুল্ক প্রত্যাহার করার সুবিধা আগামী ৩১ মে শেষ হচ্ছে। ওই সুবিধাও আর না বাড়ালে ফের চিনির দাম বাড়তে পারে বলে ব্যবসায়ীদের অনেকে আশঙ্কা করছেন।

এদিকে সরকার নির্ধারিত দামে চিনি বিক্রি হচ্ছে কি না তা আগামী সপ্তাহ থেকে তদারকি করা হবে বলে বৃহস্পতিবার ঘোষণা দিয়েছেন বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি।

এছাড়া পেঁয়াজের দাম বাড়তে থাকলে আমদানি করার উদ্যোগ নেওয়া হবে বলেও জানান তিনি।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।