এক সপ্তায় অবৈধভাবে মজুত ১০ লাখ লিটারের বেশি ভোজ্য তেল জব্দ
2022.05.13
ঢাকা
গত সপ্তায় সরকারিভাবে ভোজ্যতেলের দাম বাড়ানোর পর দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে অবৈধভাবে মজুত করে রাখা ১০ লাখ লিটারেরও বেশি সয়াবিন তেল উদ্ধার করেছে জাতীয় ভোক্তা-অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর ও অন্যান্য অভিযান পরিচালনাকারী সংস্থা।
ঈদের পর তেলের দাম বাড়বে- এমন সম্ভাবনার ভিত্তিতে ব্যবসায়ীরা বিপুল পরিমাণ বোতলজাত ও খোলা সয়াবিন তেল গুদামজাত করে রাখার অভিযোগ তুলে ব্যবসায়ীদের সমালোচনা করেছেন স্বয়ং বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি।
ভোক্তা-অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের তথ্য মতে, গত বৃহস্পতিবারই জব্দকৃত সয়াবিন তেলের পরিমাণ ১০ লাখ লিটার ছাড়িয়েছে এবং শুক্রবারও দেশের বিভিন্ন স্থানে অভিযানে প্রচুর তেল জব্দ করা হয়েছে যার মোট হিসাব তাৎক্ষণিকভাবে পাওয়া যায়নি।
“কিছু অসাধু ব্যবসায়ী অতিরিক্ত মুনাফার লোভে কৃত্রিম সংকট তৈরি করে বাজারে এক ধরনের অচলাবস্থা তৈরি করেছিল,” জানিয়ে ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের পরিচালক মনজুর মোহাম্মদ শাহরিয়ার বেনারকে বলেন, “পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে আমাদের পাশাপাশি আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও মাঠ প্রশাসন অভিযান পরিচালনা করছে।”
তিনি জানানা, তেল জব্দ করার পাশাপাশি অবৈধ মজুতদারদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে। জেল-জরিমানা ও আটককৃত তেল ন্যায্যমূল্যে বিক্রি করারও ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে।
অভিযানে সবচেয়ে বেশি পরিমাণ তেল জব্দ করা হয়েছে রাজশাহী বিভাগ থেকে। এই এলাকায় অভিযান চালিয়ে গত সপ্তাহে প্রায় চার লাখ লিটার তেল মজুদদারদের গোডাউন থেকে উদ্ধার করা হয় বলে অধিদপ্তর সূত্রে জানা যায়।
এ ছাড়াও বিপুল তেল উদ্ধার করা হয়েছে খুলনা, রংপুর, ঢাকা, চট্টগ্রাম, ময়মনসিংহ, বরিশাল ও সিলেট বিভাগের বিভিন্ন জেলা থেকে।
২০১১ সালের ৫ মে জারি করা খাদ্য মন্ত্রণালয়ের গেজেট অনুযায়ী, একজন পাইকারি বিক্রেতা সর্বোচ্চ ৩০ মেট্রিক টন পরিমাণ পাম ও সয়াবিন তেল সর্বোচ্চ ৩০ দিন মজুত রাখতে পারবেন।
আর একজন খুচরা বিক্রেতা সর্বোচ্চ ৫ টন পরিমাণের পাম ও সয়াবিন তেল সর্বোচ্চ ২০ দিন মজুত করতে পারবেন। একইভাবে একজন আমদানিকারকও তাঁর মোট আমদানিকৃত পাম বা সয়াবিন তেলের ২৫ ভাগ সর্বোচ্চ ৬০ দিন পর্যন্ত মজুত রাখতে পারবেন।
আসল হোতাদের ধরতে হবে
বাজার মনিটরিং করতে চলমান অভিযানকে সাধুবাদ জানিয়ে কনজ্যুমার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব) সভাপতি গোলাম রহমান বেনারকে বলেন, “শুধু মাঠ পর্যায়ের ডিলারদের ধরলেই এই পরিস্থিতির সমাধান হবে না। সংকটের মূলে থাকা বড়ো ব্যবসায়ী ও আমদানিকারকদের কঠোর নজরদারির মধ্যে নিয়ে আসতে হবে।”
তবে অভিযানে কোনো সাধারণ ব্যবসায়ী যেন হয়রানির শিকার না হন সেদিকেও খেয়াল রাখতে হবে বলে মন্তব্য করেন তিনি।
সরকারি হস্তক্ষেপ বন্ধের দাবি ব্যবসায়ীদের
এদিকে ভোজ্যতেলের বাজার নিয়ন্ত্রণে সরকারের নেয়া বিভিন্ন পদক্ষেপ বন্ধের দাবি তুলেছে ব্যবসায়ীরা।
বুধবার দেশের ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআইয়ের ডাকা ভোজ্যতেল নিয়ে এক মতবিনিময় সভায় এই দাবি তোলেন তারা।
“বাজার স্থিতিশীল রাখতে হলে প্রথমেই মার্কেটকে মার্কেটের মতো প্লে করতে দিতে হবে। আজকের এই পরিস্থিতির জন্য আমরা মিলমালিক, পাইকার ও খুচরা ব্যবসায়ীরা একে অন্যকে দোষারোপ করছি, এটা মার্কেটের ডিস্ট্রিবিউশন চ্যানেলটাকে নষ্ট করে দেবে। এটা ব্যবসার জন্য অশনি সংকেত,” ওই সভায় বলেন টি কে গ্রুপের পরিচালক আতহার তাসলিম।
মুক্তবাজার অর্থনীতিতে বাজারে হস্তক্ষেপ বন্ধের পক্ষে মত দিয়ে মিল মালিক প্রতিনিধিদের মধ্যে এস আলম গ্রুপের কাজী সালাহ উদ্দিন আহমদ সভায় বলেন, “প্রতি বছর রমজানের আগে সরকার ব্যবসায়ীদের সাথে বৈঠক করে পণ্যের দাম কমানোর নির্দেশনা দেন। এই নির্দেশনার কারণে বাজারে অস্থিরতা তৈরি হয়।”
৮ কোম্পানিকে তলব
বাজার কারসাজির অভিযোগে দেশের ভোজ্যতেল আমদানিকারক বড় আট প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে শুনানি করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকারি সংস্থা বাংলাদেশ প্রতিযোগিতা কমিশন।
নিজস্ব অনুসন্ধানের ভিত্তিতে এই উদ্যোগ নেয়া হয়েছে জানিয়ে কমিশনের চেয়ারপার্সন মোঃ মফিজুল ইসলাম বেনারকে বলেন, “আমরা স্বাধীনভাবে অনুসন্ধান শেষে আট প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে অভিযোগ দায়ের করে তাঁদেরকে শুনানির জন্য তলবি নোটিশ পাঠিয়েছি।”
তিনি জানান, নোটিশ করা প্রতিষ্ঠানগুলো হচ্ছে; তীর ব্রান্ডের সয়াবিন তেল আমদানি ও বিপণনকারী কোম্পানি সিটি এডিবল অয়েল লিমিটেড, রূপচাঁদা ব্রান্ডের বাংলাদেশ এডিবল অয়েল লিমিটেড, ফ্রেশ ব্রান্ডের মেঘনা ও ইউনাইটেড এডিবল অয়েল রিফাইনারি লিমিটেড, বসুন্ধরা ব্রান্ডের বসুন্ধরা অয়েল রিফাইনারি মিল, পুষ্টি ব্রান্ডের শবনম ভেজিটেবল অয়েল ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড, এস আলম ব্রান্ডের এস আলম সুপার এডিবল অয়েল কোম্পানি লিমিটেড, প্রাইম ব্রান্ডের প্রাইম এডিবল অয়েল লিমিটেড এবং রয়্যাল শেফ ব্রান্ডের গ্লোব এডিবল অয়েল লিমিটেড।
গত বুধবার পাঠানো নোটিশে কোম্পানিগুলোকে আগামী ১৮ ও ১৯ মে শুনানিতে উপস্থিত হওয়ার জন্য সময় দেয়া হয়েছে।
বেড়েছে পেঁয়াজ-রসুনেরও দাম
রমজানের সময় ও ঈদের আগে সয়াবিন তেলের তীব্র সংকটের পর ঈদের ছুটি শেষ হতে না হতেই ভোক্তাদের জন্য হাজির হলো নতুন মূল্য তালিকা। গত ৫ মে সয়াবিন তেলের দাম লিটারে ৪০ টাকা বাড়িয়েছেন মিল মালিকরা।
অতীতে তেলের দাম বাড়ানোর ক্ষেত্রে মিল মালিকদের সঙ্গে আলোচনা করে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় থেকে ভোজ্যতেলের দাম ঘোষণা করা হলেও এবার মন্ত্রণালয়ের সাথে পরামর্শ করে মূল্যবৃদ্ধির ঘোষণা দিয়েছে মালিকদের সংগঠন বাংলাদেশ ভেজিটেবল অয়েল রিফাইনার্স অ্যান্ড বনস্পতি ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যাসোসিয়েশন।
নতুন মূল্য তালিকা অনুযায়ী, পরিশোধিত পাম সুপার তেল প্রতি লিটারের সর্বোচ্চ খুচরা মূল্য নির্ধারণ করা হয়েছে ১৭২ টাকা, যা এতদিন ছিল ১৩০ টাকা। সেই হিসাবে পাম তেলের দাম বেড়েছে ২৪ শতাংশ।
নতুন মূল্য অনুযায়ী সয়াবিনের দাম খুচরায় বেড়েছে ২৮ শতাংশ, বোতলজাতের ক্ষেত্রে ২৫ শতাংশ।
সর্বশেষ গত ফেব্রুয়ারিতে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় ভোজ্যতেলের দাম নির্ধারণ করে দিয়েছিল। সে সময় বোতলজাত সয়াবিন তেল প্রতি লিটার ১৬৭ টাকা ও খোলা সয়াবিন তেল ১৪৩ টাকা করে নির্ধারণ করা হয়েছিল।
তেলের পাশাপাশি দেশের বাজারে পেঁয়াজ-রসুনেরও দাম বেড়েছে বলে জানিয়েছেন ব্যবসায়ীরা।
রাজধানীর কাঁচাবাজারগুলোতে গত এক সপ্তাহের ব্যবধানে কেজি পেঁয়াজের দাম ১০ থেকে ২০ টাকা পর্যন্ত বেড়েছে। অপর দিকে দেশি রসুন প্রতি কেজি ৮০ থেকে ৯০ টাকা বিক্রি হচ্ছে।
এছাড়া ডিম, ডাল, আটাসহ প্রায় প্রতিটি পণ্যের মূল্যই ঊর্ধ্বমুখী বলে বেনারকে জানান মাদারটেক কাঁচা বাজারের ব্যবসায়ী আলতাফ মিয়াজী।