বাংলাদেশে ১১ বছরে সর্বোচ্চ মূল্যস্ফীতি

রিয়াদ হোসেন
2023.06.05
ঢাকা
বাংলাদেশে ১১ বছরে সর্বোচ্চ মূল্যস্ফীতি মধ্য দুপুরের কাঁচাবাজারে ক্রেতার অপেক্ষায় থাকা এক বিক্রেতা। ছবিটি ঢাকার শান্তিনগর এলাকা থেকে তোলা। ১১ মে ২০২৩।
[সাবরিনা ইয়াসমীন/বেনারনিউজ]

বাংলাদেশে গত মে মাসে মূল্যস্ফীতি আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় ২ দশমিক ৫৮ শতাংশ বেড়ে প্রায় ১০ শতাংশ হয়েছে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) সোমবার প্রকাশিত হিসাব অনুযায়ী, এটি গত ১১ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ।

তবে প্রকৃত মূল্যস্ফীতি আরও বেশি বলে দাবি করেছে ভোক্তাদের সংগঠন কনজ্যুমার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব)।

সরকারের হিসাব নিয়ে প্রশ্ন তুলে ক্যাবের সহসভাপতি এস এম নাজের হোসেন সোমবার বেনারকে বলেন, “প্রকৃতপক্ষে মূল্যস্ফীতি আরও বেশি হবে।”

গত বছর রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে বিশ্ববাজারে পণ্যমূল্য বেড়ে যাওয়ার পর বাংলাদেশেও জিনিসপত্রের দাম ব্যাপকভাবে বেড়ে যায়। বর্তমানে বিশ্বব্যাপী পণ্যমূল্য পড়তির দিকে থাকলেও বাংলাদেশে বাড়ছে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মার্কিন ডলারের বিপরীতে টাকার মান ব্যাপকভাবে কমে যাওয়া ও আমদানি নিয়ন্ত্রণ করায় আমদানি নির্ভর পণ্যের দাম বেড়ে গেছে, যার প্রভাব পড়ছে সরাসরি ভোক্তার ওপর।

প্রায় সব পণ্যের দাম বেড়েছে

গত এক সপ্তাহের ব্যবধানে অন্তত ১৪ ধরনের নিত্যপণ্যের দাম বেড়েছে। রাজধানীর একাধিক বাজারে কয়েকজন বিক্রেতার সঙ্গে কথা বলেও দাম বৃদ্ধির তথ্যের সত্যতা পাওয়া গেছে।

রাজধানীর মিরপুর ৭ নম্বর সেকশন এলাকার মুদি দোকানি মঞ্জুরুল ইসলাম বেনারকে বলেন, “প্রায় সব পণ্যের দামই বেড়েছে। তবে আলু ও পেঁয়াজের দাম বেড়েছে বেশি।”

তিনি বলেন, “দুই মাস আগে প্রতি কেজি পেঁয়াজের দাম ৫০ টাকা ছিল, যা বর্তমানে ১০০ টাকা করে বিক্রি করছি। সে সময় আলু ৩০ টাকা কেজি দরে বিক্রি করতাম, এখন দাম ৪০ টাকা।”

একই এলাকায় মাছ বিক্রেতা সাইদুর রহমান বেনারকে বলেন, “রুই মাছ প্রতি কেজি ৪০০ টাকায় বিক্রি করতে হচ্ছে। ছয় মাস আগেও দাম ছিল সর্বোচ্চ ৩০০ টাকা। অন্যান্য মাছের দামও বেড়েছে।”

পণ্যমূল্য বৃদ্ধির চাপ সব শ্রেণি-পেশার মানুষের ওপর পড়লেও নির্দিষ্ট পরিমাণ আয় ও অপেক্ষাকৃত কম আয়ের মানুষকে পণ্য ক্রয় কমিয়ে কিংবা অন্যান্য খাতের খরচ বাঁচিয়ে পরিস্থিতি সামাল দিতে হচ্ছে।

মিরপুরের পল্লবী এলাকার বাসিন্দা সাইফুর রহমান চাকরি করেন দুগ্ধ উৎপাদনকারী সমবায় ইউনিয়ন মিল্কভিটায়। তিনি বেনারকে বলেন, “মূল্য বেড়ে যাওয়ায় কিছু পণ্য কেনা কমিয়ে দিয়েছি। যেখানে সপ্তাহে দু’দিন মুরগি রান্না হতো, এখন হয়তো একদিন রান্না হয়।” 

“খরচ বাঁচাতে বাড়িতে মা-বাবাকে দেখতে যাওয়া, আত্মীয় স্বজনের বাড়ি বেড়াতে যাওয়া কিংবা সামাজিক অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ কমিয়ে দিয়েছি,” বলেন তিনি।

বিক্রি কমে যাওয়ার তথ্য দিচ্ছেন বিক্রেতারাও। মাছ বিক্রেতা সাইদুর রহমান বেনারকে বলেন, “আগে যিনি দুই কেজি মাছ কিনতেন, তিনি এখন এক কেজি কিনছেন।”

বাজার নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থতা

সরকারের সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোর বাজার নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থতাও মূল্যস্ফীতির অন্যতম কারণ বলে মনে করছেন এস এম নাজের হোসেন। উদাহরণ দিয়ে তিনি সাম্প্রতিক পেঁয়াজের মূল্যবৃদ্ধির বিষয়টি সামনে আনেন।

নাজের বলেন, “সরকার আজ পেঁয়াজ আমদানির অনুমতি দিয়েছে। ১৫ দিন আগে দিলেও কেজি ১০০ টাকা হতো না।”

বিবিএসের পরিসংখ্যান পর্যালোচনায় দেখা যায়, খাদ্যের চেয়ে খাদ্য বহির্ভূত পণ্যের মূল্যস্ফীতি তুলনামূলক বেশি।

মূল্যস্ফীতির চিত্র পাওয়া যায় বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) তথ্যেও।

বৃহস্পতিবার টিসিবি’র দৈনন্দিন বাজার দর বিশ্লেষণে দেখা যায়, গত এক বছরে চালের দাম কিছুটা স্থিতিশীল থাকলেও বেশির ভাগ নিত্যপণ্যের দাম বেড়েছে। এর মধ্যে আটার দাম বেড়েছে ৩০ শতাংশ, রুই মাছ ২১, মুরগি ২৬, গুঁড়ো দুধ সর্বোচ্চ ৩০ শতাংশ, চিনি ৬১, আলু ৭৬ ও পেঁয়াজের দাম বেড়েছে ১২৫ শতাংশ।

অর্থনীতিবিদ ও অর্থনীতি গবেষণা প্রতিষ্ঠান রিসার্চ অ্যান্ড পলিসি ইন্টিগ্রেশন ফর ডেভেলপমেন্টের চেয়ারম্যান ড. মোহাম্মদ আব্দুর রাজ্জাক মনে করেন, সরকারের দেওয়া মূল্যস্ফীতির তুলনায় প্রকৃত মূল্যস্ফীতি আরও বেশি হতে পারে। কেননা বিবিএস হিসাব করে নির্দিষ্ট পণ্যের মূল্যের ওপর ভিত্তি করে।

আব্দুর রাজ্জাক বেনারকে বলেন, “গত এক বছরে ডলারের বিপরীতে টাকার অবমূল্যায়ন হয়েছে বিশাল (২৫ শতাংশের বেশি)। ফলে চিনি, তেল, গমসহ অন্যান্য ভোগ্য পণ্য আমদানি মূল্য বেড়েছে। এছাড়া সরকার আমদানি নিয়ন্ত্রণ করার ফলেও কিছু পণ্যমূল্য বেড়েছে, যা মূল্যস্ফীতি বাড়াতে ভূমিকা রেখেছে।”

সরকারও পণ্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে রাখতে সরবরাহ ব্যবস্থা নিরবচ্ছিন্ন রাখার গুরুত্ব অনুধাবন করছে।

গত শনিবার রাজধানীর মতিঝিলে এক অনুষ্ঠানে পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান বলেন, “বাজারকে মসৃণ রাখতে হবে। এটি নিশ্চিত করা গেলে মূল্যস্ফীতির বড়ো অংশ এমনিতেই পড়ে যাবে।”

“আমাদের মধ্যে ভয় ঢুকে গেছে (পণ্যমূল্য নিয়ে), এ বাজারকে বাধাগ্রস্ত করার প্রচেষ্টা চলছে,” যোগ করেন তিনি।

মজুরির তুলনায় মূল্যস্ফীতি বৃদ্ধির হার বেশি

মূল্যস্ফীতি যে হারে বাড়ছে, তার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বেশির ভাগ মানুষের আয় বাড়ছে না। বিবিএসের হিসাব অনুযায়ী, সর্বশেষ মে মাসে আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় মজুরি বৃদ্ধির হার ৭ দশমিক ৩২ শতাংশ। অথচ একইসময়ের মূল্যস্ফীতি ১০ শতাংশ। এটি মানুষকে ঋণের দিকেও ঠেলে দিয়েছে।

নারায়ণগঞ্জের জালকুড়ি এলাকার রাসেল গার্মেন্টসের শ্রমিক রাহেনা বেগম বেনারকে জানান, গত পাঁচ মাস ধরে তার কারখানায় ওভারটাইম কাজ নেই। আগে মাসে ১২ হাজার টাকা আয় হলেও ওভারটাইম বন্ধ হয়ে যাওয়ায় পাচ্ছেন ৯ হাজার ৩২৬ টাকা।

“দুই মেয়েকে নিয়ে খরচ সামলাতে পারি না। মাছ-মাংস, মুরগি কিনতে পারি না। ডাল-ভাত খেয়ে মেয়ের স্কুলের খরচ ঠিক রাখছি। তাতে আমার এ কয়েক মাসে ২০ হাজার টাকা ঋণ হয়ে গেছে,” বলেন তিনি।

দামের লাগাম টানতে পেঁয়াজ আমদানি

এদিকে ক্রমাগত বাড়তে থাকা পেঁয়াজের দামে লাগাম টানতে সরকার সোমবার থেকে পেঁয়াজ আমদানির অনুমতি (আইপি) দিতে শুরু করেছে। কৃষি মন্ত্রণালয়ের সূত্র অনুযায়ী, প্রথম দিনই প্রায় তিন লাখ মেট্রিক টন পেঁয়াজ আমদানির অনুমতি দেওয়া হয়েছে।

কৃষি মন্ত্রণালয়ের জনসংযোগ কর্মকর্তা কামরুল ইসলাম ভূঁইয়া সাংবাদিকদের জানান, কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সোমবার প্রথম ২১০টি আইপি আবেদন অনুমোদন করেছে। এসব আবেদনের বিপরীতে পেঁয়াজের পরিমাণ দুই লাখ ৮০ হাজার ৮০০ মেট্রিক টন। তিনি বলেন, সংবাদমাধ্যমের খবর অনুযায়ী, পেঁয়াজ আমদানির খবরে চট্টগ্রামের খাতুনগঞ্জসহ পাইকারি আড়তগুলোতে দাম কমতে শুরু করেছে।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।