ডিমসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় তিন পণ্যের দাম নির্দিষ্ট করে দিলো সরকার
2023.09.14
ঢাকা
নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের বাজার নিয়ন্ত্রণে রাখতে প্রথমবারের মতো আলু ও ডিমের দাম নির্ধারণ করে দিয়েছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। এর পাশাপাশি খুচরা বাজারে পিঁয়াজেরও দাম নির্ধারণ করে দেয়া হয়েছে।
“উৎপাদন খরচ হিসাব করে আমরা দেখেছি, ডিম, আলু ও পেঁয়াজ বেশি দামে বিক্রি হচ্ছে। সে জন্য আমরা কৃষি মন্ত্রণালয় এবং মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের সমন্বয়ে এই দাম নির্ধারণ করেছি,” বৃহস্পতিবার সংবাদ সম্মেলনে বলেন বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি।
সরকার এমন সময় দাম নির্ধারণ করে দিলো, যখন গত আগস্টে খাদ্যপণ্যে বাংলাদেশ ১২ বছরে সর্বোচ্চ মূল্যস্ফীতি দেখেছে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর হিসাব অনুযায়ী, এর আগে ২০১০-১১ অর্থবছরে খাদ্য মূল্যস্ফীতি ছিল ১৪ শতাংশের উপরে।
নির্ধারিত নতুন দাম অনুযায়ী, প্রতিটি ডিম খুচরা পর্যায়ে সর্বোচ্চ ১২ টাকায় বিক্রি হবে। সে হিসাবে প্রতি ডজন ডিম বিক্রি হবে সর্বোচ্চ ১৪৪ টাকায়, যা বর্তমানে ১৫০ টাকা, কোথাও কোথাও আরও বেশি দামে বিক্রি হচ্ছে।
প্রতি কেজি পেঁয়াজ সর্বোচ্চ ৬৫ টাকা এবং প্রতি কেজি আলু ৩৬ টাকায় বিক্রির দর নির্ধারণ করে দেওয়া হয়েছে। একই দিন ভোজ্য তেলের দাম লিটার প্রতি পাঁচ টাকা কমিয়ে ১৭৪ টাকায় নির্ধারণ করা হয়েছে।
সরকারি প্রতিষ্ঠান ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) হিসাবে বাজারে প্রতি কেজি পেঁয়াজ ও আলু সর্বোচ্চ ১৫ টাকা অতিরিক্ত দামে বিক্রি হচ্ছে।
যদিও টিসিবি প্রকাশিত মূল্যের তুলনায় বাজারে কোনো কোনো পণ্যের দাম আরো বেশি।
এই প্রতিবেদক ইস্কাটনে অবস্থিত শাহ ডিপার্টমেন্টাল স্টোরে প্রতি কেজি দেশি পেঁয়াজ ৯০ টাকা বিক্রি হতে দেখেছেন।
দোকানের বিক্রয়কর্মী আব্দুর রাজ্জাক বেনারকে বলেন, “এক সপ্তাহ আগে প্রতি কেজি পেঁয়াজ বিক্রি করেছি ১০০ টাকায়। এখন দাম কিছুটা কমেছে।”
“আমরা যে দামে কিনি, সেখান থেকে কেজিতে দুই-তিন টাকা লাভ করি,” বলেন তিনি।
সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন নিয়ে সংশয়
সরকার নির্ধারিত দামে পণ্য বিক্রি না করলে ‘কঠোর’ হওয়ার ইঙ্গিত দিয়েছেন বাণিজ্যমন্ত্রী।
তিনি বলেন, “খুচরা পর্যায়ে প্রতিটি ডিম ১২ টাকায় বিক্রির সিদ্ধান্ত যদি ব্যবসায়ীরা না মানেন, তাহলে পণ্যটি আমদানির অনুমতি দেওয়া হবে। ইতোমধ্যে ডিম আমদানির অনুমতি চেয়ে ব্যবসায়ীদের আবেদন মন্ত্রণালয়ে জমা আছে।”
হিমাগার থেকে বেশি দামে আলু বিক্রির অভিযোগ পাওয়া গেলে নিলাম করে নির্ধারিত দামে আলু বিক্রি করে দেওয়া হবে বলেও জানান তিনি।
সরকারের এমন উদ্যোগকে স্বাগত জানালেও এটি বাস্তবায়ন হবে কি না তা নিয়ে সংশয় প্রকাশ করেছেন ভোক্তাদের প্রতিনিধিরা।
ভোক্তাদের সংগঠন কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সহসভাপতি এস এম নাজের হোসেন বেনারকে বলেন, “এই দামে খুচরা বাজারে বিক্রি হবে কি না তা নিয়ে সংশয় আছে। দাম নির্ধারণ করে দিলেই হবে না, মাঠ পর্যায়ে এই দামে বিক্রি নিশ্চিত করতে হবে।”
গত মে মাসে সরকার চিনির দাম বাড়িয়ে প্রতি কেজি ১২০ টাকা দর নির্ধারণ করে দেয়। ভোক্তাদের অভিযোগ, বাড়তি দামেই তাঁদের চিনি কিনতে হচ্ছে।
রাজধানীর ইব্রাহিমপুর এলাকার গৃহিণী তাহমিনা আক্তার বেনারকে জানান, গত সপ্তাহে তিনি চিনি কিনেছেন ১৪০ টাকা কেজি দরে।
দাম বৃদ্ধির পেছনে মুনাফালোভী চক্র?
ক্রমাগত দাম বৃদ্ধির জন্য ব্যবসায়ীদের এক পক্ষ অন্য পক্ষকে দায়ী করছে। গত ১০ সেপ্টেম্বর আলুর দর নিয়ে সংবাদ সম্মেলনে বাংলাদেশ কোল্ড স্টোরেজ অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি মোস্তফা আজাদ চৌধুরী বাবু বলেন, “মুনাফালোভী একটি চক্র আলু মজুত করে দাম বৃদ্ধি করছে। এখানে কোল্ড স্টোরেজ মালিকদের কোনো দায় নেই।”
সব খরচ ও মুনাফাসহ প্রতি কেজি আলুর দাম ভোক্তা পর্যায়ে ৩৬ টাকার বেশি হওয়ার যৌক্তিকতা নেই মন্তব্য করে ওইদিন তিনি বলেন, “কারা সিন্ডিকেট করে আলুর দাম বাড়াচ্ছে, সরকার চাইলে আমরা সেসব তথ্য দেবো।”
বৃহস্পতিবার সরকারের সিদ্ধান্তের বিষয়ে জানতে চাইলে মোস্তফা আজাদ এ উদ্যোগকে স্বাগত জানান। তিনি বলেন, “এই দামে আলু বিক্রি করা সম্ভব।”
তবে কারওয়ানবাজারের পেঁয়াজের আড়তদার আশরাফ হোসেন বেনারকে বলেন, “প্রতি কেজি পেঁয়াজ খুচরা পর্যায়ে বিক্রি করতে আমাদের কিনতে হবে কেজি ৫৫ টাকায়। এটি মনে হয় সম্ভব হবে না।”
তিনি জানান, প্রতি কেজি পেঁয়াজ আজ (বৃহস্পতিবার) পাবনার হাট থেকে কিনতে খরচ হয়েছে ৭৫ টাকা, (খুচরা বাজারে) বিক্রি হচ্ছে ৮০ টাকায়।”
কৃষি মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন কৃষি বিপণন অধিদপ্তর বলছে, সরকার যৌক্তিক দাম নির্ধারণ করেছে।
উল্লেখ্য, পেঁয়াজ ও আলুর দাম নির্ধারণ করে মূলত কৃষি বিপণন অধিদপ্তর।
বৃহস্পতিবারের সভায় তাদের মতামত নিয়ে দাম নির্ধারণ করে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়।
ওই সভায় উপস্থিত ছিলেন কৃষি বিপণন অধিদপ্তরের সহকারী পরিচালক প্রণব কুমার বেনারকে বলেন, “উৎপাদন খরচের পর উৎপাদকের ১৫ শতাংশ, পাইকারের ১০ শতাংশ ও খুচরা বিক্রেতার ১৫ শতাংশ মুনাফা এবং বিপণন ও পরিবহন ব্যয় ধরেই এই দাম নির্ধারণ করা হয়েছে।”
স্বল্প আয়ের মানুষের কঠিন সময়
রাজধানীর শেওড়াপাড়ার বাসিন্দা ৪২ বছর বয়সী মুরাদ হোসেন চাকরি হারিয়ে এখন কনটেন্ট লিখে মাসে ২৫ হাজার টাকার মতো আয় করেন। তিনি বলেন, “ক্রমাগত জিনিসপত্রের মূল্য বাড়ছে। চলতি মাসে এ পর্যন্ত মাত্র সাড়ে পাঁচ হাজার টাকা আয় করেছি। আগামী দিনগুলো কীভাবে যাবে জানি না।”
খরচ কুলাতে না পেরে তিনি তাঁর বাসার অর্ধেক ভাড়া দিতে বাধ্য হয়েছেন বলেন জানান মুরাদ।
তিনি বলেন, “ঠিকভাবে বাজার তদারকি করতে না পারলে এই দাম বাস্তবায়ন হবে না।”
রাজধানীর অদূরে নারায়ণগঞ্জের পোশাক কারখানা ফতুল্লা অ্যাপারেলসের শ্রমিক চামেলী আক্তার বলেন, “দামি মাছ তো কিনতে পারি না। পাঙাশ আর তেলাপিয়া কিনি। এক বছরে পাঙাশের দাম ১২০ টাকা থেকে বেড়ে এখন ১৮০ থেকে ২০০ টাকায় কিনছি।”
মাসে নয় হাজার ৬০০ টাকা বেতন পান চামেলী। তিনি জানান, তাঁর ও স্বামীর আয় থেকে আগে কিছু টাকা জমাতে পেরেছেন—এখন আর পারছেন না।
বাজার তদারকি শুরুর ঘোষণা
নতুন নির্ধারিত দরে পণ্য বিক্রি হচ্ছে কি না জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর তা তদারকি শুরু করবে বলে জানিয়েছেন সংস্থাটির মহাপরিচালক এএইচএম সফিকুজ্জামান। তিনি বেনারকে বলেন, “আমরা আগামী দুই দিন পরিস্থিতি দেখব। এরপর সরকার নির্ধারিত দামে বিক্রি না হলে আইনগত ব্যবস্থা নেব।”
এর আগেও কিছু পণ্য সরকার নির্ধারিত দামে বিক্রি না হওয়ার অভিযোগ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে তিনি বলেন, “এ জন্য অন্যান্য দপ্তরের সঙ্গে সমন্বয় প্রয়োজন। আমরা তাদেরও সহায়তা নেব।”
তিনি বলেন, “স্যালাইন, ডাব, ডিমসহ আরও কিছু পণ্যের দাম বেড়ে যাওয়ার পর আমরা অভিযান শুরু করেছি। বাজারে এর ইতিবাচক প্রভাব পড়েছে।”