উপাচার্যের পদত্যাগ দাবিতে শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীদের আমরণ অনশন, আন্দোলন ছড়িয়ে পড়েছে অন্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে

কামরান রেজা চৌধুরী
2022.01.24
ঢাকা
উপাচার্যের পদত্যাগ দাবিতে শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীদের আমরণ অনশন, আন্দোলন ছড়িয়ে পড়েছে অন্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সিলেটের শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের পদত্যাগের দাবিতে তাঁর বাসভবনের সমনে শিক্ষার্থীদের অনশন ধর্মঘট। ২৪ জানুয়ারি ২০২২।
[বেনারনিউজ]

সিলেটের শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (শাবিপ্রবি) উপাচার্য অধ্যাপক ফরিদ উদ্দিন আহমেদের পদত্যাগের দাবিতে সেখানে চলমান আন্দোলনের পক্ষে সোমবার প্রতীকী অনশনসহ বিভিন্ন প্রতিবাদ কর্মসূচি পালন করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ দেশের বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক, শিক্ষার্থী ও রাজনৈতিক সংগঠন।

তাঁদের একমাত্র দাবি, উপাচার্য ফরিদ উদ্দিনের পদত্যাগ। এই দাবিতে তাঁকে বাসভবনে অবরুদ্ধ করে রেখেছেন শিক্ষার্থীরা।

বুধবার থেকে আমরণ অনশন শুরু করা শিক্ষার্থীদের অনেকেই অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে ভর্তি রয়েছেন। তাঁরা মুখে খাবার গ্রহণ করছেন না বলে সোমবার রাতে বেনারকে জানান বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকর্ম বিভাগের অধ্যাপক ও সাবেক ডিন আ.ক.ম. মাহবুবুজ্জামান।

তিনি সোমবার হাসপাতালে শিক্ষার্থীদের দেখতে যান এবং তাঁদের সাথে কথা বলে অনশন ভাঙ্গতে অনুরোধ করেন।

অধ্যাপক মাহবুবুজ্জামান বলেন, “আমি চিকিৎসকদের সাথে কথা বলেছি। উনারা বলছেন, হাসপাতালে ভর্তি শিক্ষার্থীদের কয়েকজন যদি এখনই মুখে কোনো খাবার না খায় সেক্ষেত্রে তাদের শরীরে অনেক বড়ো ক্ষতি হয়ে যেতে পারে।”

তিনি বলেন, “আমি তাদের বিষয়টি বুঝিয়ে বলেছি। একজন শিক্ষার্থী তো কথা বলতে এবং শুনতেই পারছে না। আমি তার কানের কাছে গিয়ে অনশন ভাঙতে বলেছি। কিন্তু তাঁরা কোনো কিছুই শুনতে চায় না।”

“আমি মনে করি শিক্ষার্থীরা কোনো প্রকার আক্রমণাত্মক কাজ করেনি। তাঁরা কোনো শিক্ষককে আঘাত করেনি। সুতরাং, তাদেরকে পুলিশ দিয়ে পিটিয়ে ছত্রভঙ্গ করার কোনো দরকার ছিল না,” বলেন অধ্যাপক মাহবুব।

সিলেটের বাইরে কর্মসূচি

সোমবার সিলেটের বাইরে সবচেয়ে বড়ো কর্মসূচি পালন করেন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক নেটওয়ার্ক। তাঁরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে অপরাজেয় বাংলার পাদদেশে প্রতীকী অনশন পালন করেন।

বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক নেটওয়ার্কের অন্যতম সমন্বয়ক অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ সোমবার বেনারকে বলেন, “শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের প্রতি সমর্থন দিয়ে আজকে আমরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অপরাজেয় বাংলার পাদদেশে প্রতীকী অনশন ধর্মঘট করেছি।”

তিনি জানান, ঢাকা ছাড়া সোমবার বরিশাল ও রাজশাহীতে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকরা প্রতীকী অনশন ধর্মঘট পালন করেছেন।

আগামীকাল থেকে অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়েও শিক্ষার্থীদের অনশনের প্রতি সমর্থন জানিয়ে কর্মসূচি পালন করা হবে জানিয়ে আনু মুহাম্মদ বলেন, “আমরা মনে করি শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ছাত্রদের দাবির প্রতি সম্মান দেখিয়ে আর সময়ক্ষেপণ না করে পদত্যাগ করে চলমান অচলাবস্থার সমাধান করবেন।”

তিনি বলেন, “ছাত্রছাত্রীদের সমস্যা সমাধান না করে তিনি পুলিশ দিয়ে আক্রমণ করেছেন। কাজটি সঠিক হয়নি।”

অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ বলেন, শিক্ষার্থীদের খাবার মান উন্নত করাসহ ছোটখাট যেসকল দাবি রয়েছে সেগুলোর সমাধান করতে হবে।

উপাচার্য ফরিদ উদ্দিনের পদত্যাগের দাবিতে সোমবার রাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে মশাল মিছিল বের করে বামপন্থী ছাত্র সংগঠন ও নাগরিক ঐক্য।

এর আগে শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের অচলাবস্থা নিরসন করা না হলে এই আন্দোলন সারাদেশে ছড়িয়ে দেয়ার হুমকি দিয়েছে বিরোধীদল বিএনপির ছাত্র সংগঠন জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল।

যেভাবে সংকট শুরু

আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের অন্যতম সাদিয়া আফরীন সোমবার রাতে বেনারকে বলেন, সংকটের সূচনা মূলত ১৩ জানুয়ারি ছাত্রী হোস্টেল প্রভোস্টের একটি বেফাঁস মন্তব্যকে কেন্দ্র করে।

তিনি বলেন, তাঁদের হোস্টেলের খাবারের নিম্নমান, পানি সমস্যা, ওয়াইফাইসহ বিভিন্ন ধরনের সমস্যা নিয়ে কথা বলতে হোস্টেলের প্রভোস্টকে ওই দিন রাতে আসতে অনুরোধ করেন ছাত্রীরা।

কিন্তু প্রভোস্ট সশরীরে উপস্থিতি হতে অস্বীকৃতি জানিয়ে কথার এক পর্যায়ে বলেন, “এখনই কেন যেতে হবে? কেউ কি মারা গেছে?”

প্রভোস্টের এহেন মন্তব্যে ক্ষুব্ধ হয়ে বিষয়টি নিয়ে উপাচার্য ফরিদ উদ্দিন আহমেদের কাছে গিয়ে প্রভোস্টের অপসারণ দাবি করেন শিক্ষার্থীরা। উপাচার্য ফরিদ শিক্ষার্থীদের দাবি না মেনে তদন্ত করে ব্যবস্থা নিতে এক মাস সময় চেয়ে নেন।

কিন্তু শিক্ষার্থীরা ওই প্রভোস্টের অপসারণ ছাড়া আর কিছু মানতে নারাজ। উপাচার্যও প্রভোস্টকে অপসারণ করতে অস্বীকৃতি জানান। দাবি না মানায় ১৬ জানুয়ারি এক একাডেমিক ভবনে অবরুদ্ধ করেন আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা।

উপাচার্যকে উদ্ধার করতে শিক্ষার্থীদের ওপর পুলিশ লাঠিচার্জ কাঁদানে গ্যাস ও রাবার বুলেট নিক্ষেপ করে। পুলিশের এই লাঠিচার্জে অনেক ছাত্রছাত্রী এবং পুলিশ সদস্য আহত হন। এই ঘটনার পর প্রভোস্ট অপসারণের দাবি পরিবর্তিত হয়ে উপাচার্য অপসারণের দাবিতে পরিণত হয়।

গত বুধবার থেকে আমরণ অনশন শুরু করেন ২৪ শিক্ষার্থী। এদের মধ্যে বেশ কয়েকজন অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। তবে তাঁদের খাবার খাওয়ানো সম্ভব হয়নি। পরে আরও চারজন শিক্ষার্থী অনশনে যোগ দেন।

সাদিয়া আফরীন বলেন, “আমাদের শিক্ষার্থীরা অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে ভর্তি আছেন। অনেকের অবস্থা বেশ খারাপ। কিন্তু এখন পর্যন্ত বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের পক্ষ থেকে সমাধান সমাধানে কোনো প্রকার প্রকার উদ্যোগ নেয়া হয়নি।”

আমরা ভয়ে আছি

শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার মো. ইশফাকুল হোসেন সোমবার বেনারকে বলেন, “এই সমস্যা শুরু হওয়ার পর থেকে প্রায় প্রতিদিনই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা শিক্ষার্থীদের কাছে যাচ্ছেন, অনশন ভাঙতে বলছেন। কিন্তু তারা অনড়।”

তিনি বলেন, “বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলর ও কোষাধ্যক্ষ দুজনই আটকা পড়ে আছেন। আমরা সমস্যা সমাধানের চেষ্টা করছি।”

ইশফাকুল হোসেন বলেন, “মন্ত্রণালয়ের মাননীয় মন্ত্রী নিজেই এই বিষয়টি দেখছেন, সুরাহা করার চেষ্টা করছেন। সুতরাং, আমাদের তেমন কিছু করার নেই।”

অনশনরত শিক্ষার্থীদের অবস্থা ভালো নয় স্বীকার করে তিনি বলেন, “কোনো শিক্ষার্থীর খারাপ কিছু হয়ে যায় কি না এ ব্যাপারে আমরা ভয়ে আছি। আমরা চাই না কোনো শিক্ষার্থীর ক্ষতি হোক।”

শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের অচলাবস্থা সমাধানের জন্য শিক্ষার্থীদের সাথে অনলাইনে কথা বলেছেন শিক্ষামন্ত্রী দিপু মণি। কিন্তু সমস্যার সমাধান হয়নি।

দিপু মণি আলোচনার জন্য শিক্ষার্থীদের ঢাকায় এসে আলোচনার আহ্বান জানান। কিন্তু শিক্ষার্থীরা ঢাকায় আসেননি।

এই বিশ্ববিদ্যালয়ের অচলাবস্থা বিষয়ে বিরোধীদল জাতীয় পার্টির সদস্যরা রোববার সংসদে শিক্ষামন্ত্রীর সমালোচনা করে উপাচার্যকে সরিয়ে দেয়ার আহ্বান জানান।’

রোববার রাতে উপাচার্য বাসভবনের পানি, বিদ্যুৎ, গ্যাসসহ ইউটিলিটি সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেয় শিক্ষার্থীরা। তবুও তিনি বাসায় অবস্থান করছেন। পদত্যাগের কোনো সিদ্ধান্ত নেননি।

ক্ষমা চাইলেন উপাচার্য

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে সোমবার জানানো হয়েছে, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ফরিদ উদ্দিন আহমেদ এই বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রীদের নিয়ে আপত্তিকর মন্তব্যের জন্য দুঃখ প্রকাশ করে ক্ষমা চেয়েছেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের জনসংযোগ কার্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত পরিচালক মোহাম্মদ মহিউদ্দিন স্বাক্ষরিত এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এ তথ্য জানানো হয়।

বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, উপাচার্য ফারজানা ইসলামের মুঠোফোনে কল করেন শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ফরিদ উদ্দিন আহমেদ। এ সময় জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রীদের সম্পর্কে মন্তব্যের জন্য দুঃখ প্রকাশ করে ক্ষমা চান তিনি।

তবে ফরিদ উদ্দিন আহমেদ দাবি করেছেন, তাঁর বক্তব্য সম্পাদনা করে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রচার করা হয়েছে। এতে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের মনে ক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছে এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও সংশ্লিষ্ট সবাই আহত হয়েছেন।

শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের পদত্যাগের দাবিতে এখন আন্দোলন করছেন বিশ্ববিদ্যালয়টির শিক্ষার্থীরা। এর মধ্যেই উপাচার্য ফরিদ উদ্দিন আহমেদের একটি অডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হয়েছে। সেখানে ভিসিকে বলতে শোনা যায়, ‘জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের মেয়েদের সহজে কেউ বউ হিসেবে নিতে চায় না।’

এ মন্তব্যের প্রতিবাদে গত বুধবার ফরিদ উদ্দিন আহমেদের কুশপুত্তলিকা দাহ করেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রীরা। পরে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সমিতি ও বঙ্গবন্ধু শিক্ষক পরিষদ পৃথক বিবৃতিতে ফরিদ উদ্দিন আহমেদের বক্তব্য প্রত্যাহারের আহ্বান জানান।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।