শেখ হাসিনাসহ ৭ জনের বিরুদ্ধে হত্যা মামলা
2024.08.13
ঢাকা
গত মাসে ছাত্র-নেতৃত্বাধীন বিক্ষোভ চলাকালে নিরাপত্তা বাহিনীর গুলিতে নিহত এক মুদি ব্যবসায়ীকে হত্যার ঘটনায় সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, দুই সাবেক মন্ত্রী এবং চার পুলিশ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে হত্যা মামলা করেছেন ঢাকার এক বাসিন্দা।
মঙ্গলবার ঢাকার চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে রাজধানীর মোহাম্মদপুর এলাকার ব্যবসায়ী এস এম আমীর হামজা বাদী হয়ে এ মামলা দায়েরের আবেদন করেন। আদালত আবেদনটি এজাহার হিসেবে গ্রহণ করতে মোহাম্মদপুর থানাকে নির্দেশ দেয়।
এই মামলার অপর ছয় আসামি হলেন; আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং সাবেক সড়ক পরিবহণ ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের, সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান, পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক (আইজিপি) চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুন, ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) সাবেক কমিশনার হাবিবুর রহমান, অতিরিক্ত কমিশনার ও ডিএমপির গোয়েন্দা ইউনিট প্রধান মো. হারুন অর রশীদ ও যুগ্ম কমিশনার বিপ্লব কুমার সরকার।
বাদীর আইনজীবী মো. মামুন মিয়া সাংবাদিকদের জানান, ঢাকার চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট রাজেশ চৌধুরী মামলার আবেদনটি গ্রহণ করে নিয়মিত মামলা হিসেবে রুজু করতে মোহাম্মদপুর থানাকে নির্দেশ দিয়েছেন।
মামলার অভিযোগে বলা হয়েছে, “গত ১৯ জুলাই মোহাম্মদপুরে বসিলার ৪০ ফিট এলাকায় ছাত্র-জনতা শান্তিপূর্ণ মিছিল সমাবেশ করছিল। সেখানে পুলিশ নির্বিচারে গুলি চালায়। রাস্তা পার হওয়ার সময় স্থানীয় মুদি দোকানদার আবু সায়েদ মাথায় গুলিবিদ্ধ হয়ে ঘটনাস্থলেই মৃত্যুবরণ করেন।”
এতে আরও বলা হয়, নিহতের মা, স্ত্রী ও ছেলে পঞ্চগড়ে থাকেন। তাঁরা ঢাকায় এসে মামলা করতে অপারগ। এ জন্য বিবেকের তাড়নায় আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার জন্য মামলা করেছেন তিনি।
অভিযোগে বাদী বলেন, “সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কোটা সংস্কার আন্দোলন কঠোর হস্তে দমন করার জন্য বারবার নির্দেশ দিয়েছেন। ওবায়দুল কাদের ও আসাদুজ্জামান কামালের নির্দেশে পুলিশের আইজিপি ও ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা অধীনস্থ পুলিশ সদস্যদের নির্দেশ দিয়ে মিছিলে গুলি চালান। পরস্পর যোগসাজশে আসামিরা হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছেন। কাজেই এর বিচার হওয়া প্রয়োজন।”
এর আগে ২০০৭ সালে সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে ১৫টি মামলা মোকাবেলা করছিলেন শেখ হাসিনা। এই মামলাগুলোর মধ্যে ৯টি ছিল দুর্নীতির মামলা এবং ছয়টি ছিল চাঁদাবাজি ও অন্যান্য অভিযোগে।
পরে ২০০৮ সালে সাধারণ নির্বাচনের মধ্যে দিয়ে ক্ষমতায় আসার পর দুর্নীতির মামলাগুলো হাইকোর্ট থেকে বাতিল বা খারিজ হয়ে যায় এবং অপর মামলাগুলো প্রত্যাহার করে নেন বাদিরা।
ওই নির্বাচনে ক্ষমতায় আসার পর থেকে নিরবিচ্ছিন্নভাবে ক্ষমতায় ছিলেন হাসিনা, যার শেষ হয় ছাত্র-জনতার গণ অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে। ৩৫ দিনের এই আন্দোলনে আন্দোলনকারী শিক্ষার্থী, সাধারণ মানুষ, বাসায় থাকা শিশু, পুলিশ ও সাংবাদিকসহ কমপক্ষে ৫২৮ জনের মৃত্যু হয় বলে নিশ্চিত হওয়া গেছে পুলিশ ও হাসপাতাল সূত্রে।
সালমান এফ রহমান ও আনিসুল হক গ্রেপ্তার
মঙ্গলবার সন্ধ্যায় রাজধানী থেকে গ্রেপ্তার হয়েছেন শেখ হাসিনা সরকারের সাবেক আইনমন্ত্রী আনিসুল হক ও সাবেক প্রধানমন্ত্রীর বেসরকারি শিল্প ও বিনিয়োগ উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান।
শেখ হাসিনা সরকারের প্রভাবশালী এই দুই ব্যক্তির গ্রেপ্তারের খবর নিশ্চিত করে ডিএমপি কমিশনার মো. মাইনুল হাসান বেনারকে বলেন, “নৌপথে পালিয়ে যাওয়ার সময় রাজধানীর সদরঘাট এলাকা থেকে সালমান এফ রহমান ও আনিসুল হককে পুলিশ গ্রেপ্তার করেছে।”
তিনি বলেন, নিউ মার্কেট থানায় দায়েরকৃত একটি হত্যা মামলায় এই দুই ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার দেখানো হয়েছে।
ছাত্র–জনতার আন্দোলনের মুখে পদত্যাগ করে দেশ থেকে শেখ হাসিনা ভারতে পালিয়ে যাবার পর ৫ আগস্ট থেকেই আত্মগোপনে ছিলেন এই দুই ব্যক্তি।
পেশায় একজন আইনজীবী আনিসুল হক ২০১৪ সালে ব্রাহ্মণবাড়িয়া-৪ (আখাউড়া ও কসবা) থেকে নির্বাচন করে আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়ে আইনমন্ত্রীর দায়িত্ব নেন।
অপরদিকে দেশের অন্যতম শীর্ষ ও বিতর্কিত ব্যবসায়ী সালমান এফ রহমান শেখ হাসিনার বেসরকারি খাতবিষয়ক উপদেষ্টা ছিলেন।
খোঁজ নেই অধিকাংশ আওয়ামী লীগ নেতার
শেখ হাসিনা পালিয়ে যাওয়ার পর বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের মন্ত্রী, মন্ত্রী পদমর্যাদার ব্যক্তি, এমপি ও কেন্দ্রীয় নেতাদের অনেকেই দেশ ছেড়েছেন। যাঁরা দেশত্যাগ করতে পারেননি তাঁরা দেশের বিভিন্ন স্থানে আত্মগোপনে রয়েছেন।
বিতর্কিত মন্তব্যের জন্য সমালোচিত আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং সাবেক সড়ক পরিবহণ ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের কোথায় গেছেন তা নির্দিষ্ট করে কেউ বলতে পারেননি।
সংসদ এলাকার যে বাসায় ২০০৭ সালে শেখ হাসিনাকে আটক করে রাখা হয়েছিল সেই বাসায় থাকতেন কাদের।
৫ আগস্ট বিকেল তিনটার দিকে সংসদ ভবন প্রাঙ্গণে দলে দলে বিক্ষোভকারীরা ঢুকে পড়ে।
ওই এলাকার একাধিক বাসিন্দা বেনারকে জানান, এর কিছুক্ষণ আগে আগে নিজ বাসা ছেড়ে উল্টোদিকে এক যুগ্মসচিবের বাসায় ঢুকে পড়েন ওবায়দুল কাদের। তার পরনে ছিল সাদা পাঞ্জাবী। যুগ্মসচিবের বাসার সামনের রাস্তায় একটি পুলিশের গাড়ি আসে। কাদের ওই যুগ্মসচিবের স্ত্রীর সাথে হাঁটতে হাঁটতে পুলিশের গাড়িতে চড়ে অজ্ঞাতস্থানে চলে যান।
এরপর থেকে কাদেরের ফোন বন্ধ পাওয়া যাচ্ছে। তাঁর একান্ত সচিব, সহকারী একান্ত সচিবের ফোনও বন্ধ।
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান ৪ আগস্ট রাতে সাংবাদিক সম্মেলন করে জানান, ছাত্র আন্দোলনে যাঁরা নিহত হয়েছেন তাঁরা কেউই পুলিশের গুলিতে নিহত হননি। ৫ আগস্ট মন্ত্রীর বাসভবনে আগুন দেয় বিক্ষোভকারীরা।
সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর জনসংযোগ কর্মকর্তা শরীফ মাহমুদ অপু বেনারকে বলেন, “স্যারের সাথে আমার সর্বশেষ কথা হয়েছে ৪ তারিখ। উনি কোথায় গেছেন, আমি জানি না।”
একইভাবে শেখ হাসিনা পদত্যাগের পর থেকে সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী হাছান মাহমুদ এবং সাবেক তথ্য ও যোগাযোগ প্রতিমন্ত্রী জুনায়েদ আহমেদ পলকের অবস্থান সম্পর্কেও নিশ্চিত করে কেউ কোনো তথ্য দিতে পারেনি।
শেখ পরিবারের সদস্যরাও পালিয়ে
শেখ মুজিবুর রহমানের পরিবারের সদস্য ও স্বজনেরা ‘শেখ পরিবার' বলে পরিচিত। এই পরিবারের প্রভাবশালী সদস্যদের অনেকেই দেশে নেই বলে জানা গেছে।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ফুপাতো ভাই ও সাবেক চিফ হুইপ আবুল হাসানাত আব্দুল্লাহ বর্তমানে ভারতে রয়েছেন বলে বেনারকে জানান তাঁর একান্ত সচিব খায়রুল বশার।
তিনি বলেন, “ছাত্র আন্দোলন শুরুর আগে স্যার ভারতে গেছেন চিকিৎসার জন্য। আমি জানি না কবে উনি আসবেন।”
শেখ হাসিনার আরেক ফুপাতো ভাই শেখ ফজলুল করিম সেলিমের একান্ত সচিব এস. এম. মঞ্জুর বেনারকে বলেন, “স্যার কোথায় জানি না।।”
শেখ হাসিনার ভাতিজা ও সদ্য ভেঙ্গে দেওয়া সংসদের চিফ হুইপ নূর-ই-আলম চৌধুরীর একান্ত সচিব আব্দুল কাদের জিলানী বেনারকে বলেন, “স্যারের সাথে আমার যোগাযোগ নেই। উনি কোথায় গেছেন জানি না।”
শেখ হাসিনার আরেক ভাতিজা এবং ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের মেয়র শেখ ফজলে নূর তাপস আন্দোলন চরমে ওঠার আগেই বিদেশ চলে গেছেন বলে স্থানীয় গণমাধ্যমে প্রতিবেদন প্রকাশ হয়েছে।
একইভাবে শেখ হাসিনার চাচাতো ভাই সাংসদ শেখ হেলাল ও তাঁর সাংসদ ছেলে শেখ তন্ময় এবং আরেক ভাই শেখ সালাহউদ্দিন জুয়েলেরও কোন খোঁজ নেই।
সংসদে আটকা পড়েন স্পিকার, ডেপুটি স্পিকার
জাতীয় সংসদের নিরাপত্তা শাখার এক কর্মকর্তা বেনারকে বলেন, ৫ আগস্ট যখন বিক্ষোভকারীরা গণভবন, সংসদ ভবন ও আশেপাশের ভবনে ঢুকে পড়ে তখন স্পিকার শিরীন শারমিন চৌধুরী, ডেপুটি স্পিকার শামসুল হক টুকু, হুইপ ইকবালুর রহিম, তথ্য ও যোগাযোগ প্রতিমন্ত্রী জুনায়েদ আহমেদ পলক এবং সংরক্ষিত মহিলা আসনের সদস্য নাজমা আক্তার সংসদেই ছিলেন।
বিক্ষোভকারীদের হাত থেকে রক্ষা করতে স্পিকারসহ অন্যদের প্রাণরক্ষায় সংসদ ভবনের একটি গোপনকক্ষে নিয়ে যাওয়া হয়। ভাঙচুরকারীরা ওই কক্ষে প্রবেশ করতে পারেনি।
এর বেশ কয়েক ঘণ্টা পর রাত ১০টার দিকে সংসদ ভবনে বেশ কয়েকজন সেনাসদস্যকে প্রবেশ করতে দেখেন বেনার প্রতিবেদক। সেনাসদস্যরা সংসদ ভবন থেকে অনুপ্রবেশকারীদের একে একে বের করে দেন। এর পর স্পিকারসহ আটকে পড়া অন্যরা কোথায় গেছেন সে সম্পর্কে নিশ্চিত কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি।
বিশ্লেষকদের মতে আওয়ামী লীগ নেতাদের বেশিরভাগই দেশের ভেতরে রয়েছেন। সরকারের পতন সম্পর্কে অনুমান করতে না পারায় আগে থেকে দেশের বাইরে যাবার চেষ্টা করেননি বেশিরভাগ নেতাই।
এ প্রসঙ্গে রাজনৈতিক বিশ্লেষক অধ্যাপক নিজাম উদ্দিন আহমেদ বেনারকে বলেন, “আওয়ামী লীগের মন্ত্রী, এমপি, নেতা সবার একটি বদ্ধমূল ধারণা ছিল সরকারের পতন হবে না এবং শেখ হাসিনাও পালাবেন না। তাঁদের মাথায়ও ছিল না যে, এমন কিছু হবে। সেকারণে তাঁরা পালাননি।”
তবে যারা আগে থেকে অনুমান করেছিলেন তাঁরা “টাকা-পয়সা নিয়েই চলে গেছেন,” বলে মন্তব্য করেন অধ্যাপক নিজাম।
এদিকে জাতীয় সংসদের সাবেক চিফ হুইপ আ.স.ম. ফিরোজ মঙ্গলবার বেনারকে বলেন, “যেসব ঘটনা ঘটেছে, সেগুলোর জন্য আমাদের মন খারাপ। ”
“রাস্তায় কী ঘটনা ঘটছে, কী হচ্ছে-সে ব্যাপারে সঠিক গোয়েন্দা তথ্য নেত্রীকে দেওয়া হয়নি। আবার দলের পক্ষ থেকেও মাঠের প্রকৃত চিত্র নেত্রীর কাছে পৌঁছানো হয়নি,” বলেন তিনি।