সাজাপ্রাপ্ত নোবেলজয়ী ড. ইউনূস বাংলাদেশ পরিচালনার দায়িত্বে
2024.08.06
ঢাকা
বাংলাদেশের সংকটময় পরিস্থিতিতে দেশ পুনর্গঠনের দায়িত্ব নিয়েছেন ৮৪ বছর বয়সী অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস, যিনি শান্তিতে নোবেল পুরস্কার বিজয়ী বাংলাদেশের একমাত্র ব্যক্তি।
মঙ্গলবার রাতে বঙ্গভবনে রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিনের সঙ্গে বৈঠকে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনকারীদের প্রস্তাবের পরিপ্রেক্ষিতে এই ঘোষণা আসে।
কোটি মানুষকে দারিদ্র্য থেকে বের করে আনতে সহায়তা করা মুহাম্মদ ইউনূস এবং তাঁর প্রতিষ্ঠিত গ্রামীণ ব্যাংক যৌথভাবে ২০০৬ সালে নোবেল শান্তি পুরস্কার অর্জন করে।
বিশ্বে ড. ইউনূসকে এক নামে চিনলেও গত দেড় দশক ধরে নিজ দেশেই বিভিন্ন অভিযোগে অভিযুক্ত হয়ে বিচার ও দোষী সাব্যস্ত হয়েছেন তিনি।
বারবার দাঁড়িয়েছেন আদালতের কাঠগড়ায়, কখনও ক্ষুব্ধ হয়েছেন, কখনও হয়েছেন আবেগাপ্লুত। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে তাঁর দীর্ঘ সময় কেটেছে আদালত প্রাঙ্গণে।
ঘটনার শুরু অবশ্য রাজনীতিতে তাঁর আগ্রহ দেখানোর পরেই। ড. ইউনূস শান্তিতে নোবেল জয়ের পরের বছর ২০০৭ সালে রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশে জরুরি অবস্থা জারি করা হয়।
সে সময় বন্দি হন প্রধান দুই রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপির দুই নেত্রী শেখ হাসিনা ও বেগম খালেদা জিয়া। রাজনীতি থেকে তাঁদের দূরে সরাতে ‘মাইনাস টু ফর্মুলা’ নেওয়া হয়।
এরই মধ্যে রাজনীতিতে নামতে দল গঠনের ঘোষণা দেন নোবেল বিজয় করে বিশেষ খ্যাতি পাওয়া ড. মুহাম্মদ ইউনূস। দলের নাম দেন ‘নাগরিক শক্তি’।
মাসকয়েক পরেই রাজনীতি থেকে সরে যান এই অর্থনীতিবিদ। তবে তখন থেকে আওয়ামী লীগের প্রধান শেখ হাসিনার সঙ্গে তাঁর তিক্ততা শুরু হয়, যা শেষ পর্যন্ত জেল-জরিমানার মুখোমুখি করে তাঁকে।
শেখ হাসিনার শাসনামলে গত ১৫ বছর ধরে হেনস্থার স্বীকার হয়েছেন বলে সম্প্রতি বিবিসিকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে জানান ড. ইউনূস। তিনি বলেন, সেসময় দল গঠন করতে তাঁর ওপর চাপ ছিল।
সেনাবাহিনী তাঁকে সরকার প্রধান হওয়ার দায়িত্ব নিতে আহবান জানায়। তবে তিনি রাজনীতির লোক নন জানিয়ে সে প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেছিলেন।
“আমি বলেছিলাম, নাহ আমি তো বসব না। আমি তো রাজনীতি করি না। আমি তো রাজনীতির মানুষ না,” বিবিসি বাংলাকে বলেন ড. ইউনূস।
তারপরও কখনো ভয় দেখিয়ে, কখনো উৎসাহ দিয়ে একই চাপ আসতে থাকলে এক পর্যায়ে তিনি রাজনীতিতে নামার বিষয়ে সায় দেন বলে জানান ড. ইউনূস।
পরে বিভিন্ন সময়ে ইউনূস জানান, তিনি আর কখনও রাজনীতিতে জড়াবেন না।
তবে তাঁর রাজনীতিতে নামার ঘোষণা ভালোভাবে নেননি সদ্য সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, যিনি দেশ থেকে পালিয়ে এখন ভারতে আশ্রয় নিয়েছেন।
জরুরি অবস্থা অবসানের পর ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করে। এরপর বয়সজনিত কারণ দেখিয়ে নিজের প্রতিষ্ঠিত গ্রামীণ ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালকের পদ থেকে তাঁকে সরিয়ে দেওয়া হয়।
সরকারের সেই সিদ্ধান্ত চ্যালেঞ্জ করে আদালতে গিয়ে হেরে ২০১১ সালে গ্রামীণ ব্যাংক ছাড়তে হয় ইউনূসকে। মাসকয়েক আগে ড. ইউনূসের প্রতিষ্ঠিত গ্রামীণ শক্তিসহ বেশ কয়েকটি প্রতিষ্ঠান দখল করে নেয় সরকার সমর্থকেরা।
সরকারের সঙ্গে ইউনূসের বৈরী সম্পর্ক নানা সময়ে আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও থাকছে আলোচনায়। বিশ্বের প্রভাবশালী ব্যক্তি, রাষ্ট্র ও সরকারপ্রধান, নোবেলজয়ী থেকে শুরু করে নানা প্রান্ত থেকে তাকে বিচারিক হয়রানি না করার আহ্বান জানানো হয়।
'গরিবের রক্তচোষা' বলে অভিযুক্ত করা হয় ক্ষুদ্রঋণের এই প্রবক্তাকে। এরপর বিশ্বব্যাংক দুর্নীতির অভিযোগ তুলে পদ্মা সেতুর ঋণ আটকে দিলে সেজন্য শেখ হাসিনা দায়ী করেন ড. ইউনূসকে। যদিও নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মাণ করে শেখ হাসিনা সরকার। পশ্চিমা বিশ্বের সঙ্গে সুসম্পর্ক থাকায় প্রবীণ এই অধ্যাপককে সন্দেহের চোখে দেখতেন শেখ হাসিনা।
ড. ইউনূসের বিরুদ্ধে যত মামলা
গত দেড় দশক ধরে অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস ও তাঁর প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে ১৬৮টি মামলা করা হয়। এর মধ্যে ফৌজদারি আদালতে একটি, দুর্নীতি দমন কমিশনে একটি এবং বাকি ১৬৬টি মামলা ঢাকার তৃতীয় শ্রম আদালতে বিচারাধীন ছিল।
সর্বশেষ গত ৪ আগস্ট এর রায়ে হাইকোর্ট বলেছে, জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের পাওনা হিসেবে ৬৬৬ কোটি টাকা ড. ইউনূসকে পরিশোধ করতে হবে।
প্রায় ২৬ কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগে ২০২২ সালের ৪ জুলাই গ্রামীণ টেলিকমের ৮ কর্মকর্তাসহ ১৪ জনের বিরুদ্ধে মামলাটি করে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। গত ৩ মার্চ এ মামলায় আত্মসমর্পণ করে জামিন পান ড. ইউনূস।
এ বছরের ১ জানুয়ারি শ্রম আইন লঙ্ঘনের অভিযোগে একটি ধারায় তাঁকে ছয় মাসের কারাদণ্ড দেয় ঢাকার একটি শ্রম আদালত।
রায়ের পর আদালত চত্বরে দাঁড়িয়ে ড. ইউনূস সাংবাদিকদের বলেন, “যে অপরাধ করিনি, সেই অপরাধর জন্য শাস্তি পেলাম।”
শ্রম আদালতের দেয়া ৬ মাসের কারাদণ্ডের রায় চ্যালেঞ্জ করে শ্রম আপিল ট্রাইব্যুনালে আবেদন করেন ড. ইউনূস।
মঙ্গলবার রাতে ড. ইউনূসের আইনজীবী ব্যারিস্টার আবদুল্লাহ আল মামুন বেনারনিউজকে বলেন, তার বিরুদ্ধে বাংলাদেশের আদালতে দুটি ফৌজদারি মামলা বিচারাধীন রয়েছে। একটি মামলা ছিল গ্রামীণ টেলিকমে শ্রম আইন লঙ্ঘনের অভিযোগে এবং অন্যটি দুর্নীতি দমন কমিশনের দায়ের করা অর্থ পাচারের অভিযোগে।
“শেখ হাসিনার সরকার শ্রম আদালতকে প্রভাবিত করে তাঁকে ছয় মাসের কারাদণ্ড দেয়। কিন্তু যে অভিযোগে তাঁকে দোষী সাব্যস্ত করা হয়েছিল তার কোন আইনি ভিত্তি ছিল না, সেটি ছিল রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত,” তিনি বলেন।
পেয়েছেন সব নামীদামি পুরস্কার
ড. ইউনূসের ঝুলিতে রয়েছে বিভিন্ন দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের ৬২টি সম্মানসূচক ডক্টরেট। তিনি ১০টি দেশের রাষ্ট্রীয় সম্মাননাসহ ৩৩টি দেশ থেকে ১৩৬টি সম্মাননা পেয়েছেন। ফরচুন ম্যাগাজিন তাকে ২০১২ সালে সময়ের অন্যতম শ্রেষ্ঠ উদ্যোক্তা আখ্যা দেয়।
ড. মুহাম্মদ ইউনূস ১৯৮৪ সালে এশিয়ার নোবেলখ্যাত ‘রামোন ম্যাগসাইসাই’ পুরস্কার পেয়েছিলেন।
তিনি স্থান পেয়েছেন টাইম, নিউজউইক এবং ফোর্বসের মতো আন্তর্জাতিক ম্যাগাজিনের কভারে।
নোবেল শান্তি পুরস্কার ছাড়াও ইউনাইটেড স্টেটস প্রেসিডেন্সিয়াল মেডেল অফ ফ্রিডম এবং ইউনাইটেড স্টেটস কংগ্রেশনাল গোল্ড মেডেল পাওয়া ইতিহাসের মাত্র সাতজনের মধ্যে ড. ইউনূস অন্যতম।
বিশ্বের ৩৯টি দেশের ১০৭টি বিশ্ববিদ্যালয়ে সামাজিক ব্যবসাকেন্দ্রিক বিভাগ, সেন্টার বা অ্যাকাডেমিক কার্যক্রম আছে, যেগুলোকে সম্মিলিতভাবে ইউনুস সোশ্যাল বিজনেস সেন্টার বলা হয়।
২০২৩ সালের ২৩ নভেম্বর অধ্যাপক ইউনূসকে রাশিয়ার ফিন্যান্সিয়াল ইউনিভার্সিটির আন্তর্জাতিক উপদেষ্টা বোর্ডের চেয়ারম্যান হওয়ার জন্য আমন্ত্রণ জানানো হয়।
টোকিও অলিম্পিকে ড. ইউনূসকে 'অলিম্পিক লরেল' সম্মাননা দেয় ইন্টারন্যাশনাল অলিম্পিক কমিটি।
সৌদি আরবে অনুষ্ঠিত ওয়ার্ল্ড ফুটবল সামিটে আজীবন সম্মাননা পুরস্কার দেওয়া হয় এই অর্থনীতিবিদকে।
এছাড়াও, তিনি জাতিসংঘ এবং বেসরকারি বৈশ্বিক ফাউন্ডেশনসহ প্রায় সব বহুপাক্ষিক সংস্থার উপদেষ্টা পর্যায়ে কাজ করেছেন। এর বাইরেও তিনি বেশকিছু ইউরোপীয় দেশের রাজকীয় সম্মাননা পেয়েছেন।
লেখাপড়া
১৯৫৭ সালে মুহাম্মদ ইউনূস ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থনীতি বিভাগের সম্মান শ্রেণীতে ভর্তি হন এবং সেখান থেকেই বিএ এবং এমএ সম্পন্ন করেন ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পি.এইচ.ডি করেন। এরপর তিনি ব্যুরো অব ইকোনমিক্স -এ গবেষণা সহকারী হিসাবে যোগদান করেন।
১৯৬২ সালে চট্টগ্রাম কলেজে প্রভাষক পদে যোগদান করেন। ১৯৬৫ সালে তিনি ফুলব্রাইট স্কলারশিপ নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রে যান এবং পূর্ণ বৃত্তি নিয়ে ভেন্ডারবিল্ট বিশ্ববিদ্যালয়, যুক্তরাষ্ট্র থেকে ১৯৬৯ সালে অর্থনীতিতে পিএইচডি লাভ করেন।
ইউনূস বাংলাদেশে ফিরে আসার আগে ১৯৬৯ থেকে ১৯৭২ সাল পর্যন্ত মিডল টেনেসি স্টেট ইউনিভার্সিটিতে শিক্ষকতা করেন।
১৯৭২ সালে দেশে ফিরে তিনি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থনীতি বিভাগে যোগ দেন, ১৯৮৯ সাল পর্যন্ত অধ্যাপনা করেন।
১৯৭৪ সালে বাংলাদেশে দুর্ভিক্ষের সময় তিনি বুঝতে পারেন স্বল্প পরিমাণে ঋণ দরিদ্র মানুষের জীবন মান উন্নয়নে অত্যন্ত কার্যকরী হতে পারে।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনাকালে তিনি ১৯৭৬-১৯৮৩ সাল পর্যন্ত গ্রামীণ ব্যাংকের প্রকল্প পরিচালক ছিলেন। চট্টগ্রামের জোবরা গ্রামে প্রকল্পটি চালু করা হয়।
ড. ইউনূস বিশ্বাস করতেন যে গরিবদের ব্যাংকিং সুবিধা দেওয়া হলে টাকা শোধ হবে।
“গ্রামীণ ব্যাংকের প্রকল্পের মাধ্যমে ড. ইউনূস প্রমাণ করেছেন যে গরিব মানুষ ঋণ দিলে তারা শোধ করে। তারা খেলাপি হয় না, এটি একটি ঐতিহ্যগত বিশ্বাস,” বেনারনিউজকে বলেন, অধ্যাপক ইউনূসের চাচাতো ভাই এবং বন-নির্ভর মানুষের দারিদ্র্য দূরীকরণে গঠিত আরণ্যক ফাউন্ডেশনের সাবেক নির্বাহী পরিচালক ফরিদ উদ্দিন আহমেদ।
তিনি বলেন, ড. ইউনূস বলতে চেয়েছেন, ঋণ পাওয়া মানুষের অধিকার। নারীদের কেন্দ্র করে ক্ষুদ্রঋণ প্রসারে তার যে কর্মপদ্ধতি, 'সহায়হীন নারীদের' দিয়ে দারিদ্র্যের বিরুদ্ধে যে লড়াই, তা অসংখ্য সামাজিক বিধিনিষেধ ও প্রাচীন কুসংস্কার ভেঙে দিয়েছে।
‘বাংলাদেশ সেরা নেতৃত্ব পেয়েছে’
শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রী পদ ছেড়ে দেশ থেকে পালিয়ে যাওয়ার পর সংকটে পড়া দেশ রক্ষায় এগিয়ে আসতে তিনি রাজি হয়েছেন।
“অধ্যাপক মোহাম্মদ ইউনূস এখন বিদেশে অবস্থান করছেন। তিনি আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের অন্তর্বর্তী সরকারের নেতৃত্ব দেওয়ার প্রস্তাব গ্রহণ করেছেন,” মঙ্গলবার ইউনূস সেন্টারের মুখপাত্র লামিয়া মোরশেদ একটি স্থানীয় গণমাধ্যমকে জানিয়েছেন।
ড. ইউনূসের আইনজীবী ব্যারিস্টার আবদুল্লাহ আল মামুন বেনারকে বলেন, “এই সংকটময় সময়ে বাংলাদেশ সেরা নেতৃত্ব পেয়েছে। শেখ হাসিনার শাসনামলে বর্তমান রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক অস্থিরতা থেকে উত্তরণের জন্য দেশকে নেতৃত্ব দেওয়ার জন্য তিনিই সেরা ব্যক্তি।”