কোটা সংস্কার আন্দোলন ঘিরে সহিংসতা: মরদেহ পেতে স্বজনদের দুর্বিষহ অভিজ্ঞতা
2024.07.24
ঢাকা
মুখটা ঢেকে রাখা। চাদরের ফাঁক দিয়ে ছোট্ট পা দুটো বেরিয়ে এসেছে। গত শুক্রবার বিকেলেও এই চঞ্চল দুটি পায়ে বাড়ির ছাদে দুরন্তপনায় মেতেছিল ছয় বছরের রিয়া গোপ।
বুধবার বিকেলে তার নিথর দেহ পড়েছিল ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালের মর্গের বারান্দায়। সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কারের আন্দোলন ঘিরে সৃষ্ট সহিংসতায় ঝরে যাওয়া হতভাগাদের একজন এই ছোট্ট রিয়া।
ঢাকার একাধিক গণমাধ্যমে প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী চার দিনের সহিংসতায় প্রায় ২০০ মানুষ নিহত হয়েছেন। বুধবার চিকিৎসাধীন অবস্থায় রিয়াসহ মারা গেছেন দুইজন। যদিও সরকারের পক্ষ থেকে বুধবার পর্যন্ত হতাহতের সংখ্যা প্রকাশ করা হয়নি।
গত শুক্রবার বিকেলে নারায়ণগঞ্জে বাড়ির ছাদে খেলতে গিয়ে মাথায় বুলেটবিদ্ধ হয় রিয়া। তাকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে আনা হয়। বুধবার সকাল সাড়ে ১০টার দিকে রিয়াকে মৃত ঘোষণা করেন চিকিৎসক।
যন্ত্রণাদায়ক মৃত্যুর পর একমাত্র কন্যা সন্তানের মরদেহটি দ্রুত সৎকারের জন্য নিতে চেয়েও পারেননি দীপক কুমার গোপ। হাসপাতালের নানা আনুষ্ঠানিকতা শেষ করতে দুর্বিষহ এক অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে যেতে হয় তাঁকে।
শিশু সন্তানকে মর্গে ফেলে রেখে সাধারণ ডায়েরি করাসহ নানা দাপ্তরিক কাজ সারলেন বাবা। কিন্তু নারী পুলিশ কর্মকর্তার অভাবে সুরতহাল প্রতিবেদন করতে ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষা করতে হয় তাঁকে। সব শেষে সন্ধ্যার দিকে মেয়ের রিয়ার মরদেহ বুঝে পান তিনি।
"বিনা অপরাধে আমার শিশু সন্তান খুন হলো। মুহূর্তের মধ্যে একটি গুলি ওর মাথা এফোঁড় ওফোঁড় করে দিলো। একমাত্র বাচ্চাকে আমি হারালাম। সেই শোক করব নাকি মর্গের এই যন্ত্রণা পোহাব?,” বেনারকে বলেন দীপক কুমার।
থানায় থানায় ঠেলাঠেলি
বুধবার মর্গের সামনে বসেই আর্তনাদ করছিলেন সংঘর্ষের ঘটনায় গুলিতে নিহত মো. শাহজাহানের (২১) মা হাজেরা বেগম।
পরিবারের সদস্যরা জানান, মঙ্গলবার রাত ১২টার দিকে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ঢামেকে মৃত্যু হয় শাহজাহানের। তারপর থেকে শুরু হয় পরিবারের নতুন ভোগান্তি। ময়না তদন্ত শুরু করতে পুলিশ ক্লিয়ারেন্স সংগ্রহের জন্য তাঁদের বনানী থানায় পাঠানো হয়।
কিন্তু গুলিবিদ্ধ হওয়ার স্থান রাজধানীর মহাখালী কাঁচাবাজার এলাকা বনানী থানার আওতায় নয় জানিয়ে তারা শাহজাহানের পরিবারকে তেজগাঁও থানায় পাঠায়। ওই থানা তাদের আবার বনানী থানায় পাঠায়। এভাবে কয়েক দফা দুই থানায় হাঁটাহাঁটির পরে শাহজাহানের স্বজনেরা ঢামেকে ফিরে আসেন।
নিহতের সৎ ভাই বদরুল আমিন বুধবার রাতে বেনারকে বলেন, "শাহজাহানের যেন মরেও শান্তি নেই। বুধবার সারাদিনে দুই থানার ঝামেলা শেষ হয়নি। পুলিশ আমাদের কাগজপত্র নিয়ে গেছে। বৃহস্পতিবার সকালে আবার যাব ময়না তদন্তের আশায়।"
তবে এই ধরনের কাগজপত্র যোগাড় করার দায়িত্ব পরিবারের নয়, বরং তা হাসপাতাল ও পুলিশের দায়িত্ব বলে বেনারকে জানান মানবাধিকার সংস্থা আইন ও সালিশ কেন্দ্রের সিনিয়র কোঅর্ডিনেটর আবু আহমেদ ফয়জুল কবীর।
“এমনিতেই এই পরিবারগুলোর অপূরণীয় ক্ষতি হয়েছে,” মন্তব্য করে তিনি বলেন, “তাদের এ ধরনের ভোগান্তিতে পড়া ভীষণ অনাকাঙ্ক্ষিত ও অগ্রহণযোগ্য।”
পরপর তিন দিন সরেজমিনে দেখা যায়, ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল মর্গ থেকে স্বজনের মরদেহ পেতে এভাবেই ভুগতে হচ্ছে অনেক পরিবারকে। থানা-পুলিশ, হাসপাতাল ও মর্গে আসা-যাওয়ার দৌড়ে স্বজন হারানোর শোক প্রকাশেরও যেন ফুসরত নেই তাঁদের।
লাশ পেতে এসব ভোগান্তির বিষয়ে শাহবাগ থানার অফিসার ইনচার্জ শাহ আলম বেনারকে বলেন, "আইনি বিষয়গুলো অত্যন্ত স্পর্শকাতর। আইনি প্রক্রিয়ার প্রতিটি ধাপ সঠিকভাবে পালন করতে হয়। এক্ষেত্রে কিছুটা সময় লাগে। তবে আমরা চেষ্টা করছি যাতে মানবিকভাবে কাজগুলো করতে পারি।"
স্বাভাবিক হতে শুরু করেছে জনজীবন
এক সপ্তাহের নজিরবিহীন অস্থিরতার পর স্বাভাবিক হচ্ছে বাংলাদেশের জনজীবন। সীমিত সময়ের জন্য খুলেছে অফিস আদালত, ব্যাংক-বীমা ও কল-কারখানা।
তবে দেশজুড়ে এখনো বলবৎ আছে কারফিউ, যা সময়ে সময়ে শিথিল করা হচ্ছে। এরই মধ্যে বুধবার কাজের প্রয়োজনে বাইরে বেরিয়েছিলেন বিপুল সংখ্যক মানুষ।
গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা, বাণিজ্যিক কার্যক্রম ও গণমাধ্যমের জন্য পাঁচদিন পর মঙ্গলবার রাত থেকে ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট সংযোগ আংশিকভাবে চালু করা হলেও তা অত্যন্ত ধীর গতির হওয়ায় প্রকৃত অর্থে ব্যবহারযোগ্য হয়নি। মোবাইল ইন্টারনেট এখনও বন্ধ রয়েছে। ব্যবহারকারীরা ফেসবুক, হোয়াটসঅ্যাপসহ বিভিন্ন সোশ্যাল মিডিয়া সাইটে ঢুকতে পাচ্ছেন না।
বুধবার রাত থেকে বাসা বাড়িতেও ব্রডব্যান্ড সংযোগ চালু করার কথা রয়েছে। মোবাইল ইন্টারনেট কবে থেকে চালু হবে এখনো তা বলা হয়নি। পর্যাপ্ত নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিশ্চিত না হওয়া পর্যন্ত কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়গুলো খুলতে রাজি নয় সরকার।
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান বলেছেন, পরিস্থিতি সামাল দেয়ার জন্য কারফিউ দেয়া হয়েছে; আগামী কয়েকদিনের মধ্যেই সবকিছু নিয়ন্ত্রণের মধ্যে চলে আসবে।
ধরপাকড় অব্যাহত
প্রধান বিরোধী দল বিএনপি বুধবার দাবি করেছে, শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভের পর কয়েক দিনে বিএনপিসহ বিরোধী দলের অন্তত দুই হাজার নেতাকর্মীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।
ঢাকায় এক সংবাদ সম্মেলনে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, “সরকার যেভাবে কোটা সংস্কার আন্দোলনকারীদের ওপর দমন-পীড়ন করেছে, ইন্টারনেট বন্ধ করে দিয়েছে এবং কারফিউ জারি করেছে, তার প্রকৃত তথ্য আমরা পাচ্ছি না।”
তিনি বলেন, “আহত ও নিহতদের প্রকৃত তথ্য না দিয়ে সরকার এখন পর্যন্ত যা বলছে তা বিভ্রান্তিকর।”
তিনি অবিলম্বে কারফিউ প্রত্যাহারের দাবি জানান।
ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) কমিশনার খন্দকার গোলাম ফারুক বেনারকে বলেন, কোটা আন্দোলনকে কেন্দ্র করে সংঘর্ষ ও সহিংসতার ঘটনায় ঢাকায় ৭৩টি মামলা দায়ের করা হয়েছে এবং ঢাকায় মঙ্গলবার পর্যন্ত এসব মামলায় মোট ১ হাজার ৭৫৮ জনকে গ্রেপ্তার করেছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী।
ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের তথ্য অনুযায়ী, আন্দোলনকে ঘিরে সংঘাত ও সহিংসতায় গত সাত দিনে সারাদেশে ১১৩টি অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটেছে। এর মধ্যে ঢাকায় অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটেছে ৯০টি।