ব্লক রেইডে আতঙ্ক, আন্দোলনকারীদের তিন শীর্ষ সংগঠক আটক

সপ্তাহব্যাপী রক্তক্ষয়ী সহিংসতার পর আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলো ঢাকার বিভিন্ন স্থানে ‘ব্লক রেইড’ দিয়ে ব্যাপকমাত্রায় গ্রেপ্তার অভিযান চালানোর ফলে মানুষের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে।

কেন্দ্রীয়ভাবে পুলিশ গ্রেপ্তারের বিষয়ে কোনও তথ্য না দিলেও বিভিন্ন জেলা থেকে প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে দৈনিক প্রথম আলো জানিয়েছে, সারা দেশে দায়ের হওয়া পাঁচ শতাধিক মামলায় বৃহস্পতিবার পর্যন্ত প্রায় সাড়ে পাঁচ হাজার মানুষকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে, যাদের বেশিরভাগই বিরোধী দল বিএনপি’র নেতা-কর্মী।

ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের যুগ্ম কমিশনার বিপ্লব কুমার সরকার শুক্রবার সাংবাদিকদের জানিয়েছেন, এদিন বিকেল পর্যন্ত শুধু ঢাকা মহানগরে ২০৯টি মামলায় ২ হাজার ৩৫৭ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।

তিনি তার কার্যালয়ে সাংবাদিকদের বলেন, “সিসি ক্যামেরার ফুটেজ, অন্যান্য তথ্য-প্রমাণ এবং গোয়েন্দা সংস্থার দেওয়া তথ্য বিশ্লেষণ করে, যারা ভাঙচুরের সঙ্গে জড়িত তাঁদের গ্রেপ্তার করছে পুলিশ।”

কোটা আন্দোলনের তিন সংগঠক আটক

কোটাবিরোধী আন্দোলনের প্ল্যাটফর্ম বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অন্তত তিনজন শীর্ষস্থানীয় সংগঠককে ঢাকার একটি হাসপাতাল থেকে ডিএমপির গোয়েন্দা শাখার সদস্যরা তুলে নিয়ে গেছেন বলে অভিযোগ উঠেছে।

বিষয়টি নিশ্চিত করে কোটা বিরোধী আন্দোলনের সমন্বয়কারী সারজিস আলম বেনারকে বলেন, “গণস্বাস্থ্য নগর হাসপাতাল থেকে ডিবি পুলিশ তাঁদের তুলে নিয়ে গেছে যেখানে তারা চিকিৎসাধীন ছিলেন।”

এই তিন সংগঠক হলেন; নাহিদ ইসলাম, আসিফ মাহমুদ ও আবু বাকের মজুমদার।

এদের মধ্যে নাহিদ ও আসিফ সম্প্রতি নিখোঁজ হওয়ার পর আহত অবস্থায় উদ্ধার হন। ঢাকার ধানমন্ডি এলাকায় গণস্বাস্থ্য নগর হাসপাতাল চিকিৎসাধীন ছিলেন তারা।

আসিফকে সহযোগিতার জন্য হাসপাতালে ছিলেন আবু বাকের।

সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কারের দাবিতে শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভে নেতৃত্বদানকারীদের মধ্যে তাঁরা ছিলেন।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে শুক্রবার সন্ধ্যায় ডিএমপির গোয়েন্দা শাখার প্রধান হারুন অর রশিদ বেনারকে বলেন, এমন খবর তিনিও শুনেছেন এবং তথ্য পাওয়ার ভিত্তিতে তিনি বিষয়টি পরে জানবেন। পরে অবশ্য ফোনে তাকে পাওয়া যায়নি।

নাহিদ, আসিফ ও আবু বাকের—তিনজনই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী।

নাহিদকে তুলে নেওয়ার বিষয়টি জানতে পেরে তাঁর স্ত্রী ফাতিমা তাসনীম অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। তিনি এখন ওই হাসপাতালে চিকিৎসাধীন।

প্রথম আলোকে দেওয়া বক্তব্যে ফাতিমা তাসনীম বলেন, “ওই ব্যক্তিরা আসিফ ও বাকেরকে নিয়ে যাওয়ার জন্য টানাহেঁচড়া শুরু করলে আমি ও হাসপাতালের নার্সরা তাঁদের বলি, রোগীদের ডিসচার্জ করা হয়নি। তখন ওই ব্যক্তিরা নার্সদের ইনচার্জকে বলেন, ‘আমাদের চেনেন? কাউন্টার টেররিজম সম্পর্কে আপনাদের ধারণা আছে?’ এরপর কোনো কথা না শুনে তাঁরা আসিফ ও বাকেরকে নিয়ে যান। দুজনের মুঠোফোনও নিয়ে যান। এরপর জানতে পারি, নাহিদকেও তুলে নেওয়া হয়েছে।”

04.JPG
গত কয়েক দিনে রাজধানীতে সহিংসতায় নাশকতাকে কেন্দ্র করে গ্রেপ্তারের ভয়ে নেতা-কর্মী শূন্য ও তালাবদ্ধ ঢাকার নয়াপল্টনের বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়। ২৬ জুলাই ২০২৪। [বেনারনিউজ]

আতঙ্কিত মানুষ

বৃহস্পতিবার মধ্যরাতে এবং শুক্রবার ভোরে রাতে ব্লক রেইডের ঘটনা দেখেছেন এমন অন্তত ১০জন ব্যক্তি বেনারের সঙ্গে তাদের অভিজ্ঞতা শেয়ার করেছেন। বেনারের একজন সংবাদদাতা শুক্রবার সকালে এমন কিছু এলাকা সরেজমিন পরিদর্শন করেছেন।

মধ্যরাতে ঢাকার শাহীনবাগ ও আরজাতপাড়া এলাকায় নিরাপত্তা বাহিনীর যৌথ অভিযান চালানো হয়।

স্থানীয়রা জানান, অভিযানের সময় এসব এলাকায় বিদ্যুৎ সংযোগ বন্ধ ছিল এবং মাইক ব্যবহার করে স্থানীয় লোকজনকে অভিযান শুরুর আগ মুহূর্তে দ্রুত দোকানপাট বন্ধ করে বাড়িতে প্রবেশ করতে বলা হয়।

ঘরের দরজা-জানালা বন্ধ রাখার নির্দেশ দেওয়া হয় বলেও জানান তারা।

শুক্রবার সকালে কিছু দোকান খোলা থাকলেও জরুরি প্রয়োজন ছাড়া কেউ ঘর থেকে বের হননি। যদিও শুক্রবার সকাল আটটা থেকে বিকাল ৫ টা পর্যন্ত কারফিউ শিথিল ছিল।

আরজতপাড়ার একটি স্টোরের দোকানি সালেহা বেগম বেনারকে বলেন, “রাত নয়টার দিকে যৌথবাহিনী এসে হুংকার দিয়ে দোকান বন্ধ করতে বলে। তারপর শুরু হয় তাদের অভিযান। এলাকার রাস্তাঘাট ছিল তাদের দখলে। আগেই বিদ্যুৎ বন্ধ করে দেওয়া হয়। যারা ঘরে বিকল্প বাতি জ্বালানোর চেষ্টা করে, তাদের বাতি বন্ধ রাখতে বলা হয়।”

ভীতিকর সেই পরিস্থিতি উল্লেখ করে তিনি বলেন, “শুনেছি বিভিন্ন বাড়ি থেকে ছেলেদের ধরে নিয়ে গেছে। পরিস্থিতি এমন যে, যার ঘরে উঠতি বয়সের ছেলে আছে সেই আতঙ্কে দিন কাটাচ্ছে।”

একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র শরফুদ্দিন আহমদ বেনারকে বলেন, “গত কয়েকদিন ধরে দেশের যা পরিস্থিতি তাতে কেউ ভালো নেই আমরা। এর মধ্যে গতকাল এই এলাকায় যেভাবে যৌথবাহিনী অভিযান চালিয়েছে, তাতে মনে হলো যুদ্ধ পরিস্থিতির মধ্যে আছি।”

এদিকে পুলিশ আতঙ্কে এলাকা ছেড়েছেন সাম্প্রতিক সহিংসতার ঘটনায় নিহতদের পরিবারের অনেকেই।

গত শুক্রবারের সহিংসতায় মহাখালী এলাকায় প্রাণ হারান মো. জাহিদ হোসেন (১৮) নামের একজন ফুল বিক্রেতা।

আরজতপাড়ার পাগলার মোড় এলাকায় চারতলা ভবনের একটি ছোট্ট ফ্লাটে ভাড়া থাকতেন তাঁরা। ফ্ল্যাটটির দরজায় তালা ঝুলছে।

ভবনের ম্যানেজার আউয়াল হোসেন বেনারকে জানান, গুলিতে নিহত জাহিদের মরদেহ স্থানীয় একটি কবরস্থানে তাড়াহুড়া করে দাফন করা হয়। দু’একদিন আগে তারা হঠাৎ কোথায় যেন চলে গেছে।

Ctg _Curfew Photo6.jpg
কারফিউ শিথিল থাকাকালীন চট্টগ্রামের নগরীর কাজির দেউড়ি মোড়ে সেনাবাহিনীর পাহারা। ২৬ জুলাই ২০২৪। [বেনারনিউজ] (Saikat Bhadra/Saikat Bhadra)

চলছে ব্যাপক গ্রেপ্তার

গত কয়েকদিনে বিভিন্ন থানা ও আদালতের সামনে পরিবারের সদস্যদের জন্য অপেক্ষা করা একটি নিয়মিত দৃশ্যে পরিণত হয়েছে। অপেক্ষমাণ স্বজনরা বলছেন, প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদেরও তুলে নিয়ে যাওয়ার ঘটনা ঘটছে।

এক বিবৃতিতে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর শুক্রবার বলেছেন, গণহারে আটক ও নির্যাতনের ঘটনা ঘটছে।

“গ্রেপ্তারকৃত ব্যক্তিদের লুকিয়ে রাখা হয়, নির্যাতন করা হয় এবং তিন থেকে চার দিন বা পাঁচ দিন পর আদালতে হাজির করা হয়, যা আইন ও মানবাধিকারের চরম লঙ্ঘন,” বলেন তিনি।

আদালত থেকে প্রাপ্ত তথ্যে জানা গেছে, ঢাকার মুখ্য মহানগর আদালত শুক্রবার বিএনপি, জামায়াতে ইসলামী ও গণঅধিকার পরিষদের বেশ কয়েকজন নেতাসহ ৪০০ জনকে কারাগারে প্রেরণ করেছে এবং একজন সাংবাদিকসহ বেশ কয়েকজনকে পুলিশ রিমান্ডে রাখা হয়েছে।

সাঈদ খান নামের ওই সাংবাদিক একজন প্রবাসী বাংলাদেশি পরিচালিত জার্মানি ভিত্তিক দ্য মিরর এশিয়ার সংবাদদাতা ও বিএনপিপন্থী বলে পরিচিত ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়নের (ডিইউজে) সাংগঠনিক সম্পাদক।

ডিইউজে সাধারণ সম্পাদক খুরশীদ আলম বেনারকে বলেন, গভীর রাতে সাঈদকে তার মগবাজারের বাসা থেকে ডিবি তুলে নিয়ে যায় এবং পরে নাশকতার মামলায় তাকে পাঁচ দিনের রিমান্ডে নেয়।

জাতিসংঘের বিশেষজ্ঞদের আহ্বান

জাতিসংঘের বিশেষজ্ঞরা শুক্রবার বাংলাদেশ সরকারকে অবিলম্বে বিক্ষোভকারী ও রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে সহিংস দমন-পীড়ন বন্ধ করতে, ইন্টারনেট ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সম্পূর্ণরূপে অ্যাক্সেস ফিরিয়ে আনা এবং মানবাধিকার লঙ্ঘনের জন্য জবাবদিহিতা নিশ্চিত করার আহ্বান জানিয়েছেন।

বিশেষজ্ঞরা এক বিবৃতিতে বলেছেন, “বিপুল সংখ্যক বেআইনি হত্যা, সম্ভাব্য জোরপূর্বক গুম, নির্যাতন এবং হাজার হাজার লোককে আটকের কারণে আমরা উদ্বিগ্ন।”