নজিরবিহীনভাবে টানা ১২ দিন ট্রেন বন্ধ
2024.07.29
কোটা সংস্কার আন্দোলনের সহিংসতাকে কেন্দ্র করে গত ১২ দিন ধরে নজিরবিহীনভাবে দেশে ট্রেন চলাচল বন্ধ রেখেছে সরকার।
সারাদেশে সরকারি চাকরিতে সংরক্ষিত কোটা সংস্কারের দাবিতে ছাত্রদের আন্দোলন সহিংস রূপ নেওয়ায় ১৮ জুলাই দুপুর থেকে সকল যাত্রীবাহী ট্রেন চলাচল বন্ধ করে দেয় বাংলাদেশ রেলওয়ে। ফলে যোগাযোগের ক্ষেত্রে দেখা দিয়েছে বিপত্তি। বেড়েছে দেশের নিম্ন আয়ের মানুষের দুর্ভোগ, যানজট ও দূষণ।
এদিকে পরিস্থিতি স্বাভাবিক না হওয়া পর্যন্ত ট্রেন চালু করা হবে না বলে সোমবার বেনারকে জানিয়েছেন রেলমন্ত্রী জিল্লুল হাকিম।
বাংলাদেশ রেলওয়ের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা ও যাত্রীরা জানান, দেশের ইতিহাসে দুই ঈদ ছাড়া কোনো আন্দোলন, হরতাল বা অবরোধে ট্রেন বন্ধ থাকেনি। এই প্রথমবারের মতো সহিংসতার কারণে ট্রেন বন্ধ রয়েছে।
কেন ট্রেন বন্ধ করা হলো-এমন প্রশ্নের জবাবে জিল্লুল হাকিম বেনারকে বলেন, “রেলের ওপর আক্রমণ শুরু হওয়ায় সকল ট্রেন চলাচল বন্ধ রাখার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। যতদিন পরিস্থিতি স্বাভাবিক না হবে, ততদিন ট্রেন চলবে না।”
“মানুষের অসুবিধা হচ্ছে বুঝি। কিন্তু আমি জেনেশুনে ট্রেন ও মানুষকে সন্ত্রাসী, জঙ্গিদের হাতে তুলে দিতে পারি না,” বলেন মন্ত্রী।
তিনি বলেন, “ট্রেন তো সহজ টার্গেট। ট্রেনের একটি ইঞ্জিনের দাম ৫০ কোটি টাকা। একটি ট্রেন পোড়ালে ১৫০ কোটি টাকা ক্ষতি হয়। এভাবে রাষ্ট্রীয় সম্পদ ধ্বংস মেনে নেওয়া যায় না।”
ট্রেন কেন বন্ধ ‘বোধগম্য নয়’
বাংলাদেশের পরিবহন ব্যবস্থা বাস-ট্রাকভিত্তিক হলেও আরামদায়ক, সাশ্রয়ী এবং নিরাপদে বেশি যাত্রী পরিবহনে রেলওয়ের ভূমিকা অনেক। বিশেষ করে নিম্ন আয়ের মানুষের কাছে কম খরচের বাহন ট্রেন অনেক জনপ্রিয় মাধ্যম।
ট্রেনে চড়ে গাজীপুর থেকে ঢাকার মতিঝিল এলাকায় নিয়মিত অফিসে আসা-যাওয়া করেন আশরাফুল আলম। ট্রেন বন্ধ থাকায় তিনিসহ হাজার হাজার মানুষ বিপদে পড়েছেন।
তিনি সোমবার বেনারকে বলেন, জয়দেবপুর স্টেশন থেকে প্রত্যেক কর্মদিবসে হাজার হাজার মানুষ ঢাকায় অফিস করাসহ বিভিন্ন কাজে যান। ঢাকা থেকে ময়মনসিংহ এবং উত্তরাঞ্চলে চলাচলকারী সকল ট্রেন জয়দেবপুরে থামে।
জয়দেবপুর থেকে ট্রেনে ঢাকা যেতে এক ঘণ্টার কিছু বেশি সময় লাগে এবং আন্তঃনগর ট্রেনে ৫০ টাকা ও মেইল ট্রেনে ২০ টাকা ভাড়া বলে জানান আশরাফুল আলম।
গত ১০-১২ দিন ধরে ট্রেন চলাচল বন্ধ থাকায় গাজীপুর অঞ্চলের মানুষের মারাত্মক কষ্ট হচ্ছে জানিয়ে তিনি বলেন, “এখন বাসে যেতে হয়। আর বাসে বসে কখন পৌঁছাবেন, তার ঠিক নেই। কমপক্ষে তিন ঘণ্টা। কখনও চার ঘণ্টাও লেগে যায়। ভাড়া ১২০ টাকা।”
তিনি জানান, ট্রেনের হাজার হাজার যাত্রী এখন বাধ্য হয়ে বেশি ভাড়া দিয়ে এবং দীর্ঘ সময় ব্যয় করে বাসে চলাচল করছেন।
“সবচেয়ে বেশি সমস্যা মহিলাদের। যারা ট্রেনে চড়ে চলাচল করতেন, তাঁদের এখন বাসে ঠেলাঠেলি করে চলতে হয়,” বলেন তিনি।
তিনি বলেন, “সকল আন্দোলন-সংগ্রাম, সহিংসতার মধ্যেও ট্রেন বন্ধ হয়নি। ২০১৪ ও ২০১৫ সালে সরকার বিরোধীরা ট্রেনের লাইন উপড়ে ফেলার সময়ও ট্রেন বন্ধ হয়নি। কিন্তু এখন কেন ট্রেন বন্ধ সেটি বোধগম্য নয়।”
মানুষের সুবিধার কথা চিন্তা করে অবিলম্বে ট্রেন চলাচল শুরু করা উচিত বলে মনে করেন তিনি।
নরসিংদী থেকে মেইল ট্রেনে করে ঢাকার আগারগাঁ এলাকায় অফিস করেন মোখলেসুর রহমান। ট্রেন বন্ধ থাকায় তিনি বিপদে পড়েছেন।
ট্রেনে একবার উঠতে পারলে “আগে-পিছে হলেও যাওয়া যায়। যানজট নেই। খুবই সুবিধা হয়,” মন্তব্য করে সোমবার তিনি বেনারকে বলেন, “বাস-ট্রাক ধর্মঘট করলে, হরতাল ডাকলে আমরা ট্রেন স্টেশনে চলে যাই। এবারই দেখলাম আন্দোলনের জন্য ট্রেন বন্ধ।”
বাংলাদেশ রেলওয়ের তথ্য অনুযায়ী সারাদেশে কমপক্ষে ২৪৯টি ট্রেন চলাচল করে। এর মধ্যে সর্বোচ্চ ২৫টি ট্রেন মালামাল পরিবহনের কাজে ব্যবহৃত হয়, বাকিগুলো যাত্রীবাহী।
গত বছর বাংলাদেশ রেলওয়ে প্রায় সাড়ে চার কোটি যাত্রী বহন করেছে। সেই হিসাবে, গড়ে প্রতিদিন এক লাখ ২৩ হাজারের বেশি মানুষ ট্রেনে ভ্রমণ করেন।
বছরে কেবলমাত্র ঈদের দুই দিন ট্রেন বন্ধ থাকে। এছাড়া সারাবছর ট্রেন চলাচল করে।
রেলওয়ের মহাপরিচালক সরদার সাহাদাত আলী সোমবার বেনারকে বলেন, “আমরাও চাই যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ট্রেন চালাতে। শিথিল আকারে হলেও দেশে কারফিউ চলছে। এই অবস্থায় আমরা ট্রেন চালাব কীভাবে?”
তিনি বলেন, “এছাড়াও যাত্রী, রাষ্ট্রীয় ও ব্যক্তিগত সম্পদের নিরাপত্তার বিষয়টি আমাদের মাথায় রাখতে হয়। পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে, কারফিউ উঠে গেলে ট্রেন চালু করা হবে।”
তবে যাত্রীবাহী ট্রেন পরিচালনা না করলেও রোববার থেকে চট্টগ্রাম বন্দর থেকে সীমিত পরিসরে বাংলাদেশে রেলওয়ে পণ্যবাহী কন্টেইনার পরিবহন শুরু করেছে বলে সোমবার বেনারকে জানিয়েছেন চট্টগ্রাম বন্দরের পরিচালক (ট্রাফিক) এনামুল করিম।