বিশ্লেষকদের মতে, জামায়াতকে নিষিদ্ধ করে সরকার ভিন্ন দিকে দৃষ্টি ঘোরাতে চায়

রাজনৈতিক দল হিসাবে এক দশকের বেশি সময় আগে নির্বাচন কমিশনে নিবন্ধন বাতিল হওয়া বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার।

কোটা সংস্কার আন্দোলনকে কেন্দ্র করে সহিংসতা ও হতাহতের ঘটনায় বেকায়দায় পড়া সরকার এই সিদ্ধান্তের মাধ্যমে মানুষের দৃষ্টি ভিন্নদিকে প্রবাহিত করতে চায় বলে মনে করেছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকেরা।

বাংলাদেশের সন্ত্রাসবিরোধী আইনের আওতায় জামায়াতকে নিষিদ্ধ করতে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে চিঠি দেওয়া হয়েছে বলে বুধবার বেনারকে জানান আইনমন্ত্রী আনিসুল হক। বুধবার রাতের মধ্যেই জামায়াত নিষিদ্ধের গেজেট প্রকাশ করা হবে বলেও জানান তিনি।

এদিকে আইন মন্ত্রণালয়ের চিঠি প্রাপ্তির বিষয়টি স্বীকার করে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান বুধবার সন্ধ্যায় সাংবাদিকদের বলেছেন, জামায়াত ও এর ছাত্র সংগঠন শিবিরকে নিষিদ্ধ করার প্রক্রিয়া চলছে। প্রক্রিয়াটি শেষ হলে যেকোনো সময় ঘোষণা দেয়া হবে।

তবে বাংলাদেশ সময় বুধবার দিবাগত রাত একটা পর্যন্ত এ বিষয়ে কোনো প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়নি।

সোমবার রাতে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন ১৪ দলীয় ফোরামের বৈঠকে জামায়াতকে নিষিদ্ধ করার ব্যাপারে ঐকমত্য পোষণ করে সিদ্ধান্ত গ্রহণের প্রেক্ষাপটে জামায়াতকে নিষিদ্ধ করার উদ্যোগ নিল সরকার। ওই বৈঠক ডাকেন প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা।

১৪ দলের নেতাদের মতে, কোটা সংস্কারে ছাত্রদের আন্দোলনে যুক্ত হয়ে মাঠে নেমে মেট্রোরেলসহ রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনায় হামলা চালিয়েছে জামায়াত-শিবির।

নিষিদ্ধ করা হলে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী কোনো প্রকার রাজনৈতিক, সামাজিক কর্মকাণ্ড পরিচালনা করতে পারবে না। সেটি করার চেষ্টা করা হলে তা সন্ত্রাসী বলে বিবেচিত হবে এবং সন্ত্রাস বিরোধী আইনে বিচার হবে।

তবে জামায়াত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সরকারের এই সিদ্ধান্ত “অবৈধ ও অযৌক্তিক” এবং জামায়াত কোন সন্ত্রাসী সংগঠন নয়; একটি ইসলাম-ভিত্তিক একটি রাজনৈতিক দল।

সরকারি সিদ্ধান্ত ‘অবৈধ, অযৌক্তিক’

যুদ্ধাপরাধের দায়ে দণ্ডিত জামায়াত নেতাদের আইনজীবী হিসাবে কাজ করেছেন হাইকোর্টের আইনজীবী মোহাম্মদ শিশির মনির।

বুধবার তিনি বেনারকে বলেন, জামায়াতে ইসলামী দেশের বিভিন্ন জাতীয় নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেছে এবং তাদের সদস্যরা মন্ত্রীসভায়ও ছিলেন। জামায়াত একটি রাজনৈতিক দল। কোনো সন্ত্রাসী সংগঠন নয়।

“কোনো রাজনৈতিক দলকে নিষিদ্ধ করার ক্ষমতা কোনো রাজনৈতিক দলের নেই। পৃথিবীর কোথাও নেই,” মন্তব্য করে তিনি বলেন, “জামায়াতের মতো বড়ো একটি রাজনৈতিক দলকে নিষিদ্ধ করা অযৌক্তিক এবং অবৈধ।”

রাজনৈতিকভাবে আওয়ামী লীগের ঘোরতর শত্রু জামায়াতে ইসলামী। ১৯৭১ সালে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়।

দলটি পাকিস্তানকে অখণ্ড রাখতে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর পক্ষে বাংলাদেশের মুক্তিযোদ্ধা ও নিরীহ মানুষদের হত্যাসহ বিভিন্ন মানবতা বিরোধী অপরাধ সংঘটন করে।

ওই যুদ্ধে পাকিস্তান সেনাবাহিনী আত্মসমর্পণ করার পর স্বাধীন দেশ হিসাবে আত্মপ্রকাশ করে বাংলাদেশ। তখন দলটি চাপে পড়ে।

১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট এক সামরিক অভ্যুত্থানে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান নিহত হন। বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান ক্ষমতা গ্রহণ করার পর জামায়াত ও তার ছাত্র সংগঠন ইসলামী ছাত্র শিবির নির্বিঘ্নে রাজনীতি করার সুযোগ পায়।

১৯৯১ সালে বিএনপির সাথে সমঝোতার মাধ্যমে ভোট করে জাতীয় সংসদে ১৮টি আসন পান জামায়াত নেতারা। ১৯৯৬ সালে এককভাবে নির্বাচন করে আট দশমিক ৬১ ভাগ ভোট পেলেও সেবার দলটি তিনটি আসনে জয় পায়।

সর্বশেষ ২০০৮ সালের ডিসেম্বরের সাধারণ নির্বাচনে চার দশমিক সাত ভাগ ভোট পায় জামায়াত।

‘দৃষ্টি ভিন্ন দিকে ঘোরানোর চেষ্টা’

জামায়াতকে নিষিদ্ধ করার বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ‌্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক ড. আসিফ নজরুল বুধবার বেনারকে বলেন, “আমরা এখন পুলিশের হাতে আটক শিক্ষার্থীদের মুক্ত করতে আন্দোলন করে যাচ্ছি। আন্দোলন চলছে, এই অবস্থায় জামায়াত নিষিদ্ধ করার উদ্দেশ্য হলো “দেশের মানুষের নজর অন‌্যদিকে ফেরানোর অপচেষ্টা।”

দল হিসাবে নির্বাচন কমিশনে প্রায় এক যুগ আগে জামায়াতের নিবন্ধন বাতিল হয়েছে উল্লেখ করে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ‌্যালয়ের অধ‌্যাপক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক নিজাম উদ্দিন আহমেদ বুধবার বলেন, “জামায়াত ও তার ছাত্র সংগঠন ছাত্র শিবির প্রকাশ‌্য রাজনীতি করতে পারে না। সমাবেশ দূরে থাক, ঘরোয়া সভা করতে গেলেও পুলিশ তাদের আটক করে।”

তিনি বলেন, “যখন প্রকাশ‌্য রাজনীতি করতে পারছে না, তখন জামায়াত-শিবির নিষিদ্ধ করে লাভ কী?”

তাঁর মতে, “আসলে সরকার চলমান আন্দোলন থেকে সাধারণ মানুষের দৃষ্টি ফেরাতে চায়। আবার জামায়াত নিষিদ্ধ করার মাধ‌্যমে দলের নেতাকর্মীদের উজ্জীবিত করতে চায় আওয়ামী লীগ।”

তবে জামায়াতকে নিষিদ্ধ করলে “যখন তারা রাজনৈতিক জায়গা পাবে না তখন তারা জঙ্গি হয়ে উঠতে পারে,” বলেও মনে করেন অধ্যাপক নিজাম উদ্দিন আহমেদ।