গ্রেপ্তারে আইন মানছে না পুলিশ
2024.08.01
কিশোর মো. সাগরকে (১৫) মিরপুর ১০ নম্বর এলাকার রাস্তা থেকে গত ২২ জুলাই তুলে নেওয়া হয়। এর নয় দিন পর গত বুধবার দুপুরে ঢাকার আদালতে হাজির করা হয় তাকে। এই নয়দিন সবরকম চেষ্টা করেও সাগরের খোঁজ পেতে ব্যর্থ হয়েছে পরিবার।
সাগরের বোন সাবিনা ইয়াসমিন বুধবার বেনারকে বলেন, “সবার চোখের সামনে পুলিশ আমার ভাইকে নিয়ে গেলো। কিন্তু স্বীকার করল না তাকে আটকের কথা। এই নয়দিন তাহলে ‘গুম’ ছিল আমার ভাই।”
“একমাত্র ছেলের শোকে আমার মা শয্যাশায়ী হয়ে গেছেন। অন্তত সে বেঁচে আছে, এই খবরটা আজ পেয়েছি,” বলেন তিনি।
সাবিনার মতো এমন অসংখ্য স্বজনকে প্রিয়জনের খোঁজে অপেক্ষা করতে দেখা গেছে রাজধানীর বিভিন্ন থানা, ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) কার্যালয় ও আদালতের সামনে।
কোটা সংস্কার আন্দোলন ঘিরে সহিংসতায় এক সপ্তাহে ১০ হাজারের বেশি মানুষ গ্রেপ্তার হয়েছেন।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বৃহস্পতিবার জাতীয় শোক দিবসের অনুষ্ঠানে বলেছেন, এই সময়ে দুই শতাধিক মানুষ মারা গেছেন। যদিও সরকারি হিসেবে বলা হয়েছে ১৫০ জন।
১০ ভুক্তভোগীর সঙ্গে কথা বলেছে বেনারনিউজ
প্রিয়জনের খোঁজ পেতে দ্বারে দ্বারে ঘুরছেন এমন অন্তত ১০জন ভুক্তভোগীর স্বজনের সাথে কথা বলেছে বেনারনিউজ।
আইন অনুযায়ী এদের কাউকেই আটক করার ২৪ ঘণ্টার মধ্যে আদালতে হাজির করা হয়নি।
২৮ জুলাই সন্ধ্যা ছয়টার উত্তরার ১৩ নম্বর সেক্টরের বাসা থেকে নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ে বিবিএর ছাত্র আহমেদ সামরান ও তাঁর বাবা খালিদ সাইফুল্লাহকে (৬৫) থানায় নিয়ে যায় পুলিশ। এর একদিন পর বাবাকে আদালতে তোলা হলেও পুলিশ সামরানকে গ্রেপ্তারের কথা স্বীকার করেনি।
টানা ৫৯ ঘণ্টা নিখোঁজ থাকার পরে বুধবার বিকেলে আদালতে সামরানের দেখা পায় পরিবার। এই পুরো সময় থানা-পুলিশ, আদালত চষে বেড়িয়েছে তাঁর পরিবার।
মঙ্গলবার দুপুরে সামরানের বোন ডা. নাঈমা তাসনীম বেনারকে বলেন, “কথা বলবে জানিয়ে ৮-১০ জন পুলিশ বাসা থেকে বাবা ও ভাইকে উত্তরা পশ্চিম থানায় নিয়ে যায়। কিছুক্ষণ পরে সেখানে গিয়ে বাবাকে দেখতে পেলেও সামরানের দেখা মেলেনি। এরপর হাজারবার পুলিশকে জিজ্ঞেস করেছি। সামরানকে আনার কথা স্বীকারই করছিল না।”
“গুমের কত ঘটনার কথা পত্রিকায় পড়েছি। তাই অজানা আশঙ্কায় বুকটা কেঁপে উঠছিল বারবার। পুলিশকে বারবার বলেছি, আমার ভাইটার বিরুদ্ধে মামলা দিন, কারাগারে পাঠান, আইনি যা ব্যবস্থা নিতে হয় নিন। কিন্তু ও যে বেঁচে আছে সেটা অন্তত আমাদের জানান,” বলছিলেন তিনি।
গত ২৫ জুলাই পুলিশ তুলে নেওয়ার পর থেকে নিখোঁজ ড্যাফোডিল ইনস্টিটিউট অব আইটির প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থী মাসরুর হাসান। তাঁর সন্ধানে সংবাদ সম্মেলনে করার চেষ্টাকালে ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটিতে (ডিআরইউ) সামনে থেকে ২৮ জুলাই মাসরুরের ভাই মেহেদী হাসান ও মাকে তুলে নেওয়ার অভিযোগ ওঠে সাদা পোশাকের পুলিশের বিরুদ্ধে।
গত ২৭ জুলাই শনিবার সন্ধ্যায় সাদা পোশাকে একদল লোক নাজিম উদ্দিন নামে কেরাণীগঞ্জের এক ব্যবসায়ীকে তুলে নিয়ে যায়। এরপর থেকে স্বামীকে খুঁজে বেড়াচ্ছিলেন তাঁর স্ত্রী শারমিন আক্তার। মঙ্গলবার তিনি বেনারকে জানান, প্রায় ৩৮ ঘণ্টা পরে আমার স্বামীকে আদালতে তোলে পুলিশ।
শারমিন বলেন, “আমাকে ধাক্কা মেরে ফেলে দেয় পুলিশ। মাগরিবের নামাজ পড়া অবস্থায় আমার স্বামীকে আটক করে। তিনি উচ্চ রক্তচাপ এবং নিউরোর রোগী। অন্তত ওষুধগুলো যেন দিতে পারি সেজন্য কত জায়গায় যে ঘুরেছি। কিন্তু কেউ সন্ধান দেয়নি। কেউ আটকের কথা স্বীকারই করেনি।”
“এটা মন্দের ভাল যে ৩৮ ঘণ্টা পরে হলেও তাকে আদালতে তোলা হয়। সেখান থেকে তাঁকে কারাগারে পাঠানো হয়,” বলেন তিনি।
নিখোঁজ অন্যান্য স্বজনদের বক্তব্যও প্রায় একইরকম।
এটা স্পষ্টত গুম: আইনজীবী ও মানবাধিকারকর্মী
আইনজীবী ও মানবাধিকারকর্মীরা বলছেন, গ্রেপ্তার, আদালতে তোলা বা রিমান্ড-কোনো কিছুতেই আইনের তোয়াক্কা করছে না পুলিশ। এমনকি জিজ্ঞাসাবাদের নামে অমানবিক নির্যাতনের অভিযোগ পাচ্ছেন তারা।
সুপ্রিম কোর্টের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী জেড আই খান পান্না বেনারকে বলেন, “আটকের পর ২৪ ঘণ্টা পার হলে আদালতে না তোলা স্পষ্টত গুম। এক্ষেত্রে ফৌজদারি কার্যবিধির ৫৪ ও ১৬৭ ধারা নিয়ে উচ্চ আদালত যেসব নির্দেশনা দিয়েছেন সেসবের লঙ্ঘন করা হচ্ছে। সংবিধানের ৩৩ অনুচ্ছেদেও এ বিষয়ে নির্দেশনা রয়েছে।”
তিনি বলেন, “কাউকে আটক বা গ্রেপ্তার করতে হলে তাঁর বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ থাকতে হবে। তিন ঘণ্টার মধ্যে তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগের বিষয়ে জানাতে হবে। তাঁর আত্মীয়স্বজন এবং আইনজীবীকে বিষয়টি অবহিত করতে হবে।”
বাংলাদেশে বর্তমানে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী আইনের কোনো তোয়াক্কা করছে না মন্তব্য করে মানবাধিকার কর্মী নূর খান লিটন বেনারকে বলেন, “মানবাধিকারের চূড়ান্ত লঙ্ঘন আমরা দেখতে পাচ্ছি। ২৪ ঘণ্টার বেশি সময় ধরে কাউকে আটকে রাখা গুমের সংজ্ঞায় পড়ে,” বলেন তিনি।
এর আগে ২০২১ সালের ১০ ডিসেম্বর মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগে র্যাবের সাবেক ও বর্তমান সাত কর্মকর্তার বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা দেয় যুক্তরাষ্ট্র। এ ছাড়া প্রতিষ্ঠান হিসেবে র্যাবের বিরুদ্ধেও নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়।
আইন ও সালিশ কেন্দ্রের সিনিয়র কোঅর্ডিনেটর আবু আহমেদ ফয়জুল কবীর বেনারকে বলেন, “জবাবদিহির অভাবে আইন শৃঙ্খলাবাহিনী এই ধরনের আচরণ করছে। তাদের এ ধরনের আনলফুল প্রাকটিস থেকে সরে আসতে হবে।”
জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান কামাল উদ্দিন আহমেদ বেনারকে বলেন, আটক গ্রেপ্তারের ক্ষেত্রে সংবিধান ও উচ্চ আদালতের নির্দেশনার অনুসরণ না করা হলে তা অবশ্যই মানবাধিকার লঙ্ঘন। দোষীদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিতে হবে।
এসব অভিযোগ সম্পর্কে জানতে চাইলে পুলিশ সদর দপ্তরের এআইজি (মিডিয়া অ্যান্ড পাবলিক রিলেশন্স) ইনামুল হক সাগর বেনারকে বলেন, “যেকোনো আটক বা গ্রেপ্তারে যথাযথ আইনি প্রক্রিয়া অনুসরণ করা হচ্ছে। আইন না মেনে দায়িত্ব পালন করার সুযোগ নেই।"
ছয় সমন্বয়ক মুক্ত
ঢাকা মহানগর পুলিশের গোয়েন্দা শাখা (ডিবি) থেকে বৃহস্পতিবার মুক্ত হয়েছেন চলমান কোটা সংস্কার আন্দোলনের প্ল্যাটফর্ম বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ছয় সমন্বয়ক।
এরা হলেন নাহিদ ইসলাম, আসিফ মাহমুদ, আবু বকর মজুমদার, সারজিস আলম, হাসনাত আবদুল্লাহ ও নুসরাত তাবাসসুম।
সমন্বয়ক হাসনাত আবদুল্লাহ বেনারকে তাঁদের মুক্তির খবরটি নিশ্চিত করে বলেন, “আমাদের সবাইকে দুপুর একটার দিকে নিজ নিজ পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। এর আগে আমরা ডিবি কার্যালয়ে টানা ৩৬ ঘণ্টা অনশন পালন করেছি।”
ডিবি কার্যালয়ে তাঁদের সঙ্গে কী হয়েছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, “আমরা সবাই (৬ সমন্বয়ক) যৌথ প্রেস কনফারেন্স বা বিবৃতির মাধ্যমে সবাইকে জানাব।”
প্রসঙ্গত, হাসপাতাল ও অন্যান্য স্থান থেকে গত ২৬ ও ২৭ জুলাই তুলে নিয়ে ‘নিরাপত্তা’ দেওয়ার নামে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ছয় সমন্বয়ককে শুক্রবার থেকে পর্যন্ত হেফাজতে রাখে পুলিশ।
ডিবি হেফাজত থেকে মুক্ত হওয়ার পরে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের দুই সমন্বয়ক হাসনাত ও সারজিস জানিয়েছেন, তাদের আন্দোলন চলবে।
নতুন কর্মসূচি ঘোষণা
পূর্ব ঘোষিত ৯ দফা দাবি আদায়ের লক্ষ্যে চলমান আন্দোলনের নতুন কর্মসূচি ঘোষণা করেছে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন।
বৃহস্পতিবার এক বিবৃতিতে আন্দোলনের সমন্বয়ক আবদুল কাদের জানিয়েছেন, শুক্রবার গণহত্যা ও গণগ্রেপ্তারের প্রতিবাদে এবং শিক্ষার্থীদের ৯ দফা দাবি আদায়ের লক্ষ্যে মসজিদে জুমার নামাজ শেষে দোয়া, শহীদদের কবর জিয়ারত, মন্দির, গির্জাসহ সব উপাসনালয়ে প্রার্থনার আয়োজন ও জুমার নামাজ শেষে ছাত্র-জনতার গণমিছিল বের করা হবে।
জামায়াত-শিবির নিষিদ্ধ
জামায়াতে ইসলামী এবং তাদের ছাত্র সংগঠন ইসলামী ছাত্র শিবিরকে সাম্প্রতিক কোটা সংস্কার আন্দোলনের মধ্যে ‘সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড’ চালানোর অভিযোগে সন্ত্রাসবিরোধী আইনের ১৮(১) ধারা অনুযায়ী নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছে সরকার।
এর প্রতিক্রিয়ায় দলটির আমির ডা. শফিকুর রহমান বৃহস্পতিবার এক বিবৃতিতে বলেন,
সরকার নিজেদের অপকর্ম ঢাকার জন্য জামায়াতকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করে চলমান আন্দোলনকে ভিন্নখাতে প্রবাহিত করতে চাচ্ছে। জামায়াতের আমির বলেন, বাংলাদেশের সংবিধান সব নাগরিকের সভা-সমাবেশ ও সংগঠন করার অধিকার দিয়েছে, সরকার এখানে সংবিধান লঙ্ঘন করেছে।