সরকার পতনের অসহযোগ আন্দোলন, এক দিনে প্রায় একশো মৃত্যু
2024.08.04
বাংলাদেশে সর্বাত্মক অসহযোগের প্রথম দিন রোববার সারাদেশে পুলিশ, বিক্ষোভকারী ও রাজনৈতিক নেতা-কর্মীসহ প্রায় একশো জন মানুষ নিহত হয়েছেন।
হাসপাতাল, পুলিশ ও সিভিল প্রশাসনের কর্মকর্তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করে রোববার রাত সাড়ে নয়টা পর্যন্ত বেনার নিউজ ৯১টি মৃতের তথ্য নিশ্চিত করেছে। যার মধ্যে নিহত পুলিশ সদস্যের সংখ্যা ১৪। তবে বাংলাদেশ সময় রোববার দিবাগত রাত একটার দিকে দৈনিক প্রথম আলো এক প্রতিবেদনে জানায়, নিহতের সংখ্যা ৯৭।
নিহতদের মধ্যে সিরাজগঞ্জে ১৩ পুলিশসহ ২২ জন মারা গেছেন। ঢাকায় মারা গেছেন কমপক্ষে ১১ জন।
এ ছাড়া ফেনী ও লক্ষ্মীপুরে আটজন করে ১৬ জনের মৃত্যু হয়েছে। নরসিংদীতে মারা গেছেন ছয় জন।
রংপুরে পাঁচ জন, মাগুরা ও বগুড়ায় চার জন করে আটজন, পাবনা, মুন্সীগঞ্জ, কিশোরগঞ্জ, সিলেট, শেরপুর, ও কুমিল্লায় তিন জন করে ১৮ জন, বরিশাল, জয়পুরহাট, হবিগঞ্জ, কক্সবাজার ও ভোলায় এক জন করে ৫ জন নিহত হয়েছেন।
চলমান ছাত্র আন্দোলনে এর আগে শনিবার পর্যন্ত ২১৯ জনের মৃত্যু নিশ্চিত হওয়া গেছে। ফলে মোট মৃত্যুর সংখ্যা ৩০০ পার হলো।
পুলিশ সদর দপ্তর বাহিনীর প্রায় ৩০০ সদস্য আহত হওয়ারও তথ্য দিয়েছে।
রোববার ঢাকাসহ সারা দেশে আন্দোলনকারীরা গণ অবস্থানের ঘোষণা দেন। এর প্রেক্ষিতে পাল্টা কর্মসূচি দিয়ে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগও নেতা-কর্মীদের নিয়ে দেশের বিভিন্ন স্থানে রাস্তায় নেমে আন্দোলনকারীদের সঙ্গে সংঘর্ষে জড়ায়।
সংঘর্ষের সময় খুলনা, গাজীপুর, মাগুরা, সিরাজগঞ্জ, জয়পুরহাট, ফরিদপুর, পঞ্চগড়, কিশোরগঞ্জ ও ভোলায় আওয়ামী লীগের কার্যালয়ে হামলা করে ভাঙচুর ও আগুন লাগিয়ে দেয়ার ঘটনা ঘটেছে।
ক্ষমতাসীন দলের কয়েকজন সংসদ সদস্য ও নেতার বাড়িতেও ভাংচুরের খবর পাওয়া গেছে।
কিশোরগঞ্জের জেলা প্রশাসক আবুল কালাম আজাদ বেনারকে বলেন, আন্দোলনকারীরা জেলার আওয়ামী লীগের নেতা সৈয়দ আশফাকুল ইসলাম টিটোর বাড়িতে আগুন দিলে আশফাক মারা যান।
আশফাক ছাড়াও এই জেলায় আরো দুইজন নিহত হয়েছেন বলে নিশ্চিত করেন তিনি।
ফেনীতে বিক্ষোভকারীদের সঙ্গে ছাত্রলীগ, যুবলীগ ও আওয়ামী লীগের সংঘর্ষে পাঁচজনের মৃত্যুর খবর নিশ্চিত হওয়া গেছে।
ঢাকায় সচিবালয়ের একটি গেটের সামনে জড়ো হলে পুলিশ টিয়ারসেল ও সাউন্ড গ্রেনেড নিক্ষেপ করে আন্দোলনকারীদের সরিয়ে দেয়। এছাড়া উত্তরা, মিরপুরসহ ঢাকার কয়েকটি এলাকায় আন্দোলনকারীদের সঙ্গে সংঘর্ষে জড়ায় পুলিশ ও ক্ষমতাসীন দলের নেতা-কর্মীরা।
এদিকে শাহবাগ, মৎসভবন, বাংলামোটর ও কাওরান বাজার এলাকায় কয়েক হাজার আন্দোলনকারী জনতা অবস্থান নিয়েছেন। ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে ছাত্রলীগ ও যুবলীগের নেতা-কর্মীদের কারো কারো হাতে অস্ত্রও দেখা গেছে।
নাশকতাকারীদের দমনের আহ্বান প্রধানমন্ত্রীর
রোববার নিরাপত্তাসংক্রান্ত জাতীয় কমিটির বৈঠক শেষে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সর্বাত্মক অসহযোগ কর্মসূচি ঘিরে চলমান পরিস্থিতিতে নাশকতাকারীদের শক্ত হাতে দমন করতে দেশবাসীর প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন।
“এখন যারা নাশকতা করছে, তারা কেউই ছাত্র নয়। তারা সন্ত্রাসী। এই সন্ত্রাসীদের শক্ত হাতে দমন করার জন্য আমি দেশবাসীর প্রতি আহ্বান জানাচ্ছি,” বলেন প্রধানমন্ত্রী।
গণভবনে নিরাপত্তা সংক্রান্ত জাতীয় কমিটির সভা থেকে বেরিয়ে প্রধানমন্ত্রীর সহকারী প্রেস সচিব এবিএম সরওয়ার-ই-আলম সরকার গণমাধ্যমকে এ তথ্য জানিয়েছেন।
তিনি জানান, কমিটির আহ্বায়ক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রী, নিরাপত্তা উপদেষ্টা, সচিব, সেনা, নৌ, বিমান, পুলিশ, বিজিবি, কোস্ট গার্ড, ফোর্সেস ইন্টেলিজেন্স ও এনএসআই-এর প্রধানসহ এ কমিটির মোট সদস্য ২৯ জন।
আবার অনির্দিষ্টকালের জন্য কারফিউ
রোববার রাত ৯টা পর্যন্ত কারফিউ শিথিলের ঘোষণা থাকলেও, বিকেলে এক বিজ্ঞপ্তিতে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে বলা হয়েছে, রোববার সন্ধ্যা ছয়টা হতে পরবর্তী নির্দেশ না দেওয়া পর্যন্ত ঢাকা মহানগরসহ সকল বিভাগীয় সদর, সিটি কর্পোরেশন, পৌরসভা, শিল্পাঞ্চল, জেলা সদর ও উপজেলা সদরে সান্ধ্য আইন বলবত করা হলো।
এদিকে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের এক প্রজ্ঞাপন জানানো হয়েছে সোমবার থেকে আবারও তিন দিনের (৫,৬ ও ৭ আগস্ট) সাধারণ ছুটি ঘোষণা করেছে সরকার।
রোববার দুপুরের পর সারাদেশে ফেসবুক, হোয়াটসঅ্যাপ সহ মেটার সকল সার্ভিসসহ মোবাইল ডেটা বন্ধ করে দিয়েছে কর্তৃপক্ষ।
ছাত্রদের নতুন কর্মসূচি 'মার্চ টু ঢাকা'
দেশজুড়ে চলমান সংঘাত সহিংসতার মধ্যেই রোববার নতুন কর্মসূচি ঘোষণা করেছে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন।
এক বার্তায় সমন্বয়ক আসিফ মাহমুদ বলেন, “পরিস্থিতি পর্যালোচনায় এক জরুরি সিদ্ধান্তে আমাদের 'মার্চ টু ঢাকা' কর্মসূচি ৬ আগস্ট থেকে পরিবর্তন করে ৫ আগস্ট করা হলো। অর্থাৎ আগামীকালই সারাদেশের ছাত্র-জনতাকে ঢাকার উদ্দেশ্যে যাত্রা করার আহ্বান জানাচ্ছি।”
তিনি বলেন, আজ (রোববার) প্রায় অর্ধশতাধিক ছাত্র-জনতাকে খুন করা হয়েছে। চূড়ান্ত জবাব দেওয়ার সময় এসে গেছে।
আশেপাশের জেলাগুলো থেকে সবাইকে ঢাকায় আসার আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, যারা পারবেন আজই ঢাকার উদ্দেশ্যে রওনা হয়ে যান। ঢাকায় এসে মুক্তিকামী ছাত্র জনতা রাজপথগুলোতে অবস্থান নেন।
“চূড়ান্ত লড়াই, এই ছাত্র নাগরিক অভ্যুত্থানের চূড়ান্ত স্বাক্ষর রাখার সময় এসে গেছে। ইতিহাসের অংশ হতে ঢাকায় আসুন সকলে। যে, যেভাবে পারেন কালকের মধ্যে ঢাকায় চলে আসুন। ছাত্র-জনতা এক নতুন বাংলাদেশের অভ্যুদয় ঘটাবো,” যোগ করেন আসিফ।
সরাসরি গুলি না করার নির্দেশনা চেয়ে রিট খারিজ
চলমান শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের সময় আন্দোলনকারীদের সরাসরি গুলি না করার নির্দেশনা চেয়ে হাইকোর্টে করা রিট খারিজ করে দিয়েছে আদালত।
রোববার বিচারপতি মোস্তফা জামান ইসলাম ও বিচারপতি মাসুদ হোসেনের বেঞ্চ শুনানি শেষে এই আদেশ দেন।
আদেশে বলা হয়, সব নাগরিকের শান্তিপূর্ণ সভা সমাবেশে অংশগ্রহণ করার অধিকার আছে। পুলিশকে আইনের নির্দেশনা মানতে হবে।
কেউ আইন লঙ্ঘন করলে পুলিশ বা আইন প্রয়োগকারী সংস্থা রাবার বুলেট, টিয়ার শেল ও তারপরে প্রাণঘাতী গুলি ব্যবহার করতে পারে। যদি কোনো লঙ্ঘন না ঘটে বা কোনো দাঙ্গা না হয়, তবে কোনো প্রাণঘাতী গুলি (লাইভ বুলেট) ব্যবহার করা যাবে না বলে পর্যবেক্ষণ দিয়েছেন হাইকোর্ট।
গত ২৯ জুলাই সকালে হাইকোর্টের সংশ্লিষ্ট শাখায় এ রিট আবেদন করেন সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী মানজুর আল মতিন প্রীতম ও আইনুন্নাহার সিদ্দিকা লিপি।
সামরিক বাহিনীকে ফিরিয়ে নেন: সাবেক সেনা কর্মকর্তারা
সাবেক সেনা কর্মকর্তারা সামরিক বাহিনীকে ছাউনিতে ফিরিয়ে নেওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন।
দেশের বিদ্যমান অবস্থায় সংকট নিরসনে করণীয় প্রসঙ্গে মূল বক্তব্যে সেনাবাহিনীর সাবেক প্রধান ইকবাল করিম ভূঁইয়া বলেন, “দেশের নীতিনির্ধারকেরা যদি বিবেক, বুদ্ধি ও হৃদয়হীন হয়ে না পড়তেন, তাহলে গত কয়েক সপ্তাহে বাংলাদেশের ইতিহাসের সবচেয়ে বড়ো, করুণ, মর্মান্তিক এই হত্যাকাণ্ডের ঘটনাগুলো ঘটত না। এসব হামলা, আক্রমণ ও পাল্টা প্রতিরোধে অঙ্গহানি ঘটেছে অগণিত মানুষের। অন্ধ হয়েছেন বহুসংখ্যক কিশোর ও তরুণ। অসহায় নাগরিকেরা প্রয়োজনীয় এবং জরুরি চিকিৎসাও পাচ্ছেন না। তার ওপরে চলছে ব্লক রেইড করে, সন্ত্রাসীদের মাধ্যমে বাড়িঘর, মেস চিনিয়ে ধরে নিয়ে যাওয়ার মতো ভয়ংকর ঘটনা। মিথ্যা মামলায় গ্রেপ্তার হয়েছেন অথবা পালিয়ে বেড়াচ্ছেন হাজার হাজার নিরপরাধ কিশোর–কিশোরী, তরুণ-তরুণী, যুবক-যুবতী।”
সংবাদ সম্মেলনের ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) সাখাওয়াত হোসেন, ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) শাহেদুল আনাম খানসহ ছয়জন সাবেক জ্যেষ্ঠ সামরিক কর্মকর্তা বক্তব্য দেন।
ইকবাল করিম বলেন, “বৈষম্য, ভেদাভেদ ও জুলুমের অবসান করা ছিল মুক্তিযুদ্ধের অঙ্গীকার। তা না ঘটে উল্টো এটা আজ দেশের সব পর্যায়ে ভয়াবহভাবে বিস্তার লাভ করেছে। সমাজের নিচের স্তরে পড়ে থাকা সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের সহ্যের সীমার বাইরে চলে গেছে। আমাদের অর্থনৈতিক অবস্থা ও এর ব্যবস্থাপনা খুব নাজুক, যার প্রতিকার ঘটাতে জনগণ আজ আত্মোৎসর্গ করতে পিছপা হচ্ছে না। এমন কষ্টকর পরিস্থিতির ভেতর দেশবাসীকে ঠেলে দেওয়ার জন্য যারা দায়ী, বিচারের মাধ্যমে তাদের সাজা নিশ্চিত করে পুরো ব্যবস্থার মধ্যে স্বচ্ছতা, ন্যায্যতা ও বিশ্বাসযোগ্যতা প্রতিষ্ঠা করা না গেলে সমাজে শান্তি, শৃঙ্খলা ও আস্থা ফিরিয়ে আনা যাবে না।”