কোটা সংস্কার আন্দোলন: সহিংসতা কমলেও শিশুদের আতঙ্ক ও মানসিক চাপ কমেনি
2024.07.30
ছবি আঁকার ক্লাসে যাবার জন্য মায়ের হাত ধরে গত শনিবার মালিবাগের বাসা থেকে বের হয় সাত বছরের প্রতীতি সালামী প্রত্ন। গলি পেরিয়ে প্রধান সড়কে উঠতেই দেখে মানুষের দিগ্বিদিক ছোটাছুটি, পুলিশের ছোঁড়া কাঁদুনে গ্যাসের ধোঁয়ায় আচ্ছন্ন এলাকা।
ভীতসন্ত্রস্ত মেয়েকে টেনে নিয়ে কোনো রকমে বাসায় ফেরেন মা তানিয়া আক্তার। সেই আতঙ্ক কাটতে না কাটতেই গভীর রাতে গুলির শব্দে ঘুম ভাঙে প্রত্ন’র। তারপর থেকে অজানা আশঙ্কায় স্বাভাবিকভাবে খেলাধুলা, পড়ালেখা করতে পারছে না শিশুটি।
প্রত্নের মা তানিয়া বেনারকে বলেন, “আমার বড়ো ছেলের বয়স ১২ বছর। তারা দুই ভাই-বোনই ভীষণ আতঙ্কিত। পড়ালেখা, খাওয়া-দাওয়া করছে না ঠিকঠাক।”
সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলন ঘিরে টানা কয়েকদিনের সহিংসতার দগদগে স্মৃতি প্রত্নের মতো দেশের হাজার হাজার শিশুর মনে।
দেশের বিভিন্ন হাসপাতাল ও পুলিশের কাছ থেকে প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে বেনারনিউজ এখন পর্যন্ত ২১৩ জনের মৃত্যুর খবর নিশ্চিত হতে পেরেছে। এর মধ্যে বিভিন্ন হাসপাতালে মৃতদের পরিবার ও স্বজনদের সঙ্গে যোগাযোগ করে এবং স্থানীয় বিভিন্ন উৎস থেকে প্রাপ্ত খবরে দেখা গেছে, এই সহিংসতার ঘটনায় কমপক্ষে ১৫ জন শিশু মারা গেছে, আহত হয়েছে আরো অনেকেই।
ছাত্র বিক্ষোভে ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন আবাসিক এলাকায় সংঘর্ষ ছড়িয়ে পড়ে। এর ফলে শিশুরা তাদের ঘরে থেকেও এই সহিংস ঘটনাগুলো প্রত্যক্ষ করে।
মনোবিদরা বলছেন, এই ধরনের সহিংসতার মুখোমুখি হওয়া শিশুরা দীর্ঘমেয়াদী মানসিক চাপের শিকার হতে পারে, যা তাদের স্বাভাবিক বিকাশ বাধাগ্রস্ত করবে।
তবে সরকারের পক্ষ থেকে এখন পর্যন্ত শিশু সুরক্ষায় কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।
মনোচিকিৎসক ও জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের সহকারী অধ্যাপক ডা. আহমেদ হেলাল বলেন, “এই কয়েকদিনের সহিংসতায় অনেক অনাকাঙ্ক্ষিত হতাহত ও গ্রেপ্তারের ঘটনা ঘটেছে। ইন্টারনেট ছিল না, এখন আসলেও ধীরগতি। সব পরীক্ষা স্থগিত, স্কুল-কলেজ বন্ধ। এসব কিছু মিলে শিশুদের মধ্যে মানসিক চাপ তৈরি হয়েছে, যার প্রতিক্রিয়া দীর্ঘমেয়াদী হতে পারে।”
“শিশুদের এই মানসিক চাপের ফলে তাদের ঘুম, পড়ালেখা, আচরণে সমস্যা করবে। আচরণে ভীতি তৈরি হওয়ার পাশাপাশি কারো কারো দীর্ঘ মেয়াদী ব্যক্তিত্বের বিকাশ বাধাগ্রস্ত হতে পারে,” বলেন তিনি।
অধ্যাপক হেলাল বলেন, “এই শিশুরা যখন বড়ো হবে, তখন তাদের কারো কারো মধ্যে অসামঞ্জস্যতা, আগ্রাসী আচরণ দেখা দিতে পারে। পারিবারিক জীবনেও তারা ভায়োলেন্স করতে পারে। কারণ, তারা ভায়োলেন্সের মুখোমুখি হয়েছে।”
এছাড়া তাৎক্ষণিকভাবে পড়ালেখায় ক্ষতি হতে পারেও বলে মনে করেন তিনি।
“এই ক্ষতি যাতে উল্লম্ফন না হয় সেজন্য এসব শিশুদের সামাজিক দক্ষতা বৃদ্ধির চেষ্টা করতে হবে। পাশাপাশি তাদের পর্যাপ্ত ঘুম ও খাদ্য গ্রহণ ঠিক রেখে পারিবারের মধ্যে ভালো সময় কাটাতে হবে,” বলেন এই মনোবিদ।
শিশুরা আতঙ্কিত
বেনারের সঙ্গে আলাপকালে অভিভাবকরা বলেন, বাচ্চারা শিখেছে পুলিশসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনী অপরাধীদের সাজা দেয়। অথচ বাস্তবে তাদের ছাত্রদের ওপর গুলি করতে দেখছে।
তাঁরা বলেন, স্কুল-কলেজ বন্ধ, সংঘর্ষের জন্য বাইরে বাচ্চারা বের হতে পারে না। এখনকার বাচ্চারা ইন্টারনেটে কিছু সময় কাটায়। কিন্তু সেটাও বন্ধ ছিল। ফলে অত্যন্ত খারাপ সময় পার করেছে, এখনও বাচ্চাদের অনেকেই স্বাভাবিক হতে পারেনি।
ঢাকার বনশ্রী এলাকার বাসিন্দা আতিক মোহাম্মদ শরীফ বলেন, “টানা চারদিন এই এলাকা ছিল রণক্ষেত্র। মুহুর্মুহু গুলির শব্দ, মানুষের চিৎকার! আমার বাসার সামনেই দুজন মাথায় গুলিবিদ্ধ হয়েছে।”
“এখন আমার একমাত্র সন্তান আয়াজ আল আমিন (৯) আমাদের কাউকে বারান্দায় যেতে বা ঘরের জানালা খুলতে দেয় না। নিচে যেকোনো আওয়াজ হলে ভয় পাচ্ছে। নিজের মানসিক চাপের মধ্যে সন্তানের এই অবস্থা আমাকে সত্যি ভাবিয়ে তুলেছে।”
গণমাধ্যমকর্মী মেহেদী হাসান বেনারকে জানান, তাঁর ১৪ বছরের ছেলে ছাত্রদের ওপর গুলি চালানোর ঘটনায় ভীষণ ভয় পেয়েছে। পরিস্থিতি এমন যে, এখন আর সে একা ঘুমাতে পারছে না। বাবা-মায়ের সাথেই ঘুমাচ্ছে।
দুই কন্যার মা আইনজীবী সুরাইয়া জান্নাত বেনারকে বলেন, “আগে বিমান বা হেলিকপ্টার উড়লে দেখার জন্য বাচ্চারা ছুটে বারান্দা, ছাদে কিংবা বাইরে যেত। অথচ হেলিকপ্টারের শব্দে এখন তারা আতঙ্কিত হয়। প্রতিদিন বিকেলে তারা দল বেঁধে ছাদে খেলতে যেত। এখন ছাদে যায় না। আতঙ্কে বারান্দায় দাঁড়াতে দেই না।”
তিনি বলেন, “চাইলেও সবকিছু তাদের থেকে লুকিয়ে রাখা যায় না। ছাত্রের বুকে গুলি করার দৃশ্য সংবাদে দেখেছে। বাইরে গুলির শব্দ শুনেছে। ছাদে খেলতে গিয়ে গুলিতে মানুষ মরার খবর পেয়েছে।”
ঢাকার চীফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালতের সামনে দাঁড়িয়ে শারমিন বেগম বলেন, “ঘুমন্ত অবস্থায় আমার স্বামীকে পুলিশ তুলে নিয়ে গেছে। এখন আতঙ্কে আমার বাচ্চারা ঘুমাতে পারে না।”
এসব পরিস্থিতি সম্পর্কে লিভিং উইথ ওয়েলনেস-এর প্রতিষ্ঠাতা ও মনোবিদ মাহমুদা বেনারকে বলেন, “প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে সহিংসতা-সংঘর্ষের অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হওয়া বা পরিবারকে কঠিন সময় পার করতে দেখার ঘটনা বাচ্চার জন্য ট্রমা বয়ে আনে।”
“এই সময়টাতে অভিভাবক বা কেয়ার গিভারদের বাচ্চাকে সঙ্গ দেয়া জরুরি। না লুকিয়ে তাদের কাছে পরিস্থিতি ব্যাখ্যা করতে হবে। তাদের বই পড়া, ইনডোর খেলাধুলায় যুক্ত করা জরুরি,” বলেন তিনি।
সরকারের কোনো উদ্যোগ নেই
শিশুদের এই পরিস্থিতি থেকে রক্ষায় সরকারের কোনো উদ্যোগ নেই। যদিও বাংলাদেশে কোটা সংস্কার আন্দোলনে সৃষ্ট পরিস্থিতিতে শিশুদের যেকোনো ধরনের সহিংসতা থেকে রক্ষার আহ্বান জানিয়েছে জাতিসংঘের শিশু বিষয়ক সংস্থা ইউনিসেফ।
সরকারের মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের উপসচিব (শিশু ও সমন্বয় বিভাগ) দীপক কুমার রায় বেনারকে জানান, এই মন্ত্রণালয় শুধু শিশুদের বিকাশ নিয়ে কাজ করে। সুরক্ষা নিয়ে এখনো কাজ শুরু হয়নি। এর ফলে এই সহিংসতার ঘটনায় হতাহতের বিষয়ে আমাদের কাছে কোনো তথ্য নেই। কিংবা শিশুদের ট্রমা নিয়েও আমরা কাজ করছি না।”
“তবে আমরা দেশের সবগুলো শিশু একাডেমিকে আরো সক্রিয় হওয়ার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে,” যোগ করেন তিনি।
শিশুদের নিয়ে কাজ করা আরেকটি প্রতিষ্ঠান পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরের প্রোগ্রাম ম্যানেজার (এঅ্যান্ডআরএইচ) ডা. মো. মনজুর হোসেন বেনারকে বলেন, “যদি কেউ আমাদের মানসিক স্বাস্থ্য সেবা কেন্দ্রে আসে, তাহলে কাউন্সেলিংসহ প্রয়োজনীয় সেবা দেওয়া হয়। এখানে সম্ভব না হলে তাদের আমাদের ডেজিগনেটেড সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানে পাঠানো হয়। কিন্তু সাম্প্রতিক সহিংসতার ঘটনায় আলাদা কোনোকিছু করা হয়নি।”
সোমবার (২৯ জুলাই) সামাজিক মাধ্যম ফেসবুকে দেয়া এক পোস্টে সংস্থাটি জানায়, “বাংলাদেশে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে ইউনিসেফ সংশ্লিষ্ট সব পক্ষকে আহ্বান জানায় শিশুদের সহিংসতা থেকে রক্ষা করতে এবং আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী সহিংসতা ও ভয়-ভীতিমুক্ত একটি নিরাপদ পরিবেশে মত প্রকাশের অধিকার নিশ্চিত রাখতে।”
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজ বিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক সামিনা লুৎফা বেনারকে বলেন, সবার আগে রাষ্ট্রের উচিত ছাত্রদের বুকে গুলি করার মত ঘৃণিত কাজ বন্ধ করা। ছাত্র আটক-গ্রেপ্তার বন্ধ করা। এসব চলতে থাকলে শিশুরা কেন আপনি আমি বা কোনো নাগরিক মানসিকভাবে সুস্থ থাকতে পারবে না।”
শিশুদের বিষয়ে সরকারের সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলো কোনো পদক্ষেপ না নেওয়ার বিষয়ে তিনি বলেন, “এসব মন্ত্রণালয় কি জন্য আছে। জনগণের করের টাকায় এসব মন্ত্রণালয় হয়।”
উল্লেখ্য, বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) ২০২২ সালের চূড়ান্ত প্রতিবেদন অনুযায়ী, প্রায় ১৭ কোটি মানুষের দেশে শূন্য থেকে ১৫ বছরের কম বয়সী শিশুর সংখ্যা প্রায় চার কোটি ৮৯ লাখ, যা মোট জনসংখ্যার ২৯ শতাংশ।