গুম ও আড়ি পাতায় নেতৃত্ব দেওয়া সেনা কর্মকর্তা জিয়া গ্রেপ্তার
2024.08.16
ঢাকা
বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে পুলিশের এলিট ফোর্স র্যাবে থাকতে গুম-অপহরণে জড়িত থাকার অভিযোগ ছিল প্রভাবশালী সেনা কর্মকর্তা জিয়াউল আহসানের বিরুদ্ধে।
এরপর তার বিরুদ্ধে ন্যাশনাল টেলিকমিউনিকেশন মনিটরিং সেন্টারের (এনটিএমসি) মহাপরিচালক হয়ে টেলিফোনে আড়ি পেতে মানুষের গোপনীয়তা লঙ্ঘন ও মত প্রকাশের অধিকার ক্ষুন্ন করার বিষয়টি ছিল অনেকটা ‘ওপেন সিক্রেট’।
অন্তবর্তী সরকার ৫ আগস্ট দায়িত্ব নেওয়ার একদিন পর ৬ আগস্ট তাকে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়, সরিয়ে দেওয়া হয় এনটিএমসি থেকে। এরপর তাকে গ্রেপ্তার করার দাবি ওঠে গুম-খুনের শিকার হওয়া পরিবারের স্বজনদের পক্ষ থেকে।
শুক্রবার রাজধানীর নিউমার্কেট থানায় দায়ের হওয়া একটি হত্যা মামলায় তাকে গ্রেপ্তার দেখানো হয়েছে। একইদিন বিকেলে তাকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য আটদিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেছে আদালত।
ঢাকা মেট্রোপলিটান পুলিশের মূখপাত্র মো. ফারুক হোসেন বেনারকে জানান, মেজর জেনারেল জিয়াউল আহসান (অব.) ব্যক্তিগত নিরাপত্তা বিঘ্নিত হওয়ার আশংকায় সেনাবাহিনীর আশ্রয় গ্রহণ করলে গত ১৫ আগস্ট দিবাগত রাতে সেনাবাহিনীর সদস্যরা তাকে পুলিশের কাছে হস্তান্তর করেন। এর পরিপ্রেক্ষিতে তাকে গ্রেপ্তার করে আদালতে সোপর্দ করা হয়।
শত শত মানুষ গুম ও খুনের মূল কারিগর হিসাবে সমালোচিত জিয়াউল আহসানকে গ্রেপ্তার করার দাবিতে গত সপ্তাহে গুম-খুনের শিকার পরিবারের সদস্যদের সংগঠন মায়ের ডাক কয়েকদফা মানবন্ধন করে।
গত ৫ আগস্ট গণ-আন্দোলনের মুখে শেখ হাসিনা সরকারের পতন হওয়ার পর থেকে তিনিই প্রথম সেনা কর্মকর্তা, যিনি আওয়ামী লীগ সরকারের সহযোগী হিসাবে গ্রেপ্তার হলেন।
ছাত্র-জনতার নেতৃত্বে অভ্যুত্থানে হতাহতের ঘটনা ও মানবাধিকার লঙ্ঘণের ঘটনা তদন্ত করতে জাতিসংঘ মানবাধিকার কমিশনারের অফিস থেকে তদন্ত দল আসার কয়েকদিন আগে জিয়া গ্রেপ্তার হলেন।
তিনি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সরকারের নিষেধাজ্ঞায় থাকা র্যাবের গোয়েন্দা শাখার প্রধান ছিলেন। মূলত তাঁরই তত্ত্বাবধানে বাংলাদেশে বিরোধীদলের সদস্যদের তুলে নিয়ে হত্যা অথবা গুম করার প্রচুর অভিযোগ রয়েছে।
এসব অভিযোগ থাকা সত্ত্বেও ২০২২ সালে র্যাব থেকে তাকে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন ন্যাশনাল টেলিকমিউনিকেশন মনিটরিং সেন্টারের (এনটিএমসি) মহাপরিচালকের দায়িত্ব দেওয়া হয়। এনটিএমসি টেলিফোনে মানুষের ব্যক্তিগত আলাপচারিতা, বার্তা, ছবি, ভিডিওসহ নানা কিছু রেকর্ড করতো এবং সেগুলো সরকারের বিভিন্ন সংস্থাকে সরবরাহ করা হতো বলে অভিযোগ রয়েছে।
এছাড়াও বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ এবং সংবাদ মাধ্যম বন্ধ করার পরামর্শ আসত এনটিএমসি থেকে।
শেখ হাসিনার আস্থাভাজন কর্মকর্তা হিসাবে পরিচিত ছিলেন জিয়াউল আহসান। কোটা সংস্কার আন্দোলন দমন করতে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম বন্ধ করার পরামর্শ আসে এনটিএমসি থেকে। একইসাথে দেশে ইন্টারনেট সেবা বন্ধ করে দেওয়ার পরামর্শদাতা ও সিদ্ধান্ত গ্রহণকারীদের একজন ছিলেন তিনি।
৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দায়িত্ব গ্রহনের পর গুম-খুনের শিকার পরিবারের সদস্যদের ফোরাম ‘মায়ের ডাক’ এর সদস্যরা ১৩ আগস্ট স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) এম. সাখাওয়াত হোসেনের সাথে দেখা করেন।
তাঁরা প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয় ও গোয়েন্দা সংস্থা ডিজিএফআই কার্যালয়ের সামনে বিক্ষোভও করেন। মেজর জেনারেল জিয়াউল আহসানসহ অন্যান্যদের গ্রেপ্তার ও বিচার এবং গুমের শিকার ব্যক্তিদের বের করে দেওয়ার দাবি জানান তারা।
‘মায়ের ডাক’ এর সমন্বয়ক সানজিদা ইসলাম শুক্রবার বেনারকে বলেন, “মেজর (জেনারেল) জিয়া গ্রেপ্তার হওয়া একটি ভালো খবর। তবে গ্রেপ্তার হলেই হবে না, দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হতে হবে। আমরা অতীতে দেখেছি, অনেকেই আটক হয়েছেন, কারাগারে গেছেন। কিন্তু তাদের বিচার বা সাজা হয়নি।”
“তাঁর মতো অপরাধীর বিচার নিশ্চিত করতে একটি জাতীয় কমিশন গঠন করতে হবে,” জানান সানজিদা।
জিয়াউল আহসান গুম-খুনের সাথে কতটুকু জড়িত থাকার তথ্য আছে-জানতে চাইলে সানজিদা ইসলাম বলেন, “আমাদের ফোরামের সদস্যদের যাঁদের স্বজন বিচারবহির্ভূত হত্যা অথবা গুমের শিকার হয়েছেন তাঁদের অধিকাংশই হয়েছে র্যাবের মাধ্যমে এবং তিনি তখন র্যাবের গোয়েন্দা শাখার প্রধান।ছিলেন। তিনিই সারাদেশে গুম-খুনের ব্যাপারে নির্দেশনা দিতেন বলে আমাদের কাছে তথ্যপ্রমাণ আছে।”
তিনি আরও বলেন, “তিনি শত শত গুম-খুনের সাথে জড়িত, তাঁকে জিজ্ঞাসাবাদ করলে জানা যাবে তিনি কতজনকে খুন অথবা গুম করিয়েছেন।”
“তাঁর নির্দেশেই র্যাব আমার ভাই সাজেদুল ইসলাম সুমনসহ মোট আটজনকে একরাতে গুম করে। আমরা চাই তিনি আমাদের জানাবেন, ওই আটজন কোথায় আছেন,” বলেন সানজিদা।
গুমের শিকার হয়েছিলেন সাইবার নিরাপত্তা ও অপরাধ বিশেষজ্ঞ তানভীর হাসান জোহা।
শুক্রবার জোহা বেনারকে বলেন, জিয়াউল আহসান হলেন প্রধান ব্যক্তি যিনি বিগত সরকারের আমলে বাংলাদেশে গুম-খুনসহ বিভিন্ন অপরাধ সংগঠনের গোপন তথ্যদাতা। তিনি এগুলো বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থাকে সরবরাহ করতেন।
“তিনি এনটিএমসি’র দায়িত্বে থাকাকালে যেসব ব্যক্তিকে গুম অথবা খুন করা হবে বলে টার্গেট করা হতো সেসব ব্যক্তির টেলিফোন সংলাপ, বার্তা, ছবি এবং সুনির্দিষ্ট অবস্থান ইত্যাদি সরবরাহ করতেন,” জানান জোহা।
তিনি জানান, এনটিএমসি স্থাপনের উদ্দেশ্য ছিল জাতীয় নিরাপত্তার জন্য হুমকি এমন ব্যক্তি অথবা প্রতিষ্ঠান অথবা সংগঠনকে তদারকির মধ্যে রাখা। তবে জিয়া সেটি না করে পাইকারিভাবে রাজনৈতিক নেতা, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, সাংবাদিক, সুশীল সমাজের সদস্য, এমনকি সাধারণ মানুষের ফোনালাপ, বার্তা, ছবি ইত্যাদি রেকর্ড করার কাজে সংস্থাটিকে ব্যবহার করতেন।
জোহা বলেন, “এনটিএমসি ব্যবহার করে জিয়া সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম, সংবাদমাধ্যমসহ বিভিন্ন সাইট ব্লক করতেন। এর উদ্দেশ্য হলো মানুষের মত প্রকাশের স্বাধীনতা এবং গণমাধ্যমের স্বাধীনতা হরণ করা।”
জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান ড. কামাল উদ্দিন আহমেদ শুক্রবার বেনারকে বলেন, জিয়াউল আহসানকে আটকের পর তাঁর সংস্থার আর কিছু করার নেই। আমাদের অবস্থান হলো জিয়াউল আহসানের বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগ সুনির্দিষ্টভাবে তদন্ত করে দেখা হোক। ওনার অপরাধের ধরণ অনুসারে বিচার করা।”
“আমরা চাই, দেশে আর কোনও গুম-খুনের ঘটনা না ঘটুক। সব শ্রেণির মানুষের মানবাধিকার সুরক্ষিত থাকুক।”
অনলাইন নিউজপোর্টাল বিডিনিউজ২৪ শুক্রবার এক প্রতিবেদনে জানিয়েছে, হত্যা মামলায় গ্রেপ্তার চাকরিচ্যুত সেনা কর্মকর্তা মেজর জেনারেল জিয়াউল আহসান ওই হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে নিজের সম্পৃক্ততার অভিযোগ অস্বীকার করেছেন।
জিয়াউল আহসানের বরাত দিয়ে ওই প্রতিবেদনে আরো বলা হয়, “আমি নিজেই আয়নাঘরের বিরোধী। আমাকে গত ৭ (অগাস্ট) তারিখ রাতে সেনাপ্রধানের কথা বলে আমার সহকর্মীরা নিয়ে আসেন। আমি নিজেই গত সাত-আট দিন ‘আয়নাঘরে’ আটক ছিলাম।
“আমি কখনই ডিজিএফআইয়ে চাকরি করি নাই। আমি কোনোভাবে আয়নাঘরের মত ‘কনসেপ্টের’ সঙ্গে জড়িত নই। আমিও চাই এই আয়নাঘর ভেঙ্গে দেওয়া হোক,” বলেন তিনি।