রানা প্লাজা ধসের এক দশক: কর্মপরিবেশের উন্নতি, ক্রেতার ক্রয় অভ্যাসে অবনতি

রিয়াদ হোসেন
2023.04.24
ঢাকা
রানা প্লাজা ধসের এক দশক: কর্মপরিবেশের উন্নতি, ক্রেতার ক্রয় অভ্যাসে অবনতি সাভারের রানা প্লাজা ট্র্যাজেডির দশম বার্ষিকীতে স্মৃতিস্তম্ভে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানাচ্ছেন দুর্ঘটনায় নিহতদের স্বজন, আহত শ্রমিক ও বিভিন্ন সংগঠনের সদস্যরা। ২৪ এপ্রিল ২০২৩।
[এএফপি]

রানা প্লাজা ধসের পর গত এক দশকে বৈশ্বিক ও জাতীয় উদ্যোগের ফলে পোশাক খাতে কর্মপরিবেশ উন্নত হলেও এই সময়ে ক্রেতা ও ব্র্যান্ডগুলোর ক্রয় অভ্যাসের অবনতি হয়েছে, যা শ্রমিক দুর্ভোগের জন্য দায়ী।

যুক্তরাষ্ট্রের নিউ ইয়র্ক স্টার্ন সেন্টার ফর বিজনেস এন্ড হিউম্যান রাইটসের এক গবেষণা প্রতিবেদন এ তথ্য উঠে এসেছে, যা চলতি মাসে প্রকাশ করা হয়।

“একটি ভগ্ন অংশীদারিত্ব: যেভাবে পোশাকের ব্র্যান্ডগুলো সরবরাহকারীদের শোষণ এবং শ্রমিকের ক্ষতি করে– এ বিষয়ে করণীয়”– শীর্ষক ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, “অনৈতিক ক্রয়ের অভ্যাসগুলির মধ্যে রয়েছে অযৌক্তিক দর কমানোর জন্য পণ্য রপ্তানিকারকদের চাপ দেওয়া, পাওনা বন্ধ করা এবং বুকিং বাতিল করা।”

২০২০ সালে করোনা মহামারি শুরুর পর এর প্রমাণ পাওয়া যায় উল্লেখ করে প্রতিবেদনে বলা হয়, “২০২০ সালে পাশ্চাত্যের পোশাকের ব্র্যান্ডগুলো তাদের পোশাক সরবরাহকারী দক্ষিণ ও দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোতে ক্রয়াদেশ বাতিল কিংবা পিছিয়ে দিতে থাকে, যার কারণে লাখ লাখ শ্রমিককে লে-অফ (বিনা বেতনে কারখানা ছুটি) করা হয়।”

মহামারি শুরুর সময় কর্পোরেট ক্রেতারা ৩ বিলিয়ন ডলারেরও বেশি পরিমাণের ক্রয়াদেশ কমিয়েছিল বলে উল্লেখ করা হয় প্রতিবেদনে। এতে বলা হয়, ওই বছরের জুনের মধ্যে, বাংলাদেশের কারখানাগুলো ৫৫ শতাংশ সক্ষমতায় চলছিল। একই সময়ে ব্র্যাকের সমীক্ষায় তিন চতুর্থাংশ অংশগ্রহণকারী জানিয়েছেন, তাঁরা খাবার সংগ্রহের জন্যও সংগ্রাম করেছিলেন।

‘অনৈতিক ক্রয়ের অভ্যাস’

ক্রেতাদের অনৈতিক ক্রয়ের অভ্যাসগুলো এখনো বিদ্যমান বলে জানিয়েছেন পোশাক শিল্প মালিকেরা।

বাংলাদেশের তৈরি পোশাক শিল্প মালিকদের সংগঠন বাংলাদেশ গার্মেন্টস ম্যানুফেকচারার্স এন্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিজিএমইএ) সভাপতি ফারুক হাসান বেনারকে বলেন, “ক্রেতাদের ক্রয়ের অভ্যাসে নৈতিকতার বিষয়টি থাকে না। কোভিডের সময় ক্রয়াদেশ বাতিল করেছে। যুদ্ধের কারণেও (রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ) ক্রয়াদেশ দেওয়ার পর তা ধরে রাখছে (হোল্ড), মূল্য ছাড় দিতে বলছে, দর কমাচ্ছে।”

“সেখানে (রপ্তানি হওয়া দেশে) বিক্রি কমার চাপ আমাদের উপর দিচ্ছে।…. অর্ডার কম বলে আমরা মূল্য ছাড় দিতে বাধ্য হই”– যোগ করেন তিনি।

প্রতিবেদনে বলা হয়, ক্রেতাদের অনৈতিক ক্রয় অভ্যাসের বিষয়ে ১০টি ব্র্যান্ডের কাছে জানতে চাওয়া হয়। এর মধ্যে চারটি কোম্পানি জবাব দিয়েছে। তাদের মধ্যে পিভিএইচ কর্পোরেশন এমন অভিযোগ অস্বীকার করেছে।

প্রতিষ্ঠানটির পক্ষ থেকে দেওয়া বিবৃতিতে বলা হয়, “ক্রয়াদেশ দেওয়ার পর দর কমানোর জন্য সরবরাহকারীকে চাপ দেওয়ার কাজ পিভিএইচ অতীতে কখনোই করেনি। দরের আলোচনাটি উৎপাদনের আগেই শেষ হয় এবং ওই দর গ্রহণ বা প্রত্যাখ্যানের বিকল্প সরবরাহকারীর কাছে সবসময়ই থাকে।”

এতে আরো বলা হয়, “একবার ক্রয়াদেশ দেওয়ার পর ওই পণ্য গ্রহণে পিভিএইচ শতভাগ প্রতিশ্রুতিবদ্ধ এবং কোনো কারণে অর্থপ্রদান আটকে রাখবে না।”

প্রতিবেদনে বলা হয়, রানা প্লাজার ঘটনার পর অ্যাকর্ড অন ফায়ার এন্ড বিল্ডিং সেফটি ইন বাংলাদেশ এবং অ্যালায়েন্স ফর বাংলাদেশ ওয়ার্কার্স সেফটি নামে দুটি আন্তর্জাতিক উদ্যোগের কারণে ২০১৩ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত রপ্তানিমুখী দুই হাজার তিনশ পোশাক কারখানার শ্রমিকদের নিরাপত্তায় তাৎপর্যপূর্ণ উন্নতি হয়েছে।

এ অগ্রগতির বিষয়টি স্বীকৃতি মিলেছে আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) বক্তব্যেও। গত সপ্তাহে ‘ওয়ার্ল্ড অব দ্য ওয়ার্ক শো’ নামে সংস্থাটির এক লাইভ অনুষ্ঠানে বাংলাদেশে এ দেশীয় পরিচালক টুমো পুটিআইনেন বলেন, “গত ১০ বছরে এই শিল্পের সুশাসনের ব্যাপক উন্নতি হয়েছে।”

২০১৩ সালের ২৪ এপ্রিল ঢাকার অদূরে সাভারে নয় তলা রানা প্লাজা ধসের ঘটনায় ১ হাজার ১শ’র বেশি শ্রমিক নিহত হন। এর দুই বছর পর ভবন মালিক সোহেল রানা ছাড়াও ৪০ জনকে অভিযুক্ত করে চার্জশিট দেয় পুলিশ; যার মধ্যে ১২ সরকারি কর্মকর্তাও রয়েছেন।

ক্রয়াদেশ কমে, কষ্ট বাড়ে শ্রমিকের

বাংলাদেশের পোশাক খাতের শ্রমিকদের সর্বনিম্ন মাসিক বেতন এখনো ৮ হাজার টাকা বা প্রায় ৭৫ ডলার। কোনো কারণে ক্রয়াদেশ কমলে বা বাতিল হলে তার চাপ কোনো না কোনোভাবে শ্রমিকের উপর এসে পড়ে।

প্রতিবেদনে এমন একটি ঘটনা উল্লেখ করে বলা হয়, “ক্রেতা কয়েক মিলিয়ন পিস পোশাকের ক্রয়াদেশ দেওয়ার জন্য কারখানাটিকে বুকড করেছিলেন, কিন্তু যখন ব্যবসা খারাপ হলো, তিনি ওই বুকিং বাতিল করে দিলেন।”

বর্তমানের বাংলাদেশের পোশাক রপ্তানি কমতির দিকে। রপ্তানির উন্নয়ন ব্যুরো’র (ইপিবি) তথ্য অনুযায়ী, সর্বশেষ মার্চ মাসে পোশাক রপ্তানি আগের অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় কমেছে।

তৈরি পোশাক শিল্প মালিকদের সংগঠন বাংলাদেশ গার্মেন্টস ম্যানুফেকচারার্স এন্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিজিএমইএ) সভাপতি ফারুক হাসান বেনারকে বলেন, “ক্রয়াদেশ কমতির এই ধারা অন্তত আগামী জুন নাগাদ চলবে।”

পোশাক কারখানাগুলোতে পরবর্তী তিন থেকে চার মাসের ক্রয়াদেশের ধারণা পাওয়া যায় রপ্তানিকারকদের কাঁচামাল ব্যবহারের ঘোষণার উপর; যা ইউটিলিটি ডিক্লারেশন বা ইউডি হিসেবে পরিচিত। পোশাক রপ্তানিকারকদের এই ইউডি প্রদান করে তাদের স্ব স্ব সংগঠন যেমন বিজিএমইএ ও বিকেএমইএ। বিজিএমইএ সভাপতি জানান, বর্তমানে ইউডি প্রায় ৩০ শতাংশ কম।

বাংলাদেশে বিদেশি ক্রেতাদের পক্ষে ক্রয়াদেশ দেওয়া বা প্রতিনিধিত্ব করা গার্মেন্টস বায়িং হাউসগুলোর সংগঠন বাংলাদেশ গার্মেন্টস বায়িং হাউজ অ্যাসোসিয়েশনের (বিজিবিএ) সভাপতি কাজী ইফতেখার হোসেন বেনারকে বলেন, “বর্তমানে ২৫ থেকে ৩০ শতাংশ ক্রয়াদেশ কম আছে (স্বাভাবিক সময়ের তুলনায়)।”

বায়ারদের প্রতিনিধিরা জানিয়েছেন, মূলত রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ পরবর্তী মূল্যস্ফীতির কারণে পোশাকের চাহিদা কমায় ক্রয়াদেশ কমতির দিকে।

শ্রমিকরাও জানিয়েছেন পোশাক কারখানাগুলোতে কাজ কম হওয়ায় তাদের আয় কমেছে, যা বর্তমান মূল্যস্ফীতির মধ্যে তাদের উপর নতুন চাপ তৈরি করেছে।

ঢাকার কচুক্ষেত এলাকার ভিশন অ্যাপারেলসের শ্রমিক (অপারেটর) হালিমা আক্তার বেনারকে বলেন, “তিন মাসের বেশি সময় ধরে ওভারটাইম (বাড়তি সময় কাজ করা) হচ্ছে না। আগে ওভারটাইমসহ ১৬ হাজার টাকার বেশি পেতাম। এখন শুধু বেতন পাই ১১ হাজার টাকা। আর কিছু পাই না।”

রাজধানীর মিরপুরে ইপিলিয়ন গার্মেন্টসের শ্রমিক আল আমিন জানান, তাঁদের কারখানায় কাজ কমে গেছে। গত জানুয়ারি থেকে ওভারটাইম কাজ একেবারেই নেই।

তিনি বেনারকে বলেন, “ওভারটাইমসহ ১৫ হাজার টাকা পেতাম। এখন ১০ হাজার টাকার বেশি পাই না। এদিকে জিনিসপত্রের দামও খুব বেড়েছে। বাধ্য হয়ে স্ত্রী সন্তানদের গ্রামের বাড়িতে (রাজবাড়ি জেলায়) পাঠিয়ে দিয়েছি। একার চলাও খুবই কষ্টকর হয়ে গেছে।”

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো’র হিসাব অনুযায়ী, গত বছরের আগস্টে দেশে ১২ বছরের মধ্যে সবচেয়ে বেশি মূল্যস্ফীতি হয়, যা ছিল দশ শতাংশের কাছাকাছি। সর্বশেষ গত মার্চেও মূল্যস্ফীতি ছিল ৯ দশমিক ৩৩ শতাংশ।

সোচ্চার রপ্তানিকারকরা

বিদেশি ক্রেতাদের ক্রয় অভ্যাসে নৈতিকতা প্রতিষ্ঠায় আন্তর্জাতিক বিভিন্ন ফোরামে বিষয়গুলো তুলে ধরা হচ্ছে বলে বেনারকে জানান তিনি বিজিএমইএ সভাপতি।

কোভিড পরবর্তী ২০২১ সালে সাসটেইনেবল টার্মস অব ট্রেড ইনিশিয়েটিভ (এসটিটিআই) উদ্যোগ শুরু হয়, যা মূলত বাণিজ্যিক নীতি-নৈতিকতা পরিপালনের বিষয়টিতে গুরুত্ব দিতে এক ধরনের চাপ সৃষ্টিকারী হিসেবে কাজ করবে।

এই উদ্যোগের সঙ্গে আছে সাসটেইনেবল টেক্সটাইল অব দ্য এশিয়া রিজিয়ন বা স্টার নেটওয়ার্ক, ইন্টারন্যাশনাল অ্যাপারেল ফেডারেশনসহ (আইএএফ) আরো কিছু সংস্থা, যাতে বাংলাদেশসহ বিশ্বের ৯টি দেশের ১৩টি সংগঠনের প্রতিনিধিত্ব রয়েছে। ক্রয় অভ্যাসকে টেকসই করতে দর, মূল্য পরিশোধের সময়, তৃতীয় পক্ষের অবস্থান, বিরোধ নিষ্পত্তিসহ বেশকিছু বিষয় উল্লেখ রয়েছে, যা নিয়ে তারা কাজ করবে।

আইএএফ এর বোর্ড সদস্য ও বাংলাদেশ নিটওয়্যার ম্যানুফেকচারার্স এন্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিকেএমইএ) সহসভাপতি ফজলে শামীম এহসান বেনারকে বলেন, “এসটিটিআই এর উদ্দেশ্য হলো কেবল বাংলাদেশ নয়, বিশ্বব্যাপী অনৈতিক ক্রয় অভ্যাস যাতে না হয়, তা নিশ্চিত করা। একটি টেকসই ক্রয় ও শ্রমিকের কাজের পরিবেশ নিশ্চিত করা এর উদ্দেশ্য।”

তিনি বলেন, “আগামী ২০২৫ সালের মধ্যে সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন সংস্থা ও দেশের সঙ্গে এ বিষয়টি তুলে ধরা হবে, যাতে দেশগুলো নৈতিক ক্রয় অভ্যাস সংশ্লিষ্ট বিষয়গুলোকে আইনি ভিত্তি দেয়।”

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।