ধর্ষণ মামলায় নারীর চরিত্র নিয়ে প্রশ্ন তোলার সুযোগ বন্ধ হচ্ছে

কামরান রেজা চৌধুরী
2021.12.07
ঢাকা
ধর্ষণ মামলায় নারীর চরিত্র নিয়ে প্রশ্ন তোলার সুযোগ বন্ধ হচ্ছে ঢাকার বনানী এলাকায় রেইনট্রি হোটেলে একজন ছাত্রী ধর্ষিত হওয়ার চাঞ্চল্যকর মামলায় সব আসামি খালাস পাওয়ার পর বিতর্কিত সাক্ষ্য আইন সংশোধনের দাবিতে ঢাকায় বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষের পদযাত্রা। ২৬ নভেম্বর ২০২১।
[বেনারনিউজ]

ধর্ষণের বিচার প্রক্রিয়ায় বিচারপ্রার্থী ও সাক্ষীদের চরিত্র নিয়ে প্রশ্ন তোলার সুযোগ বন্ধে ব্রিটিশ আমলে প্রণীত সাক্ষ্য আইনের দুটি বিতর্কিত ধারা সরকার বাদ দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে বলে বেনারকে জানিয়েছেন আইনমন্ত্রী আনিসুল হক।

সাক্ষ্য আইনের ১৫৫(৪) এবং ১৪৬(৩) ধারা সংশোধনে বিচার বিভাগের হস্তক্ষেপ চেয়ে গত মাসের মাসের মাঝামাঝি উচ্চ আদালতে রিট আবেদন করে তিন মানবাধিকার সংগঠন। এই আবেদনের প্রেক্ষিতে সরকার ধারা দুটিসহ ১৮৭২ সালের সাক্ষ্য আইনটি সম্পূর্ণভাবে যুগোপযোগী করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে বলে জানান মন্ত্রী।

আনিসুল হক বেনারকে বলেন, “সাক্ষ্য আইনের দুটি ধারা নিয়ে রিট আবেদনের বিষয়টি আমাদের দৃষ্টিগোচর হয়েছে। আমরা ওই আইনের ১৪৬(৩) এবং ১৫৫(৪) দুটি ধারাসহ অন্যান্য ধারা যেগুলো ধর্ষণের বিচার প্রক্রিয়ায় বাধা সৃষ্টি করে সেগুলো সংশোধন করার সিদ্ধান্ত নিয়েছি।”

তিনি বলেন, “আইনটি এখন সংশোধনীর পর্যায়ে রয়েছে। আমাদের সিদ্ধান্ত হলো, আমরা ১৮৭২ সালের সাক্ষ্য আইনটি সম্পূর্ণ পর্যালোচনা করে সংশোধন করব।”

“মানবাধিকার কর্মীরা যা বলেন সেটি আসলে ভুল নয়,” মন্তব্য করে আইনমন্ত্রী বলেন, “সাক্ষ্য আইনের ওই দুটি ধারার কারণে ধর্ষণের বিচারপ্রার্থীদের বিচার পাওয়ার সুযোগ সংকুচিত হয়ে আসে। এই ধারা দুটির কারণে ধর্ষণের অভিযোগে অভিযুক্তরা অনেক সময় আইনি প্রক্রিয়ায় সুবিধা পায়।”

“ধারা দুটি সংশোধিত হলে ধর্ষণ মামলা বিচারের প্রক্রিয়া আরও স্বচ্ছ হবে, গতিশীল হবে,” বলেন মন্ত্রী।

ব্রিটিশ ভারত সরকার প্রবর্তিত সাক্ষ্য আইন-১৮৭২ সালের ধারা দুটি সংশোধনের ব্যাপারে মানবাধিকার কর্মীরা বহুদিন ধরে দাবি জানিয়ে আসলেও ধারা দুটি সংশোধন করা হয়নি।

এ বছর ১২ নভেম্বর আলোচিত রেইনট্রি মামলার রায়ের পর বিষয়টি পুনরায় সামনে আসে।

কেন এই সংশোধনের রিট?

২০১৭ সালের ৬ মে বনানী থানায় একটি ধর্ষণ মামলা করেন ঢাকার এক বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী। তিনি অভিযোগ করেন, ওই বছর ২৮ মার্চ বনানীর রেইনট্রি হোটেলে জন্মদিনের এক অনুষ্ঠানে ডেকে নিয়ে তাঁকে এবং আরেক নারীকে ধর্ষণ করেছিলেন মামলার প্রধান আসামি আপন জুয়েলার্সের মালিকের ছেলে সাফাত আহমেদ ও তার বন্ধু নাঈম আশরাফ।

ওই দুজন ছাড়াও মামলায় সাফাতের দুই বন্ধু এবং দেহরক্ষী এবং গাড়িচালকের বিরুদ্ধে ধর্ষণে সহযোগিতার অভিযোগ আনা হয়। মামলার পর আটক হন সব আসামি।

তদন্তের পর অভিযোগপত্র জমা দেন তদন্ত কর্মকর্তা ও পুলিশের উইমেন সাপোর্ট অ্যান্ড ইনভেস্টিগেশন ডিভিশনের পরিদর্শক ইসমত আরা এমি। অভিযোগপত্রে ধর্ষণের অভিযোগের সত্যতা পাওয়ার কথা উল্লেখ করেন তদন্ত কর্মকর্তা।

তবে এ বছর ১২ নভেম্বর এই মামলার রায়ে অভিযুক্ত সবাইকে বেকসুর খালাস দেন ঢাকার ৭ নম্বর নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালের বিচারক বেগম মোছা. কামরুন্নাহার। তিনি বলেন, ধর্ষণের বিচারপ্রার্থী তরুণী স্বেচ্ছায় রেইনট্রি হোটেলে গিয়ে আসামির সঙ্গে যৌন সম্পর্ক স্থাপন করেছিলেন বলেই প্রমাণিত হয়েছে এবং ধর্ষণের অভিযোগ প্রমাণিত হয়নি।

ধর্ষণের বিচার সম্পর্কে হাইকোর্টের আগের একটি রায় অনুযায়ী, শুধু ডাক্তারি পরীক্ষা না হওয়ার কারণে ধর্ষণের আসামি খালাস পেতে পারে না। এতে বলা হয়, ভিকটিমের মৌখিক সাক্ষ্য ও পারিপার্শ্বিক সাক্ষ্য দ্বারা আসামির বিরুদ্ধে ধর্ষণের অভিযোগ প্রমাণিত হলে আসামিকে সাজা দেওয়া যেতে পারে।

১২ নভেম্বর রায়ের পর সমালোচনার ঝড় ওঠে। মানবাধিকার কর্মীরা বলেন, এই রায়ের মাধ্যমে বিচারপ্রার্থী নারীর চরিত্র নিয়ে কথা বলেছেন এই বিচারক। তাঁদের মতে, বিচারক এমন মন্তব্য করার ভিত্তি সাক্ষ্য আইনের ওই দুটি ধারা।

মানবাধিকার সংগঠন বাংলাদেশ লিগ্যাল এইড অ্যান্ড সার্ভিসেস ট্রাস্ট, আইন ও সালিশ কেন্দ্র এবং নারীপক্ষ যৌথভাবে ১৪ নভেম্বর হাইকোর্টে সাক্ষ্য আইনের ১৪৬(৩) এবং ১৫৫(৪) দুটি ধারা সংশোধনের জন্য আদালতের শরণাপন্ন হয়।

ওই তিন সংগঠনের পক্ষে আদালতে রিট পিটিশন দায়ের করেন ব্যারিস্টার সারা হোসেন।

তিনি বেনারকে বলেন, “আমরা মানবাধিকার কর্মীরা বহুদিন ধরে সাক্ষ্য আইনের ধারা দুটি সংশোধনের দাবি করে আসছিলাম। কিন্তু সেই কাজটি আজও হয়নি। সে কারণে আমরা আদালতে রিট আবেদন দাখিল করেছি।”

ধারা দুটি ব্যাখ্যা করে সারা হোসেন বলেন, “সাক্ষ্য আইনের ১৫৫(৪) অনুযায়ী কোনো ব্যক্তির বিরুদ্ধে কোনো নারী আদালতে ধর্ষণের বিচার চাইলে বিচারপ্রার্থী ওই নারীর চরিত্র নিয়ে প্রশ্ন করা যাবে। ওই নারী সচ্চরিত্রের ছিল কি না সেব্যাপারে প্রশ্ন করা যাবে।”

তিনি বলেন, “১৪৬(৩) অনুযায়ী কোনো সাক্ষীকে আদালতে জেরা করার সময় তাঁর চরিত্র সম্পর্কে প্রশ্ন করা যাবে। এই বিধানের কারণে আসামির আইনজীবী ওই সাক্ষীর চরিত্রের প্রশ্ন তুলে তাঁর দেয়া সাক্ষ্য অগ্রহণযোগ্য বলে তুলে ধরতে পারেন।”

“এই দুটি ধারাই ধর্ষণের বিচার পাওয়ার ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতা। আমরা চাই, এই দুটি ধারা সাক্ষ্য আইন থেকে চিরতরে বাদ দেয়া হোক,” বলেন সারা হোসেন।

তিনি বলেন, “ভারত, পাকিস্তান অনেক আগেই ব্রিটিশ আমলে প্রণীত এই সাক্ষ্য আইন থেকে এই ধারা দুটি বাদ দিয়ে দিয়েছে। কিন্তু আমরা আজও করতে পারিনি। আরও আগেই আমাদের আদালতে শরণাপন্ন হওয়া উচিত ছিল।”

ধর্ষণের শিকার নারীরা বিচার থেকে বঞ্চিত হন

২০১৯ সালে বাংলাদেশ লিগ্যাল এইড অ্যান্ড সার্ভিসেস ট্রাস্ট, ইউএন উইমেন এবং কানাডীয় উন্নয়ন সংস্থার (সিডা) এক যৌথ প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, বাংলাদেশের শহরাঞ্চলে শতকরা ৯৫ ভাগ এবং গ্রামাঞ্চলে ৮৮ ভাগ ক্ষেত্রে ধর্ষণের আসামিদের আইনের আওতায় আনা সম্ভব হয় না।

সরকারের ওয়ান স্টপ ক্রাইসিস সেন্টারের তথ্যানুযায়ী, ২০০১ থেকে ২০১৩ সাল পর্যন্ত ধর্ষণের শিকার নারী ও শিশুরা মেডিক্যাল পরীক্ষা এবং চিকিৎসা নেয়ার পর আর আইনি ব্যবস্থা নেননি।

প্রতিবেদনে বলা হয়, এই তথ্যের মাধ্যমে প্রতীয়মান হয় যে বাংলাদেশে ধর্ষণের শিকার নারীরা বিচার থেকে বঞ্চিত হন এবং ধর্ষণকারীরা পার পেয়ে যায়।

বাংলাদেশ লিগ্যাল এইড অ্যান্ড সার্ভিসেস ট্রাস্টের সিনিয়র স্টাফ আইনজীবী শারমিন শিউলি বলেন, “সাক্ষ্য আইনের এই দুটি ধারার মূল কথা হলো, কোনো নারী যদি কোনো পুরুষের সাথে শারীরিক সম্পর্কে যান সেক্ষেত্রে তিনি ধর্ষিত হয়েছেন, সেটি গ্রহণযোগ্য হবে না। শুধু প্রকৃত সতী নারীরাই ধর্ষণের শিকার হতে পারেন।”

তিনি বলেন, “এটি কোনো গ্রহণযোগ্য বিষয় হতে পারে না। কোনো নারী পূর্বে শারীরিক সম্পর্ক স্থাপন করুন অথবা না করুন তাঁর মতের বিরুদ্ধে শারীরিক সম্পর্ক করা হলেই সেটি ধর্ষণ বলে গণ্য হবে।”

বাংলাদেশের বিদ্যমান নারী ও শিশু নির্যাতন দমনে আইন অনুযায়ী ধর্ষণের সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড।

জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. মিজানুর রহমান বেনারকে বলেন, “আমাদের দেশের বিদ্যমান সাক্ষ্য আইনটি ব্রিটিশ আমলে প্রণীত। ওই দুটি ধারা সেই সময়ের সমাজ ব্যবস্থা এবং সমাজের দৃষ্টিভঙ্গি থেকে আইনে অন্তর্ভুক্ত করে ব্রিটিশ সরকার। তখন মৌলিক মানবাধিকারের কোনো ধারণাই ছিল না।”

“বর্তমানে একবিংশ শতাব্দীতেও এই ধারা দুটি চালু আছে। এটি গ্রহণযোগ্য নয়। এই দুটি ধারা অবশ্যই আইন থেকে বাদ দিতে হবে,” বলেন মিজানুর রহমান।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।