চট্টগ্রামে নয় বছরের শিশু ধর্ষণ ও হত্যা মামলায় আটজনের মৃত্যুদণ্ড
2020.12.14
ঢাকা

নয় বছরের মাদ্রাসা ছাত্রী ফাতেমা আক্তার মীমকে ধর্ষণের পর হত্যার ঘটনায় সোমবার আটজনকে মৃত্যুদণ্ড দিয়েছে চট্টগ্রামের একটি আদালত, যাকে ‘দৃষ্টান্তমুলক শাস্তি’ হিসেবে গণ্য করছেন মানবাধিকারকর্মীরা।
“আসামিদের সবাইকে মৃত্যুদণ্ড ও এক লাখ টাকা করে অর্থদণ্ড দিয়েছে আদালত। রায় ঘোষণার সময় সাত আসামি আদালতে উপস্থিত ছিল,” বেনারকে বলেন রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী এম এ নাসের।
মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আটজনের মধ্যে একজন পলাতক বলে জানান তিনি।
“আসামিরা সুস্থ্ মস্তিস্কে পরিকল্পিতভাবে এই শিশুকে ধর্ষণ করে হত্যাকাণ্ড ঘটায়,” মন্তব্য করে বাদী পক্ষের আইনজীবী বিবেকানন্দ চৌধুরী বেনারকে বলেন, “এমন নৃশংস হত্যাকাণ্ডের শাস্তি মৃত্যুদণ্ড ছাড়া কিছু হতেই পারে না।”
চট্টগ্রাম মহানগরীর আকবর শাহ এলাকার রাজা কাশেমের কলোনির বাসিন্দা মীম ছিল স্থানীয় ফাতেমাতুজ জোহরা হেফজুল কোরআন মহিলা মাদ্রাসার দ্বিতীয় শ্রেণির শিক্ষার্থী। তাঁর বাবা মো. জামাল উদ্দিন শ্রমিক।
২০১৮ সালের ২১ জানুয়ারি আয়শা মমতাজ মহল নামের একটি ভবনে নিয়ে গিয়ে ধর্ষণের পরে শ্বাসরোধ করে হত্যা করা হয় তাঁকে। ঘটনার দিন রাত ১০টার দিকে ভবনটির দ্বিতীয় তলার সিঁড়ির পাশ থেকে মীমের মরদেহ উদ্ধার করে পুলিশ।
আলোচিত এ মামলায় প্রত্যক্ষদর্শীসহ গুরুত্বপূর্ণ ১৮ জন সাক্ষীর সাক্ষ্য গ্রহণ করা হয়।
“এই রায়ে আমি সন্তুষ্ট,” জানিয়ে নিহতের মা ও মামলার বাদী বিবি রাবেয়া বেগম বেনারকে বলেন, “আমি চাই আমার শিশু হত্যাকারীরা যেন আইনের ফাঁক ফোঁকর দিয়ে বের হয়ে না যায়। যেন উচ্চ আদালতও এ বিচার বহাল রেখে দ্রুত ফাঁসি কার্যকর করে।”
পলাতক আসামিকেও দ্রুত আইনের আওতায় আনার দাবি করেন সন্তান হারানো এই মা।
“একটি ধর্ষণের ঘটনায় আটজনের ফাঁসির রায় সচরাচর শোনা যায় না। এটি দৃষ্টান্তমুলক শাস্তি,” মন্তব্য করে মানবাধিকারকর্মী সালমা আলী বেনারকে বলেন, “ধর্ষণের মতো অপরাধ কমিয়ে আনার জন্য এ ধরনের কঠোর শাস্তি হওয়া উচিত।”
তাঁর মতে, এসব ক্ষেত্রে দ্রুত বিচারিক প্রক্রিয়া শেষ করার পাশাপাশি দ্রুত ফাঁসি কার্যকর করাও জরুরি। কারণ, “এ ধরনের কিছু শাস্তি দৃশ্যমান না হলে দেশে ধর্ষণের মতো অপরাধ কমানো সম্ভব হবে না।”
তবে আসামীদের আইনজীবী রহিমা বেগম বেনারকে জানান, তারা এই রায়ে সংক্ষুব্ধ। আসামিরা উচ্চ আদালতে এ রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করবেন।
মীম ধর্ষণ ও হত্যার ঘটনায় চট্টগ্রাম নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল-৪ এর বিচারক বিচারক মো. জামিউল হায়দারের রায়ে সোমবার মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্তরা হচ্ছেন; মো. বেলাল হোসেন ওরফে বিজয়, মো. রবিউল ইসলাম ওরফে রুবেল, মো. হাছিবুল ইসলাম ওরফে লিটন, মো. আকসান মিয়া প্রকাশ হাসান, মো. সুজন, মো. মেহেরাজ প্রকাশ টুটুল, আয়শা মমতাজ মহলের কেয়ারটেকার মনিরুল ইসলাম মনু ও শাহাদাত হোসেন সৈকত।
এদের মধ্যে সৈকত মামলার শুরু থেকেই পলাতক।
শিশু হত্যার ঘটনায় টাঙ্গাইলে দণ্ডিত নয়
একইদিন দুই শিশুকে অপহরণের পর হত্যার ঘটনায় তিনজনের মৃত্যুদণ্ড, তিনজনের আমৃত্যু ও তিনজনের যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দিয়েছেন টাঙ্গাইলের অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা জজ দ্বিতীয় আদালতের বিচারক সাউদ হাসান।
আসামিদের মধ্যে ধামরাই উপজেলার চরচৌহাট গ্রামের তাজেল মিয়ার ছেলে আরিফ (২৮) এখনও পলাতক বলে সাংবাদিকদের জানান অতিরিক্ত পাবলিক প্রসিকিউটর খোরশেদ আলম। ১৬ জনের সাক্ষ্যগ্রহণ শেষে আদালত এ রায় দিয়েছে বলেও তিনি উল্লেখ করেন।
ঢাকার ধামরাই উপজেলার চরচৌহাট এলাকার দেলোয়ার হোসেনের ছেলে শাকিল (১০) ও আবু বক্করের ছেলে ইমরান (১১) ২০১৬ সালের ২৭ জানুয়ারি বিকালে অপহৃত হয়। পরদিন তাদের স্বজনদের ফোন করে এক লাখ টাকা মুক্তিপণ দাবি করে অপহরণকারীরা।
অপহরণের দুই দিন পর ২৯ জানুয়ারি রাতে মির্জাপুর উপজেলার হাড়িয়া গ্রামের একটি লেবু বাগান থেকে চতুর্থ শ্রেণির ওই দুই শিক্ষার্থীর গলাকাটা মরদেহ উদ্ধার করা হয়। ৩০ জানুয়ারি শিশুর মা জ্যোৎস্না বেগম বাদী হয়ে মামলা করেন।
পরবর্তীতে ১১ জনের নাম উল্লেখ করে একই বছরের ৮ জুন আদালতে চার্জশিট জমা দেয় পুলিশ। দুজনের বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণিত না হওয়ায় তাঁদের মামলা থেকে অব্যাহতি দেয় আদালত। বাকি ১০ জনের মধ্যে নয় আসামিকে জেলহাজতে পাঠানো হয়।
রায় ঘোষণার পর আসামিপক্ষের আইনজীবী জহিরুল ইসলাম সাংবাদিকদের বলেন, “এ হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে আসামিরা জড়িত নয়। এ রায়ে আমরা সন্তুষ্ট নই। এ বিষয়ে উচ্চ আদালতে আপিল করা হবে।”
মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্তরা হলেন; চরচৌহাট গ্রামের তারা মিয়ার ছেলে মিল্টন (২২), একই গ্রামের শামছুল হকের ছেলে বাহাদুর মিয়া (২২) এবং মির্জাপুর উপজেলার সুজানিলজা গ্রামের বাছেদ মিয়ার ছেলে রনি মিয়া (২৫)।
আমৃত্যু কারাদণ্ডপ্রাপ্তরা হলেন; চরচৌহাট গ্রামের আফসার উদ্দিনের ছেলে শাহিনুর এলাইজ শাহ (৩০), শশধরপট্টি গ্রামের মমরেজের ছেলে জহিরুল ইসলাম (২০) এবং মির্জাপুর উপজেলার আমরাইল তেলীপাড়া গ্রামের শাহাদত হোসেনের ছেলে আব্দুল মালেক (৩৫)।
এ ছাড়া যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্তরা হলেন; চরচৌহাট গ্রামের তাজেল মিয়ার ছেলে আরিফ (২৮), আফসার উদ্দিনের ছেলে শামীম মিয়া (২৫) এবং আমরাইল তেলীপাড়ার জব্বার মল্লিকের ছেলে জাকির হোসেন (২৮)।
রায়ে সন্তুষ্ট জানিয়ে মামলার বাদী জ্যোৎস্না বেগম সাংবাদিকেদের বলেন, “আমি দ্রত এ রায় কার্যকর করার দাবি জানাচ্ছি।”
প্রসঙ্গত, ‘আমৃত্যু’ উল্লেখ না থাকলে যাবজ্জীবন সাজার মেয়াদ ৩০ বছর হিসেবে গণ্য হবে বলে পহেলা ডিসেম্বর এক রায়ে জানিয়েছে সুপ্রিম কোর্ট।
দেশে বর্তমানে যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্ত পাঁচ হাজার ৫২৩ জন এবং আমৃত্যু সাজাপ্রাপ্ত ৩৭ জন বন্দি রয়েছেন বলে সোমবার বেনারকে জানান সহকারী কারা মহাপরিদর্শক কাওয়ালিন নাহার।
ঢাকা থেকে তথ্য দিয়ে সহায়তা করেছেন শরীফ খিয়াম।