নোয়াখালীতে ধর্ষণচেষ্টা ও বিবস্ত্র করে ভিডিও প্রচার, ১৩ আসামির ১০ বছর করে জেল
2021.12.14
ঢাকা
নোয়াখালীর বেগমগঞ্জে ঘরে ঢুকে এক নারীকে (৩৭) ধর্ষণের চেষ্টা ও বিবস্ত্র করে ভিডিও প্রচারের বহুল আলোচিত মামলায় ১৩ আসামির সবাইকে ১০ বছর করে কারাদণ্ড দিয়েছে আদালত।
মঙ্গলবার নোয়াখালী নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল-১ এর বিচারক (জেলা জজ) জয়নাল আবদিন এই রায় ঘোষণা করেন।
একইসঙ্গে তাঁদের প্রত্যেককে ৫০ হাজার টাকা করে জরিমানা, অনাদায়ে তিন মাস করে কারাদণ্ড দেওয়া হয় বলে বেনারকে জানান রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী মামুনুর রশীদ লাভলু।
এই রায়ে অসন্তোষ প্রকাশ করেছেন বাদী ও ভুক্তভোগী সেই নারী। রায় ঘোষণার পর আদালত প্রাঙ্গণে সাংবাদিকদের তিনি বলেন, “আমি এ রায়ে সন্তুষ্ট নই। তারা আমাকে যেভাবে নির্যাতন করেছে, আর কোনো নারী যেন আমার মতো এ ধরনের ঘটনার শিকার না হয়। এজন্য তাদের ফাঁসি হওয়া দরকার ছিল।”
নিরাপত্তাহীনতার কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, “তারা (আসামিরা) উচ্চ আদালত থেকে জামিনে বের হয়ে আসতে পারলে আমাকে এবং আমার পরিবারের কাউকে বাঁচতে দেবে না। আমার একটাই চাওয়া তারা যেন কোনোভাবেই বের হতে না পারে।”
রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী মামুনুর রশীদ বলেন, “আদালত আসামিদের বিরুদ্ধে সর্বোচ্চ সাজা দিয়েছে। এতে আমরা খুশি। তবে রায়ের পর্যবেক্ষণে আদালত বলেছেন, “ঘটনার বীভৎসতা বিবেচনায় আসামিদের আরও কঠিন সাজার প্রয়োজন থাকলেও আইন অনুযায়ী সর্বোচ্চ সাজা দেওয়া হয়েছে।”
‘এমন বহু ঘটনা আড়ালেই থেকে যায়’
এই ঘটনায় ভুক্তভোগী ওই নারীকে আইনি সুরক্ষাসহ মানসিক সহায়তা দিয়ে আসছে বাংলাদেশ জাতীয় মহিলা আইনজীবী সমিতি। সংস্থাটির সভাপতি ও সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী সালমা আলী বেনারকে বলেন, “ধর্ষণের চেষ্টা ও নির্যাতনের ঘটনায় আইন অনুযায়ী যে শাস্তি প্রাপ্য আদালত সেটাই দিয়েছে। সাজা নিয়ে আমরা সন্তুষ্ট।”
“এই ঘটনার ভিডিও ফুটেজ ছড়িয়ে পড়ার পর দেশব্যাপী প্রতিবাদের ঝড় ওঠে। ফলে মহিলা সমিতির মতো অনেক নারী সংগঠন ওই নারীর সুরক্ষায় এগিয়ে আসে। এই ধরনের অপরাধ কমাতে এই রায় দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে,” যোগ করেন তিনি।
“তবে এমন বহু অপরাধের ঘটনা আছে যেগুলো ভাইরাল হয় না বা আড়ালেই থেকে যায়। আসামিরা প্রভাবশালীদের ছত্রছায়ায় পার পেয়ে যায়। আবার ভুক্তভোগীরাও সুরক্ষার অভাবে বিচার চাওয়ার সাহস পায় না। ফলে এ ধরনের অপরাধ বাড়তে থাকে। তাই আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে তৎপর থাকতে হবে,” বলেন মানবাধিকার কর্মী সালমা আলী।
এদিকে আসামিপক্ষের আইনজীবী আব্দুল কাইয়ুম দিদার বেনারকে বলেন, “এই রায়ে আমরা সন্তুষ্ট নই। এর বিরুদ্ধে আমরা উচ্চ আদালতে আপিল করব। আশা করি সেখানে সুবিচার পাব।”
দুপক্ষের আইনজীবীরা জানান, দণ্ডপ্রাপ্ত আসামিদের মধ্যে কারাগারে থাকা নয়জন; দেলোয়ার হোসেন দেলু, নুর হোসেন বাদল, আবদুর রহিম, আবুল কালাম, ইসরাফিল হোসেন মিয়া, মাঈন উদ্দিন সাজু, সামছুদ্দিন সুমন কনট্রাকটর, নুর হোসেন রাসেল ও আনোয়ার হোসেন সোহাগকে রায়ের সময় আদালতে উপস্থিত করা হয়।
বাকি চার আসামি আবদুর রব চৌধুরী, মোস্তাফিজুর রহমান, জামাল উদ্দিন ও মিজানুর রহমান তারেক পলাতক।
গত বছরের বেগমগঞ্জ উপজেলার দেলোয়ার বাহিনীর প্রধান দেলোয়ার হোসেন ওরফে দেলুসহ ১৪-১৫ জনের একদল দুর্বৃত্ত ২ সেপ্টেম্বর রাত নয়টার দিকে জোর করে ওই নারীর ঘরে ঢোকেন।
প্রথমে ওই নারীর স্বামীকে মারধর করা হয়। এরপর নারীকে বিবস্ত্র করে ধর্ষণের চেষ্টা চলে এবং পুরো ঘটনার ভিডিও ধারণ করা হয়। এর ৩২ দিন পর অভিযুক্ত ব্যক্তিরা ভিডিওটি সামাজিক যোগাযোগের বিভিন্ন মাধ্যমে ছড়িয়ে দেয়। ভয়ে আত্মগোপনে থাকা ভুক্তভোগী ওই নারীকে সেদিনই উদ্ধার করে পুলিশ হেফাজতে নেওয়া হয়।
ছড়িয়ে পড়া এই ভিডিও দেশব্যাপী ব্যাপক ক্ষোভের জন্ম দেয়। অভিযুক্ত ব্যক্তিদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবি দাবিতে কয়েক সপ্তাহ ধরে প্রতিবাদী কর্মসূচি পালন করে বিভিন্ন সংগঠন ও শ্রেণিপেশার মানুষ।
এরপর নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন এবং পর্ণগ্রাফি আইনে বেগমগঞ্জ মডেল থানায় দুটি মামলা করেন ভুক্তভোগী ওই নারী।
পরে তিনি একই থানায় আরেকটি মামলা করেন; যাতে দেলোয়ার বাহিনীর প্রধান দেলোয়ার হোসেন দেলু ও তাঁর সহযোগী আবুল কালামের বিরুদ্ধে ২০১৯ সালের ৫ অক্টোবর এবং ২০২০ সালের ৭ এপ্রিল দুই দফায় তাঁকে ধর্ষণের অভিযোগ আনা হয়। গত ৪ অক্টোবর ওই ধর্ষণ মামলায় রায়ে ওই দুই আসামিকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেয় নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল।
বিবস্ত্র করে ধর্ষণ চেষ্টা ও নির্যাতনের ঘটনার তদন্ত করে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই)। মোট ১৪ আসামির বিরুদ্ধে আদালতে অভিযোগপত্র দেয় সংস্থাটি। পরে স্থানীয় ইউপি সদস্য মোয়াজ্জেম হোসেন সোহাগকে বাদ দিয়ে গত ২৪ মার্চ ১৩ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করে বিচার শুরু করে আদালত।